সাইফুল মিয়া একজন আর্টিস্ট।
আর্টিস্ট না আরটিশ।
মানুষজন বলে আরটিশ। নিজেও বলেন আরটিশ।
‘আমি হলাম সাইফুল আরটিশ।’
আমাদের শহরের বাসস্ট্যান্ড রোডে একটা দোকান আছে সাইফুল আরটিশের। শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্প। সাইফুল আরটিশ সাইনবোর্ড লিখেন এবং আবু কফিল রাবারস্ট্যাম্প বানায়। আবু কফিল সাইফুল আরটিশের ভাবশিষ্য এবং স্যাঙাত। ওস্তাদ মানে সাইফুল আরটিশকে। কাহিনি এই সাইফুল আরটিশ এবং আবু কফিলকে নিয়ে।
সাইফুল আরটিশ সাইনবোর্ড লিখে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাইন করেন। সাই লিখে একটা ফুল এঁকে দেন। সাই আর ফুল মিলে সাইফুল। আবু কফিলের গোপন বাসনা, রাবারস্ট্যাম্পেও যদি এই ব্যবস্থা থাকত। ফুলকপি বা বাঁধাকপির সঙ্গে ল জুড়ে দিয়ে সাইন করত সে। সাইফুল আরটিশ উচ্চ মাধ্যমিক পাস। আবু কফিলের বাসনার কথা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন, ‘বাঁধাকফি ফুলকফি না বাঁধাকপি এবং ফুলকপি। তোর নাম কপিল না কফিল?’
আবু কফিল এই ঘটনায় খুবই মনঃক্ষুণ² হয়েছে। কিন্তু ওস্তাদ হলেন ওস্তাদ। কী বলবে?
সাইফুল আরটিশ থাকেন লম্বাহাটিতে। বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটা দূরত্ব। দোকান খুলে বসেন সাতটায়। মনিরের দোকানের এক কাপ চা খেয়ে কাজকর্ম শুরু করে দেন। আবু কফিল থাকে দিকপুরে। তাও এসে পড়ে সাড়ে সাতটা-পোনে আটটার মধ্যে। এসেই ওস্তাদের এবং নিজের নাশতা পানির ব্যবস্থা করে। বাসস্ট্যান্ডের কুমিল্লা হোটেল থেকে পরোটা ভাজি আর ডাল নিয়ে আসে। জগৎ সংসারে তারও যেমন কেউ নেই, ওস্তাদেরও তেমন কেউ নেই। ওস্তাদের বয়স এখন ঊনপঞ্চাশ। বিয়ে করেননি এবং করবেন না। আবু কফিলের বয়স এখন বাইশ। সেও বিয়ে করেনি এবং করবে না। ওস্তাদ মত বদলালে অবশ্য কথা ভিন্ন।
সাতটা বেজে গেছে দশ মিনিট আগে। সাইফুল আরটিশ দোকান খুলে বসেছেন। মনিরের দোকান থেকে চা দিয়ে গেছে। স্টোন দেওয়া চা। স্টোন দেওয়া চা হলো লিকার স্ট্রং করে দেওয়া চা। স্ট্রং হয়ে গেছে স্টোন। ধোঁয়া উড়ছে চায়ের কাপ থেকে। সাইফুল আরটিশ একটা চুমুক দিলেন আর আকাশের মেঘ ডাকল।
ভোররাত থেকেই মেঘ করে আছে আকাশে। সূর্য দেখা যায়নি এখনো। সারা দিনে দেখা যাবে কি না। আকাশের রং যা ধরেছে! মনে হচ্ছে আকাশে কেউ সুলেখা কালি ঢেলে দিয়েছে। এক দোয়াত না এক লক্ষ দোয়াত সুলেখা কালি ঢেলে দিয়েছে। এখনকার পোলাপান বলপেনে লিখে। সুলেখা কালির নামও হয়তো শোনেনি। সাইফুল আরটিশ একটা দৈনিক পত্রিকা রাখেন এবং কিছু কিছু বইপত্রও পড়েন। তেমন একটা বইতে পড়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং সুলেখা কালির বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন, এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।
