ইঁপরার ডায়েরি

বসার ঘরে টিকটিকিপু টিক টিক করে ডেকে ওঠার আগেই সেদিন আমার ঘুম ভেঙে গেল। কানে এল কুঠুরির বাইরে থেকে আসা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, নানা বয়সী মানুষের আনন্দোল্লাস। পেঁয়াজের খোসার চাদরটা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, মামণি-বাবাই, শিপরাসহ সবাই দেয়ালে কান পেতে কী হচ্ছে তা শোনার চেষ্টা করছে। দেখলাম পিপোর্টার চাচা হন্তদন্ত হয়ে কুঠুরিতে ঢুকলেন। খবর সংগ্রহই ওনার কাজ। তিনি বাদামের খোসার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ সাধু ভাষায় বললেন,

‘উপস্থিত পিঁপড়াবৃন্দ, আমরা যে বাড়ির কুঠুরিতে বাস করিতেছি, তাহার মালিকের বড় কন্যা, টয়া খান অদ্য প্রভাত পাঁচটা ৪৩ মিনিটে ধরণির সর্বোচ্চ চড়ায় আরোহণ করেছেন।’

পিপোর্টার চাচার সংবাদ পরিবেশন শেষ হওয়ামাত্র সবাই খুশিতে হাততালি দিতে লাগল। হাততালি আমিও দিলাম কিন্তু মামণি-বাবাইয়ের বড় মেয়ে হয়েও এখনো পাহাড় দেখতে না পারার আফসোসটা ঠিকই রয়ে গেল।

বিকেলে তাই খেলতে না গিয়ে পিপোর্টার চাচার কাছে গেলাম। চাচা খানিকটা বদমেজাজি বলে অনেকে তাঁকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু জীবন বাজি রেখে খবরের পেছনে ছুটতে থাকা চাচাকে আমার ভীষণ পছন্দ। ওনার কাছেই শুনলাম মেয়েটি যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছে তার নাম এভারেস্ট। মেয়েটি নাকি সঙ্গে করে একটা ছোট আকারের পাহাড় নিয়ে এসেছে। রেপ্লিকা নামের সেই পাহাড়টা নাকি বসার ঘরেই আছে। তখনই আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম পাহাড়টা আমি দেখবই।

পরদিন ভোরে সবার ঘুম ভাঙার আগে আমি কুঠুরি থেকে বের হলাম। এক শ ত্রিশ পা হেঁটে সোফার পায়ের কাছে আসামাত্রই দেখতে পেলাম সাদা রঙের বিশাল এক পাহাড়!  আরেকটু কাছে এগোতে গিয়ে দেখি ডাইনিমুখো ঝিটা ঝাড়ু নিয়ে এদিকেই আসছে। কোনোমতে আমি পালিয়ে বাঁচলাম। এর পরের দুই দিন পাহাড়-জয়ী মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পিপোর্টার চাচার মতো অনেক সাংবাদিক এলেন। আমি দেয়ালে কান পেতে মেয়েটার পাহাড়ে ওঠার গল্প শুনতে শুনতে অবশেষে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম।

মামণি-বাবাই কিছুতেই এটা মানবে না, তাই কাউকে কিছু না বলেই একদিন ভোররাতে আমি কুঠুরি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে ছিল শুধু আমার পেঁয়াজের খোসার ব্যাগ, যাতে কয়েকটা কাঠি, অল্প কিছু মিষ্টি আর রসুনের খোসার তাঁবু ছাড়া কিছুই নেই। প্রথমেই আমাকে দ্রুত এক শ ত্রিশ পা গিয়ে সোফার পায়ের কাছে লুকাতে হতো। কারণ, ওখানে পৌঁছানোর আগে কেউ দেখে ফেললে লুকানো অসম্ভব। ছুটতে ছুটতে আমি যখন সোফার পায়ে গিয়ে লুকিয়েছি ঠিক তখনই আবার সেই ডাইনিমুখো ঝিটা ঝাড়ু দিতে এল। আমি তাড়াতাড়ি সোফার পা বেয়ে উঠে স্ক্রুর খাঁজে লুকালাম। রাত পর্যন্ত বসার ঘরে অনেক মানুষ ছিল, তাই বেরোতে পারিনি। দুবার তো মামণি, বাবাই, পিপোর্টার চাচা আমাকে খুঁজতেও এসেছিল, তবে পায়নি। দূর থেকে মামণির মুখটা দেখে অবশ্য একটু মন খারাপ হয়েছিল।

