জলদানব রহস্য

এক

 বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিল কিশোর পাশা। বাতাসের ঝাপটায় উড়ে যাচ্ছিল মাথার ক্যাপটা, থাবা দিয়ে ধরে ফেলল। কোঁকড়া কালো চুলের ওপর চেপে বসাল, যাতে আর না খোলে। রাস্তার দুই ধারের ঘন বনের দিকে তাকিয়ে করল প্রশ্নটা, ‘কোথায় যে যাচ্ছি?’

‘মনস্টার উড!’ বই থেকে মুখ তুলল পাশে বসা কিশোরের বন্ধু রবিন।

‘সে তো জানিই।’

‘তাহলে জিজ্ঞেস করছ কেন?’

‘ছুটিটাই মাটি হবে কি না বুঝতে পারছি না।’

‘মাটি হবে কেন?’

‘যদি কোনো রহস্য না পাই?’

কিশোরের দেখাদেখি বাসের জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিল ওর সামনের সিটে বসা ওদের আরেক বন্ধু মুসা আমান। বলল, ‘শুনেছি মনস্টার উডের লেকটা নাকি ভালো না। প্রচুর বদনাম। ওই লেকের পানির নিচে দানবের বাসা।’

‘ওসব ফালতু কথা,’ জবাব দিল ওর পাশে বসা খালাতো বোন ফারিহা।

‘কিছুই যদি না থাকবে, তাহলে মনস্টার লেক নাম দিল কেন?’

‘বহুকাল আগে হয়তো দানব ছিল ওই লেকে,’ জবাব দিল রবিন।

‘উঁহু, তা না,’ কিশোর বলল। ‘বনের নাম যেহেতু মনস্টার উড, তাই লেকটাকে মনস্টার লেক বলে।’

‘তাহলে বনের নামই বা মনস্টার উড হলো কেন? নিশ্চয় দৈত্য-দানব ছিল...’ কথাটা শেষ না হতেই চিৎকার করে উঠল মুসা, ‘ওই যে এসে গেছে! মনস্টার উড! উহ্‌, বাঁচলাম! যে ঝাঁকির ঝাঁকি, পেটে ব্যথা হয়ে গেছে আমার।’

বই দিয়ে ওর মাথায় বাড়ি মারল রবিন। ‘এত খেলে ব্যথা তো হবেই। এতগুলো চকলেট মিল্ক খেতে মানা করেছিলাম না? পেটের মধ্যে গিয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে এখন বদহজম হয়ে গেছে।’

‘দূর, বদহজম না ছাই! ব্যথা হয়েছে আসলে ঝাঁকিতে।’ ঠোঁট উল্টাল মুসা।

কিশোর তাকিয়ে আছে নতুন একটা পাথরের সাইনবোর্ডের দিকে। তাতে ইংরেজিতে লেখা কথাগুলোর মানে করলে দাঁড়ায়:  মনস্টার উডে স্বাগতম।এখানকার বন ও লেক উদ্ভিদসহ সব ধরনের বুনো প্রাণীর নিশ্চিন্ত আবাসস্থল।

‘তার মানে এটা একটা অভয়ারণ্যও বটে,’ রবিন বলল।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মুসা, এমন সময় বেজে উঠল বাঁশি।

দুই কানে আঙুল দিয়ে ফেলল ফারিহা। ‘কিসের শব্দ?’

‘ব্যাগপাইপ!’ জবাব দিল রবিন।

একবার বেজেই থেমে গেল বাঁশি।

‘ব্যাগপাইপ!’ বিড়বিড় করল মুসা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো ধরনের পাখি নাকি?’