কলঙ্ক কতটা কালো? কলঙ্কের চেয়েও কালো এখন আকাশ। যেকোনো মুহূর্তে ঝুম বৃষ্টি নামবে। ঠিকই আছে। আষাঢ় মাসের এক তারিখ আজ। জুবিলী স্কুলের পণ্ডিত স্যার বলতেন, আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবস। এই দিনে বৃষ্টি না হলে মান ইজ্জত থাকে আষাঢ়ের? নামুক অঝোরে। তবে আবু কফিল এসে যাক তারপর। হিসাবমতো সে এখন রাস্তায়। বৃষ্টিতে যদি পড়ে। জ্বরজারি যদি বাঁধায়। চিন্তার কথা। পিতৃমাতৃহীন এই ইয়াতিম ছেলেটাকে অত্যধিক স্নেহ করেন সাইফুল আরটিশ। তেরো বছর ধরে আছে তার সঙ্গে। সাইফুল আরটিশের ইচ্ছা আছে আর দশ বছর দোকানদারি করবেন। এরপর দেশান্তরি হবেন। টাকাপয়সা কিছু জমিয়েছেন, দশ বছরে আরও কিছু জমবে। সব নিয়ে বের হয়ে পড়বেন। আউপাতালি আনালে বিনালে ঘুরবেন। তার আগে আবু কফিলের একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবেন।
আবার মেঘ ডাকল। বিদ্যুৎ চমকাল। আকাশের একদিক থেকে একদিক। এখনই নামবে? আবু কফিল এর মধ্যে থানা রোড পার হয়ে যাওয়ার কথা। হিসাবে তাহলে তার আসতে আর পাঁচ-সাত মিনিট লাগবে।
চা শেষ করলেন সাইফুল আরটিশ। তার একটা মোবাইল ফোন আছে। খুব বেশি দামি সেট না। সাড়ে তের শ টাকা দিয়ে কিনেছেন। চিন্তা করলেন আবু কফিলকেও একটা সেট কিনে দেবেন। আজই দেবেন। তেইশ শ ছাব্বিশ টাকা কাল রেখে গেছেন ড্রয়ারে।
ফোন বাজল সাইফুল আরটিশের।
নাম্বার অচেনা।
মেঘ দেখতে দেখতে সাইফুল আরটিশ ধরলেন, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো এটা কি স্বপ্না লন্ড্রি?’
একটা মেয়ে।
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘জি না। এটা শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্প।’
লাইন কেটে দিল মেয়েটা।
স্বপ্না লন্ড্রি উকিলপাড়ায়। যোগেশ বাবুর লন্ড্রি।
আবার ফোন বাজল।
বিষয়টা কী?
আবার কে ফোন করল?
ধরবেন? সাইফুল আরটিশ ধরে বললেন, ‘হ্যালো।’
‘হ্যালো, এটা কি সিটি ফার্মেসি?’
সেই মেয়ে। সাইফুল আরটিশ আবার বললেন, ‘জি না। এটা শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্প।’
লাইন কেটে দিল মেয়েটা। সিটি ফার্মেসি বাজারের পয়েন্টে। অদ্ভুত ব্যাপার। আবার ফোন বাজল।
মেয়েটাই। এবার বলল, ‘হ্যালো এটা কি সোনিয়া ফটোস্ট্যাট?’
মানে কী? বারবার ভুল করছে মেয়েটা? নাকি ইয়ার্কি? ইয়ার্কি করছে কেউ? সাইফুল আরটিশ তবু ধৈর্যহারা হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, ‘জি না। এটা শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্প।’ বলে ফোন অফ করে দিলেন। মোবাইল ফোন যন্ত্রটা আজব। আরও আজব করে দিচ্ছে মানুষকে। রাত তিনটায় এক পাগলি একদিন ফোন করেছিল সাইফুল আরটিশকে। ফোন করে গান শুরু করে দিল,
আমার কানের দুল কই আমি জানি না
আমার নাকের ফুল কই আমি জানি না
একটু আগে সঙ্গে ছিল এখন দেখি নাই
খুব ক্ষুধা লেগেছিল খেয়ে ফেলেছি তাই...
আজব! ভাবলেন আর আবু কফিলকে দেখলেন সাইফুল আরটিশ। যাক, স্বস্তি। বৃষ্টিতে পায়নি ছেলেটাকে। নীল রঙের একটা ফুলহাতা শার্ট হাতা গুটিয়ে পরেছে আবু কফিল। কালো রঙের প্যান্ট। পায়ে সবুজ প্লাস্টিকের স্যান্ডেল।
‘আসসালামআলিকুম ওস্তাদ।’ আবু কফিল বলল।
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘ওয়ালিকুম সালাম। বৃষ্টি তো মনে হয় এখনই নামবে। ছাতা কই তোর?’