রাতে সব ঘরের বাতি নেভার পর আমি বের হলাম। বারান্দার আলো খানিকটা এ ঘরে আসছিল বলে আশপাশটা মোটামুটি দেখতে পেলাম। প্রায় এক শ পা হেঁটে আমি যখন টেবিলটার কাছাকাছি এসেছি, তখনই টেবিলের ওপর থেকে একটা লাল রঙের যন্ত্র ভয়ানক শব্দ করে উঠল। টয়া এসে ওটা উঠিয়ে কয়েকটা কথা না বলা পর্যন্ত বিশ্রী যন্ত্রটা থামলই না। একটু পর আমি টেবিলের পা বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠলাম, আবার এক নজর দেখতে পেলাম পাহাড়টাকে। আবছা আলোয়ও ওটা কী ভীষণ সুন্দর!

ভোর হওয়ার আগেই টেবিলের একটা স্ক্রুর খাঁজে আমাকে লুকিয়ে পড়তে হলো। একটু মিষ্টি খেয়ে সেখানেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল টয়ার কথার শব্দে। জেগে দেখি সে এক সাংবাদিককে পাহাড়ে তুষারঝড়ে পড়ার গল্প বলছে। মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনলাম আমিও।

সেদিন রাতে আর আমি বাতি নেভার অপেক্ষা করিনি। ঘরটা ফাঁকা হতেই বেরিয়ে পড়লাম। টেবিলের ওপরের অংশে উঠে আমি যখন প্রথমবারের মতো পাহাড়টাকে অত কাছে থেকে দেখছি, তখনই খেয়াল করলাম ঝিটা এদিকেই আসছে। তার হাতে একটা কাপড় আর নীল রঙের তরলে ভর্তি বোতল। কেউ আমাকে বলে দেয়নি তবু আমি ঠিক বুঝতে পারলাম ওটা ভয়ানক খারাপ কিছু। দ্রুত ছুটে পালাতে গেলাম কিন্তু ঝিটা কাপড়টা রাখল ঠিক আমার ওপরেই। কাপড়ের ভাঁজের অন্ধকারে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বেশ খানিক্ষণ পর ঝিটা কাপড় হাতে নিয়ে টেবিলটাকে জোরে ঘষে ঘষে মুছতে লাগল। আর আমি কোনোমতে কাপড়ের একটা কোনা ধরে ঝুলে রইলাম। কয়েকবার ঝির মোটা আঙুলের নিচে পড়ে পড়ে যখন আমি ব্যথায় প্রায় মরেই যাচ্ছি, তখনই সে পাহাড়টা মুছতে শুরু করল। সুযোগ বুঝে আমিও পাহাড়ের মাঝামাঝি এক জায়গায় নেমে পড়লাম। তখনো ঝি পাহাড়টা মুছেই চলেছে তাই দ্রুত রসুনের খোসার তাঁবু দিয়ে আমি নিজেকে ঢেকে নিলাম। ভাগ্য ভালো থাকায় আর সাদা রঙের পাহাড়ে রসুনের খোসা প্রায় মিশে থাকায় সে যাত্রায় আমি বেঁচেই গেলাম।