‘এ জন্যই তো বলি বই পড়ো, বই পড়ো,’ রবিন বলল। ‘অনেক কিছু জানতে পারবে। ব্যাগপাইপ কোনো পাখি না। স্কটল্যান্ডের একধরনের বাদ্যযন্ত্র। মিউজিক ক্লাসেও তো ফাঁকি দাও। জানবে কী করে।’

‘অত জানার দরকারও নেই আমার। কিন্তু এই বিজন বনে স্কটল্যান্ডের ব্যাগপাইপ বাজায় কে? বাঁশের বাঁশি হলেও নাহয় এক কথা ছিল।’

জানালা দিয়ে হাত বের করে দেখাল কিশোর। রোগা-পাতলা ফ্যাকাসে চেহারার এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে ওয়েট সুট, মুখে মাস্ক, পায়ে ফ্লিপার। কাঁধে ঝুলছে একটা ব্যাগপাইপ।

‘উনি বাজিয়েছেন’, কিশোর বলল। ‘ওই মহিলা।’

 দুই

 বাস থামল।

অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইল রবিন।

বাসের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন বিচিত্র চেহারার একজন মানুষ। দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ। সারা গায়ে বড় বড় লোম, ভালুকের মতো।

‘এই যে শহুরে পোকার দল, মনস্টার উডে স্বাগতম,’ বিকট স্বরে বললেন তিনি। মনে হলো যেন গর্জন করে উঠেছে একটা ষাঁড়। ‘এই ক্যাম্পের আমি পরিচালক। আমার নাম মিস্টার উলফ। কে কত নম্বর ঘরে থাকবে, সেটা পরে বলছি। তার আগে তোমাদের সুইমিং ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে পরিচিত হও। তোমাদের সাঁতার শেখানোর শিক্ষক। এই ক্যাম্পে তিনি নতুন।’

‘সাঁতার!’ রবিন বলল, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে? মাথা খারাপ নাকি! পানিতে নামলেই তো বরফ হয়ে যাব।’

‘কথার মাঝে কথা বোলো না,’ গর্জে উঠলেন মিস্টার উলফ। পাশে দাঁড়ানো মহিলাকে দেখিয়ে হেসে বললেন, ‘ইনি মিস নিসারিন অ্যান্ডারসন। ডাকনাম নেসি। আমাদের বিশেষ মেহমান। স্কটল্যান্ডে ছিলেন এতকাল। কিছুদিন আগে আমেরিকায় এসেছেন। মুখে স্নরকেল লাগিয়ে কীভাবে সাঁতার কাটতে হয় তোমাদের শেখাতে চান। নিজে থেকেই শেখানোর আগ্রহ দেখিয়েছেন।’

‘দারুণ!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘স্নরকেল পরে সাঁতার শেখার আমার অনেক দিনের শখ।’

তার সঙ্গে সুর মেলাল আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে।

‘এ জন্যই আমি আসতে চাইনি। ছুটিটা বাড়িতেই কাটাতে চেয়েছিলাম।’ গজগজ করতে লাগল রবিন। মিস্টার উলফ চোখ গরম করে তাকাতেই চুপ হয়ে গেল সে।

মিস নেসির বাহুতে আলতো চাপড় দিলেন মিস্টার উলফ। তাঁকে বক্তব্য রাখার ইঙ্গিত করলেন।

ছোটখাটো একটা ভাষণের অপেক্ষা করতে লাগল ছেলেমেয়েরা। সবগুলো চোখ মিস নেসির ওপর। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে রইলেন তিনি। লম্বা ছিপছিপে দেহ। এতটাই রোগা-পাতলা, কিশোরের মনে হলো জোরে চাপ দিলেই মট করে ভেঙে যাবেন পাটকাঠির মতো। ফ্যাকাসে চেহারা। চামড়ার রং মোমের মতো। যেন কোনোকালে সূর্যের মুখ দেখে না। সরু ঘাড়টা দেখে মনে হয় যেন মাথা ধরে টান দিয়ে অস্বাভাবিক লম্বা করে দেওয়া হয়েছে। পরনে কালো রঙের সাঁতারের পোশাক। হাতে ব্যাগপাইপ। ব্যাগপাইপের ওপর আঙুল বোলাচ্ছেন অস্থির ভঙ্গিতে।