‘ছাতা দেখি কাল রাতে আপনি নিয়া গেলেন, ওস্তাদ।’
‘এহহে! আসার সময় মনে করতে পারি নাই। নাশতা আনতে একটু পরে যা তাইলে।’
‘কেন? আর কিছু কাজ আছে ওস্তাদ?’
‘আরে না, আকাশের অবস্থা দেখছিস? যেকোনো মুহূর্তে নামবে।’
‘সে আরও বারো মিনিট পরে ওস্তাদ!’
‘বারো মিনিট পরে মানে?’
‘বৃষ্টির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। টাকা দেন। নাশতা নিয়া আসি।’
বৃষ্টির সঙ্গে তার কথা হয়েছে। মাঝেমধ্যে এ রকম কিছু পাগলা-পাগলা কথা বলে আবু কফিল। ধরেন না সাইফুল আরটিশ। নাশতার টাকা দিলেন।
‘দৌড় দিয়া যাব আর দৌড় দিয়া আসব ওস্তাদ। নো চিন্তা ডু ফুর্তি।’
‘যা।’
দোকান থেকে বের হয়ে সত্যি দৌড় দিল আবু কফিল। সাইফুল আরটিশ অতিশয় স্নেহের সঙ্গে হাসলেন। কাজ শুরু করে দেবেন এখন। আট ফিট বাই চার ফিট একটা সাইনবোর্ডের কাজ ধরেছেন। অর্ধেকটা কাজ হয়ে গেছে এর মধ্যে। মইনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। নীল রঙের ওপর সাদা দিয়ে লিখছেন। রঙের পট, ব্রাশ, কেরোসিনের গেলাস নিলেন। অ্যানামেল পেইন্ট। কেরোসিন দিয়ে ব্রাশ ধুয়ে নিতে হয়। বিদ্যালয়ের য-ফলা মাত্র টানলেন এই সময় বিকট শব্দ হলো বাজের। আকাশজুড়ে বিদ্যুৎ চমকালো। এবং প্রথম বৃষ্টি নামল আষাঢ়ের। উথালপাতাল বৃষ্টি। অন্ধকার হয়ে এল আশপাশ। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে হলো সাইফুল আরটিশকে। বৃষ্টি কী বৃষ্টি! শিল পড়ছে নাকি? হ্যাঁ পড়ছে। দৌড়ে যাবে আর দৌড়ে আসবে। আবু কফিল আটকা পড়ে গেছে কুমিল্লায়। ঘন ঘন বাজ আর বিদ্যুৎ। আর বৃষ্টি! আর বৃষ্টি!
ঝাঁপ নামিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সাইফুল আরটিশ। কারেন্ট চলে গেল। এই এক যন্ত্রণা। অল্প ঝড় বৃষ্টিতেই কারেন্ট চলে যায়। তবে মোমবাতি আছে ড্রয়ারে। একটা বের করে ধরালেন। মোমের শিখায় তার ছায়া একটা বিরাট রূপ নিয়ে দেয়ালে পড়ল।
মনে হচ্ছে যেন রাত হয়ে গেছে।
বৃষ্টি কী আজ সারা দিন হবে? গত বছর হয়নি। এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি আষাঢ়ের প্রথম তেরো দিন। মামনপুরে ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। দেখতে গিয়েছিলেন সাইফুল আরটিশ। গীত বাদ্য সহকারে বিয়ে। বৃষ্টি নেমেছিল বিয়ের দিন রাতেই। কত আজব ঘটনা যে ঘটে দুনিয়ায়।
‘ওস্তাদ! ওস্তাদ!’
ঝাঁপ সামান্য ওঠাতেই অনেক বৃষ্টির ফোঁটা ঢুকে পড়ল দোকানে। ভিজে গেলেন সাইফুল আরটিশ। মোমবাতি নিভে গেল এবং আবু কফিল দোকানে ঢুকল।
‘মোমবাতি ধরান ওস্তাদ।’
সাইফুল আরটিশ আবার মোমবাতি ধরালেন। আবু কফিল পরোটা আর ডালভাজির ঠোঙা টেবিলে রাখল। পেপার বিছাল। এতক্ষণে আবু কফিলকে দেখে সামান্য বিস্মিত হলেন সাইফুল আরটিশ। আবু কফিল ভেজেনি। এক ফোঁটা বৃষ্টি তার চোখে-মুখে দেখা গেল না। কাপড়-চোপড়ে দেখা গেল না। সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘তুই দেখি ভিজিস নাই।’
আবু কফিল বলল, ‘জি, ওস্তাদ।’
‘এক ফোঁটা বৃষ্টিও তোর গায়ে লাগে নাই?’