রাত আরেকটু গভীর হলে আগের রাতের মতো সব বাতি নিভে গেল। বারান্দা থেকে আসা আবছা আলোয় শুরু হলো পাহাড়ের গায়ে আমার যাত্রা। বেশ বুঝতে পারছিলাম তিন শ পা না গেলে চূড়ায় ওঠা যাবে না। অর্থাৎ আরও দুই রাত পর হয়তো আমি চূড়ায় পৌঁছাব, আরও দুই দিন আমাকে ঝুঁকি নিয়ে রসুনের খোসার আড়ালে কাটাতে হবে। কাঠিতে ভর দিয়ে পরের দুই রাত সাবধানে অনেকটা পথ উঠলাম। দিনের বেলায়ও বেশ নিরাপদেই লুকিয়ে ছিলাম। চূড়ায় উঠতে যখন আমাকে আর মাত্র পা দশেক যেতে হবে তখনই বাধল বিপত্তি। কোথা থেকে যেন একটা ধাড়ি ইঁদুর এসে আমাকে মাড়িয়ে চলে গেল। প্রচণ্ড ব্যথায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু সেখানে আমার চিৎকার শোনার কেউ ছিল না। প্রথমবারের মতো আমার বাড়ির জন্য, মামণির জন্য, বাবাইয়ের জন্য, শিপরার জন্য ভীষণ মন খারাপ হলো। হাঁটতে গিয়ে বুঝলাম আমার একটা পা মচকে গেছে। সে দিনের মতো ওখানেই রসুনের খোসার নিচে লুকোতে হলো আমাকে। কিন্তু এবার আমার খুব ভয় করছিল। কারণ, অনেক দিন ব্যবহার করায় খোসাটা নোংড়া হয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ের সাদার মধ্যে যে ওটা সহজেই চোখে পড়বে!

আমার আশঙ্কাটাই সত্যি হলো। সকালে টয়া এসে পাহাড়ের পাশের সোফায় বসেই খোসাটা দেখতে পেল। আলতো হাতে সে ওটা সরানো মাত্র আমি বুঝলাম আমি হেরে গেছি। এখন সে আমাকে মেরে ফেলবে বা ঝেড়ে নিচে ফেলে দেবে। আমার আর পাহাড় জয় করা হবে না।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে টয়া বলে উঠল, পিঁপড়া যায় মিষ্টির খোঁজে, পাহাড়ে কেন? একেবারে অভিযাত্রীর মতো যেন পাহাড় জয় করতে এসেছে! বাহ্‌!"

ওর কথা শুনে আমি সাহস ফিরে পেলাম। ব্যথা ভুলে চূড়ার দিকে ছুটলাম। টয়া আমার দিকে তখনো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এভারেস্টজয়ী বাঙালি কন্যার চোখের সামনে আমি ইঁপরা নামের পিঁপড়া অবশেষে এভারেস্টের রেপ্লিকা জয় করলাম। চূড়ায় উঠে আমি যখন টয়াকে ধন্যবাদ বলেছি, তা হয়তো সে শোনেনি, তবে তার বলা অভিনন্দন কথাটা শুনে আমি যেন আমার পিঁপড়াজীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা পেয়ে গেলাম।

ইঁপরা নামের পিঁপড়ার পাহাড় জয়ের এই কাহিনি আমি পড়েছিলাম একটা ডায়েরিতে। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে একটা পিঁপড়ার গর্ত দেখার সময় ওটা প্রথম আমার চোখে পড়ে। ডায়েরির লেখাগুলো এত ছোট ছিল যে সেটা পড়তে হয়েছিল ফেমটোস্কোপ দিয়ে।

একত্রিংশ শতাব্দীর নামকরা বিজ্ঞানী হয়েও আমি তখন কিছু কারণে প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত। একবিংশ শতাব্দীর এক সাধারণ কিন্তু অসীম সাহসী পিঁপড়ার জয়ের কাহিনিই আমাকে দিয়েছিল প্রেরণার স্পর্শ।

অলংকরণ: তুলি