‘মনস্টার লেকে স্বাগতম! সুস্বাগতম, বয়েজ অ্যান্ড গার্লস!’ মোলায়েম কাঁপা কাঁপা সুরেলা কণ্ঠে অবশেষে শুরু করলেন তিনি, যেন গান গাইছেন। ‘আমি তোমাদের গভীরতার সৌন্দর্য শেখাব। শেখাতে পারলে খুশি হব। তোমাদের সঙ্গে সাঁতার কাটার আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।’

মিস নেসির দিকে তাকিয়ে হাসলেন মিস্টার উলফ। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন। ‘কেবিন অ্যাসাইনমেন্ট কী হবে শোনো এবার। একবারের বেশি বলব না। সুতরাং মনোযোগ দিয়ে শুনবে। বুঝেছ?’

মাথা ঝাঁকিয়ে কিংবা কাত করে জবাব দিল বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে। কিশোর কিছুই বলল না। চুপ করে তাকিয়ে রইল।

কী করতে হবে দ্রুত বুঝিয়ে দিতে লাগলেন মিস্টার উলফ। এক নম্বর বাড়ির ঘরগুলোতে থাকবে মুসা, ফারিহা আর আরও ছয়জন ছেলেমেয়ে। কিশোর, রবিন আর বাকি সাতজন ছেলেমেয়ে থাকবে চার নম্বরে।

‘জিনিসপত্র যার যার ঘরে রেখে এসে ডকে দেখা করো আমার সঙ্গে,’ গর্জন করে আদেশ দিলেন মিস্টার উলফ।

ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে কেবিনের দিকে ছুটতে শুরু করল ছেলেমেয়েরা।

‘স্নরকেলিং শেখার জন্য তর সইছে না আমার,’ বন্ধুদের বলল মুসা।

‘আমার ভয় লাগছে,’ ফুঁপিয়ে উঠে বলল ফারিহা।

চোখ উল্টে দিল রবিন। ‘টেরটা তো পাবে পানিতে নামার পর। ঠান্ডা যখন জমিয়ে দেবে শরীর। ফ্রিজের বরফ বানিয়ে ছাড়বে।’

হেসে উঠল মুসা। পিঠে ঝোলানো ব্যাকপ্যাকটা সোজা করল। ‘আবহাওয়া ঠান্ডা না গরম বোঝার ক্ষমতাই নেই মিস্টার উলফের।’

‘কী করে বুঝলে?’ রবিন জিজ্ঞেস করল।

‘এমনি।’

‘এমনি কিছু বোঝা যায় না।’

‘যায়, যায়।’

‘দূর, থামো তো!’ ধমকে উঠল কিশোর। ‘অকারণে কথা বলা। বনটা দেখতে দাও।’

সুন্দর ছিমছাম বনের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে হাত তুলে দেখাল রবিন। ‘ওই যে আমাদের ঘর।’

কাঠ, বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরি কয়েকটা লম্বা লম্বা ছাউনি। লাল ও সাদা রং করা। নম্বর দিয়ে ঘরগুলোকে আলাদা করা হয়েছে।

বাথরুমের কথায় যেন বাথরুমে যাওয়ার কথা মনে পড়ল মুসার। কিংবা অতিরিক্ত মিল্কশেক খেয়ে পেটের সর্বনাশ করে ফেলেছে। ব্যাগটা ছোট বোনের জিম্মায় দিয়ে বলল, ‘এটা দেখো। আমি বাথরুমে যাচ্ছি।’ দৌড়ে চলে গেল সে।

হাসল ফারিহা। মুসার দিকে তাকাল। ‘মনে হচ্ছে ভালোই কাটাব এখানে একটা হপ্তা। ছুটিটা মজার হবে।’

‘মজা না বিরক্তি বোঝা যাচ্ছে না এখনো!’ রবিন বলল।

‘মজাই লাগবে!’ মাথা দুলিয়ে বলল কিশোর। ‘প্রকৃতির মাঝে এসে কারও খারাপ লাগে না।’