‘জি না, ওস্তাদ।’
‘কী করে? কেউ ছাতা নিয়ে এগিয়ে দিয়ে গেছে!’
‘না, ওস্তাদ। বৃষ্টির মধ্যে হেঁটেই আসছি।’
‘অ।’
সাইফুল আরটিশ অবিশ্বাস করলেন না, কারণ আবু কফিল মিথ্যা কথা বলে না। কখনো বলে না। এটা পরীক্ষিত সত্য। কোনো কারণে সে বৃষ্টিতে ভেজেনি। কিন্তু সে নীল রঙের একটা ফুল হাতা শার্ট পরে ছিল না? লাল রঙের এই শার্ট কখন পরল? শিমুল ফুলের মতো লাল রং। মোমবাতির আলোতেও কেমন ঝিকোচ্ছে।
‘তুই একটা নীল শার্ট পরেছিলি না?’
‘জি, ওস্তাদ।’
‘এই শার্ট আবার কখন পরলি?’
‘নীল শার্টটাই লাল হয়ে গেছে, ওস্তাদ।’
আজগুবি কথা। তাও সাইফুল আরটিশ অবিশ্বাস করলেন না। আবু কফিলকে চেনেন বলে করলেন না। যাক নাশতা পানি করা যাক আগে।
আবু কফিল আয়োজন করল।
বৃষ্টি অল্প ধরে আবার বাড়ল। বজ্র বিদ্যুৎ ভর্তি একটা খাতা খুলে দিল যেন আকাশ। এক বৃষ্টিতেই ঢল নেমে যাবে দেখি নদীতে। নালা ডোবায় মাছ ধরতে নিশ্চয় ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছেলেপুলের দল।
নাশতা শেষ করে বসে বসেই পানির জগটা নিল আবু কফিল। রঙের আলমারির পাশের টুলে থাকে জগটা। টেবিল থেকে ছোট টুলটা হাত চারেকের কম দূরে হবে না। আবু কফিল কী করে নিল? হাত লম্বা করে নিল। ভুল দেখেছেন নাকি সাইফুল আরটিশ? নাহ। এই তো বসে আছে আবু কফিল। এই তো তার সামনে পানির জগটা। বিষয় কী? কী হয়েছে ইয়াতিম ছেলেটার?
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘আবু কফিল?’
‘জি, ওস্তাদ।’
‘তোর কী হয়েছে, বাবা?’
‘কী হবে ওস্তাদ? কিছু হয় নাই। চা দিতে বলব মনিরকে!’
‘বল। বাদ দে, আমি ফোন দিয়া বলি।’
‘অযথা দুইটা টাকা খরচ করবেন, ওস্তাদ?’
বাজ পড়ল। বিদ্যুতের নীল আলো মনে হলো ঢুকে পড়ল শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্পেও। বৃষ্টির জোর আরও বাড়ল। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের বর্ষণ। এবারও কি ভিজবে না আবু কফিল? বের হয়ে গেছে ঝাঁপ একটু ফাঁক করে। একটুতেই আবার অনেকটুকু ভিজে গেছেন সাইফুল আরটিশ। মোমবাতি নিভতে নিভতে নেভেনি।
এখন প্রশ্ন হলো তিনটা।
এক. আবু কফিল ভিজল না কেন?
দুই. নীল শার্ট কী করে লাল হয়ে গেল?
তিন. জগের ঘটনাটা!
এসব সম্ভব?
সাইফুল আরটিশের একজন জ্ঞানী বন্ধু আছেন। কলেজের অধ্যাপক। জুবিলী স্কুলের ক্লাসমেট এবং এখনো তাঁদের বন্ধুত্ব অটুট। প্রায় বিকেলে শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্পে বসে আড্ডা দিতে দেখা যায় অধ্যাপক সাহেবকে। তাঁকে ফোন করে বলবেন নাকি? ফোন খুলতেই ফোন বাজল।
সাইফুল আরটিশ ধরলেন, ‘হ্যালো।’
‘সালামওয়ালিকুম। এটা কি শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্প।’
সেই মেয়েটা!