তিন

 দল বেঁধে ডকে পৌঁছাল ছেলেমেয়েরা। আগেই এসে বসে আছেন মিস নেসি। পানির প্রায় তিন ফুট ওপরে কাঠের মঞ্চটায় পা ঝুলিয়ে বসেছেন। ব্যাগপাইপটা পাশে হাতের কাছে রাখা। কালো রবারের সাঁতারের পোশাকে তাঁকে একটা রোগা সিল মাছের মতো লাগছে। চকচক করছে পোশাকটা। পায়ে পরেছেন লম্বা সবুজ ফ্লিপার। ব্যাঙের পায়ের মতো লাগছে ওগুলো। একটা ফ্লিপারের মাথা পানিতে ডুবে আছে।

‘দেখে তো মনে হচ্ছে সাগরের নিচ থেকে উঠে এসেছেন,’ হেসে বলল কিশোর। ‘সাগরের প্রাণী।’

‘আস্তে,’ ফারিহা বলল। ‘শুনে ফেলবেন। আমার কাছে তাঁকে কেমন নার্ভাস নার্ভাস লাগছে।’

‘মিস্টার উলফ আপনার সঙ্গে এখানে দেখা করতে বলেছেন আমাদের,’ মিস নেসির কাছে গিয়ে হেসে বলল মুসা।

ছোট্ট কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন মিস নেসি। ‘এসো এসো,’ সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে উঠলেন যেন তিনি। লেকটা দেখালেন। ‘সুন্দর এই পানির রাজ্যে সাঁতার কাটা শেখাব আমি তোমাদের।’

‘আমার কাছে মোটেও সুন্দর লাগছে না,’ নীরস গলায় জবাব দিল রবিন। ‘কেমন ঘোলাটে সবুজ হয়ে আছে। থাকার কথা ছিল নীল।’

লেকের পানির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন মিস নেসি, ‘ওপর থেকে পানির সৌন্দর্য অতটা বোঝা যায় না। কিন্তু নিচে অনেক সুন্দর। মনে হবে যেন লুকানো গুপ্তধন।’

‘গুপ্তধন পেলে তো ভালোই হতো,’ কিশোর বলল। ‘একবার একটা পাহাড়ের গোড়ায় সত্যি সত্যি গুপ্তধন পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ডাকাতদের লুকিয়ে রাখা সোনার মোহর। পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে নিচে এসে জমা হয়েছিল। ভূমিকম্প বা অন্য কোনো কারণে মাটিতে ধস নেমেছিল হয়তো।’ হাত তুলে দেখাল সে। ‘ওপারে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পুরোনো আমলে ওখানেও হয়তো ডাকাতের আস্তানা ছিল। আর ডাকাত মানেই সোনার মোহর। তাই না?’

মিস নেসি জবাব দিলেন, ‘কিন্তু লকের পানির নিচে মোহর থাকে না।’

‘ওপর থেকে গড়িয়ে পড়তে পারে।’

‘লক’ শব্দটা শুনে ফারিহা ভাবল উচ্চারণে ভুল করেছেন মিস নেসি। শুধরে দেওয়ার জন্য বলল, ‘লক, নাকি লেক?’

‘লক। স্কটল্যান্ডে লেককে ‘‘লক’’ বলে। বানান এল-ও-সি-এইচ।’

‘ও, তাই। জানতাম না,’ লজ্জা পেল ফারিহা।

আস্তে করে আরেকটা ফ্লিপার নামিয়ে দিলেন পানিতে। নিজেও পানিতে নেমে গেলেন এমন আলতোভাবে, সামান্যতম ঢেউও উঠল না। টুপ করে তলিয়ে গেলেন মাছের মতো নিঃশব্দে। একটু পরেই ছেলেমেয়েদের অবাক করে দিয়ে মঞ্চের উল্টো দিকে মাথা তুললেন। ‘লক মনস্টারের পানি আমার খুব পছন্দ। যেখান থেকে এসেছি সেখানকার পানি এত শান্ত, এত নিরাপদ নয়।’

‘আমিও নামব,’ গাল চুলকে আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর।

‘পানিতে নামার খুব আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তোমার?’ ভ্রু কুঁচকে তাকাল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ অস্বীকার করল না কিশোর। ‘ফারিহার সঙ্গে আমিও একমত। ওপারের পাহাড়টা রহস্যময় মনে হচ্ছে আমার কাছে। সত্যিই ওপর থেকে গড়িয়ে এসে লেকে পড়তে পারে মোহর। ডুব দিয়ে দেখি, কোথাও আছে কি না।’

‘এত তাড়া কিসের?’ পেছন থেকে গর্জন শোনা গেল। দাড়ি খামচাচ্ছেন মিস্টার উলফ। ‘সাঁতার কাটার কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেগুলো জানতে হবে। তার আগে নামবে না কেউ।’

গুঙিয়ে উঠল কিশোর। ‘ছুটিতে এসেও শাসন মানতে হবে নাকি? প্লিজ, স্যার, মজা করতে এসেছি, করতে দিন।’

মিস্টার উলফের দাড়ি খামচানো বেড়ে গেল। দম আটকে ফেলল মুসা। চোখ বুজে ফেলল ফারিহা। ভালুকদেহী মিস্টার উলফ খেপে গিয়ে কিশোরকে কী করে বসেন সেই ভয়ে। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে হেসে ফেললেন রোমশ ক্যাম্প ডিরেক্টর। তাঁর দাঁত দেখে মুসার মনে হলো নেকড়ের দাঁত। রোম খাড়া হয়ে গেল তার।

‘ঠিক আছে, করলাম না শাসন,’ মিস্টার উলফ বললেন। ‘যাও তো দেখি। দাও লাফ। মজাটা টের পেয়ে এসো।’

কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল কিশোর। ‘সাঁতার জানি না ভাবছেন?’ বলে ডকের কিনারে চলে গেল সে।

‘পানিটা আগে ছুঁয়েই দেখো,’ মিস্টার উলফ সাবধান করলেন।

‘কেন?’ কিশোর বলল। ‘কী হবে? তাহলে টিচার নামলেন কী করে?’ হাত তুলে মিস নেসিকে দেখাতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। নেই তিনি।

‘আরে!’ চিৎকার করে উঠল ফারিহা। ‘ম্যাডাম কোথায় গেলেন?’

‘এভাবে তো কাউকে সাঁতার কাটতে দেখিনি!’ ফিসফিস করে বলল মুসা। ‘একটু শব্দও হলো না।’

‘যারা পানিতে থাকতে জানে, তাদের জন্য শব্দ না করে সাঁতার কাটা কোনো ব্যাপারই না,’ রহস্যময় কণ্ঠে বলল রবিন।

‘ঠিক,’ গর্জে উঠলেন মিস্টার উলফ, ‘ঠিক এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছি আমি। পানিতে নামা শেখো আগে।’ কিশোরকে বললেন, ‘যাও। আঙুল ছোঁয়াও পানিতে। তাহলেই বুঝতে পারবে কেন নিষেধ করেছি।’

মঞ্চে বসে একটা পা বাড়িয়ে দিল কিশোর। পানিতে ডোবাল। পরক্ষণে অস্ফুট শব্দ করে একটানে তুলে নিয়ে এল পা’টা। ‘বাপ রে! কী ঠান্ডা! বরফও এমন না! মিস নেসি পারছেন কী করে?’