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘জি।’
‘সাইফুল আরটিশ আংকেল কি আছেন?’
না। এ সেই মেয়ে না।
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘জি, বলছি। আপনি কে বলছেন?’
মেয়েটা বলল, ‘অংকেল আমি রুশনা। দিকপুরের জলিল মাস্টারের মেয়ে।’
দিকপুরের জলিল মাস্টার। এই মানুষটাই আশ্রয় দিয়েছেন ইয়াতিম আবু কফিলকে। তাঁর মেয়ে ফোন করেছে। কী হয়েছে? সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘মাস্টার সাহেবকে আমার সালাম দিয়ো, বেটি।’
‘জি, আংকেল।’
‘এখন বল ফোন কেন করেছ?’
‘আংকেল, কফিল ভাইয়ের তো খুব জ্বর। উথালপাতাল জ্বর।’ দুনিয়ার উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল রুশনা।
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘কফিলের জ্বর?’
‘জি, আংকেল! কাল রাত থেকে। কাল রাতেই কফিল ভাই আপনাকে ফোন করতে বলেছিল। সকালে দেখি জ্বর আরও বেড়েছে।’
মানে কী? মানে কী?
ফোন রেখে অধ্যাপক সাহেব না, সাইফুল আরটিশ প্রথম কল দিলেন মনিরকে, ‘মনির, কফিল তোর এখানে?’
‘কফিল ভাই। না তো।’
কুমিল্লা হোটেলের ম্যানেজার মুস্তফা। দূর সম্পর্কের ভাই হয় সাইফুল আরটিশের। তার ফোন নাম্বার ফোনে নেই কিন্তু কুমিল্লা হোটেলের কার্ড আছে। টেবিলের কাচের নিচে। দেখে কল দিলেন সাইফুল আরটিশ। একবারেই মুস্তফা ধরল, ‘সালাম আলিকুম, ভাইসাহেব।’
‘ওয়ালিকুম সালাম। তুই কখন থেকে ক্যাশে?’
‘ছয়টা থেকে, ভাই সাহেব। কেন? কিছু হয়েছে?’
‘তেমন কিছু না। কফিলকে দেখেছিস নাকি?’
‘না, সে তো আজ আসেনি ভাইসাহেব। আপনার কি নাশতা পানি এখনো হয় নাই? পাঠিয়ে দেব?’
‘আরে না।’
এতসব কী ঘটল তাহলে?
নাশতার খালি ঠোঙা এই যে পড়ে আছে এখনো। জগটা টেবিলে। দশ টাকা দামের মোমবাতি জ্বলে জ্বলে এর মধ্যে অর্ধেক হয়ে গেছে। বৃষ্টি তবে কতক্ষণ ধরে হচ্ছে? ধরবে না?
ধরল।
দোকানের ঝাঁপ খুললেন সাইফুল আরটিশ। মনিরকে ডেকে আরেক কাপ চা দিতে বললেন। আকাশ সেই কালো হয়ে আছে এখনো। মনিরের দোকানে কারেন্টের লাইন নেই, হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। বৃষ্টির পর কাস্টমারও হয়েছে কয়েকজন।
ইলেকট্রিসিটি ফিরল।
চা নিয়ে এল মনির। এই সময় আজান হলো মসজিদে। এই সময় আবার কিসের আজান? জোহরের? পৌনে একটা বেজে গেছে নাকি? তা তো হওয়ার কথা না।
চায়ের কাপ পিরিচ টেবিলে রেখে মনির বলল, ‘বৃষ্টির দিন কী করে যায় দেখলেন, ওস্তাদ। এশার আজান দিয়া দিল।’
সাইফুল আরটিশ বললেন, ‘এশার আজান!’
মনির বলল, ‘এশার আজান না? পৌনে আটটা বাজে।’
‘পৌনে আটটা বাজে!’
এখন রাত পৌনে আটটা বাজে? শিল্পী আর্ট অ্যান্ড রাবারস্ট্যাম্পের দরজার ওপরে একটা দেয়ালঘড়ি আছে। পাঁচ ছয় মিনিট স্লো ঘড়িটা। সাতটা বেয়াল্লিশ বাজে! মোবাইল ফোনের ঘড়িতে? সাতটা আটচল্লিশ বাজে!
বৃষ্টি ধরেছিল কিছুক্ষণের জন্য। বজ্র-বিদ্যুৎসহ আবার আকাশ উজাড় করে নামল।
অলংকরণ: মামুন হোসাইন