আবার হাসলেন মিস্টার উলফ। ‘তাহলেই বোঝো। এখন চুপ করে বসো। কী করে পারছেন, তাঁকেই জিজ্ঞেস করি। বুঝিয়ে দেবেন।’

কথাটা যেন পানির নিচ থেকেও কানে গেল মিস নেসির। নিঃশব্দে মাথা তুললেন।

লেকের ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটার বিদ্যেটা যখন ছেলেমেয়েদের শেখানো শেষ করলেন মিস নেসি, সূর্য তখন অনেক নিচে নেমে গেছে। তিনি শেখালেন, কীভাবে রবারের সুট পরে পানিতে নামলে গা গরম থাকে, কীভাবে ডুবে থেকেও স্নরকেল লাগিয়ে টিউবের মাধ্যমে পানিতে দম নেওয়া যায়। ‘ডাইভিংয়ের এসব কৌশল জানা থাকলে সাঁতার কাটার অনেক সুবিধে। ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ থাকতে পারবে। পানির জগৎটা চলে আসবে হাতের মুঠোয়। আর মজা? সেটা নামলেই বুঝবে। এত সব আজব আজব আর মজার জিনিস আছে নিচে।’

মনে হতেই যেন ‘মজার জিনিস’ দেখার লোভ সামলাতে না পেরে আবার পানিতে নেমে গেলেন মিস নেসি।

একটা মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরলেন মিস্টার উলফ। ‘হ্যাঁ, শোনো, এই ক্যাম্প কেন বানিয়েছি জানো? শুধু তোমাদের বেড়ানোর জন্য নয়। জায়গাটাকে জন্তু-জানোয়ারের অভয়াশ্রমও বানাতে চাই আমি। ছোট-বড় সব ধরনের প্রাণী নির্ভয়ে থাকবে এখানে। গাছেরাও এখানে নিরাপদ।’

‘কিন্তু জন্তু-জানোয়ার তো খুব একটা দেখছি না এখানে,’ জোসি নামের একটা মোটাসোটা ছেলে বলল।

দাড়ি খামচালেন আবার মিস্টার উলফ। ‘এখন নেই, তবে আসবে। সময় লাগবে। জন্তু-জানোয়ারেরা যখন বুঝে যাবে এখানে ওরা নিরাপদ, এলে আর তখন যেতে চাইবে না। ভিড় লেগে যাবে বনের মধ্যে, লেকের পানিতে, সবখানে।’

‘কোন ধরনের জানোয়ারের কথা বলছেন?’ জানতে চাইল ফারিহা।

‘সব ধরনের।’

‘যদি মায়া নেকড়েরা আসে? ওই যে দিনের বেলা যেসব ভূতেরা স্বাভাবিক নেকড়ে কিংবা মানুষের রূপ ধরে থাকে, চাঁদনি রাতে হয় ভয়ংকর পিশাচ, তারা?’ মুসার প্রশ্ন।

‘দূর, কিসের মধ্যে কী!’ বিরক্ত হলো কিশোর। ‘তোমার মাথায় ভূতপ্রেত ছাড়া আর কিছু ঘোরে না কেন বলো তো?’

হাত তুলে ওদের থামালেন মিস্টার উলফ। আগের কথাটা শেষ করলেন, ‘ডাঙার প্রাণীরা তো আসবেই। লেকে ঢোকানোর জায়গা করে দিতে পারলে গভীর জলের বাসিন্দারা আসতেও দ্বিধা করবে না, এমন করেই গড়ে তুলব আমি জায়গাটাকে।’

গভীর জলের বাসিন্দা! চমকে গেল মুসা। ঢোক গিলল। জলদানবের কথা ইঙ্গিত করেননি তো মিস্টার উলফ?

জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, ঝপাং করে শব্দ হলো পানিতে। লেকের একেবারে মাঝখানে। পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে সেদিকে তাকাল সে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল পানিতে ছড়িয়ে যাওয়া ঢেউগুলোর দিকে।

চার

 ‘কিসের শব্দ?’ চিৎকার করে উঠল ফারিহা।

শব্দটা মিস্টার উলফও শুনেছেন। লেকের দিকে তাকালেন তিনি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ফিরলেন আবার ছেলেমেয়েদের দিকে। হাসলেন। বাঘা সাইজের দাঁতগুলো দেখালেন। ‘ভয়ের কিছু নেই। পানির কোনো প্রাণী হবে। শিকার ধরছে। খাওয়ার জন্য।’

‘বড় মাছের কথা বলছেন, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।

‘মাছ কি পানির প্রাণী না?’ রহস্য করে কথা বললেন মিস্টার উলফ। ‘ওহ্‌ হো, আমাদেরও তো খাওয়া হয়নি। সবাই চলে এসো ডাইনিং হলে। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে।’

আরেকবার লেকের দিকে ফিরে তাকালেন মিস্টার উলফ। তারপর গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন কেবিনগুলোর দিকে। পিছে পিছে চলল ছেলেমেয়েরা।

‘চলো,’ ফারিহা বলল। ‘আমার খিদে পেয়েছে।’

খপ করে তার হাত চেপে ধরল মুসা। ‘দাঁড়াও। কথা আছে। অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হচ্ছে আমার।’

‘পেটের মধ্যে তো? খিদে পেলে হয় এ রকম,’ হেসে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ‘একে বলে হাঙ্গার পেইন, অর্থাৎ ক্ষুধার কারণে ব্যথা।’

‘না, খিদের জন্য হচ্ছে না,’ মুসা বলল।

‘তাহলে কিসের জন্য?’

ফারিহা, রবিন, কিশোর, তিনজনের মুখের দিকেই একবার করে তাকিয়ে নিল মুসা। তারপর বলল, ‘বিপদের গন্ধ পাচ্ছি আমি। ভয়ংকর বিপদ। আমার অনুমান সত্যি হলে ক্যাম্পের কেউ রেহাই পাবে না।’

‘মানে?’ বুঝতে পারল না রবিন। ‘কিসের বিপদ?’

‘আমি বুঝে গেছি,’ মাথা দুলিয়ে বলল ফারিহা। ‘মিস্টার উলফ কী বলেছেন ভুলে গেছ? জায়গাটাকে বুনো প্রাণীর অভয়ারণ্য বানাবেন তিনি।’

‘কিন্তু সেই প্রাণীগুলোর কোনো একটা যদি দানব হয়?’ মুসা বলল। ‘পানির দানব?’

‘তাহলে আর কী, তোমার মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে,’ কিশোর বলল।

জোরে জোরে মাথা নাড়ল রবিন, ‘এই ক্যাম্পে দানব নেই।’

‘ধ্যাত্তোরি! প্যাঁচাল না পেড়ে চলো খেতে যাই,’ কিশোর বলল।

‘ফালতু কথা আমি বলছি না,’ গম্ভীর স্বরে জবাব দিল মুসা। ‘আমি বুঝে গেছি সব।  গভীরজলেরবাসিন্দা বইটাতে আমি এদের কথাই পড়েছি।’

‘তুমি আবার বই পড়া শুরু করলে কবে থেকে?’ মুখ বাঁকাল রবিন।

‘কী পড়েছ?’ জানতে চাইল ফারিহা।

একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল মুসা। মাটিতে তার সামনে বাকি তিনজনের বসার অপেক্ষা করল। ওরা বসলে বলল, ‘মাথামুণ্ডু আমিও কিছু বুঝতে পারিনি প্রথমে। এখন পরিষ্কার। সেই পুরোনো আমল থেকেই দানবের কথা বলে আসছে মানুষ। গভীর পানিতে যাদের বাস।’

‘চেনো নাকি ওদের? তোমার দোস্ত?’ ব্যঙ্গ করল কিশোর।

তার কথা যেন শুনতেই পায়নি মুসা। বলল, ‘স্কটল্যান্ডের লেকগুলোতে জলদানব দেখা গেছে। লেকে বাস করে বলে ওগুলোর নাম হয়ে গেছে লেকের দানব। বহুবার বহু লোকে দেখেছে। ওখানে যেহেতু লেককে বলে লক, দানবগুলোকে বলে লক মনস্টার।’

‘মিস নেসিও তো লেককে লক বলেছেন!’ চিৎকার করে উঠল ফারিহা।

‘হ্যাঁ, সেটাই তো সন্দেহ!’ মাথা ঝাঁকাল মুসা। ‘দানবের গুজব শুনে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা। লক নেস নামে একটা লেকের গভীর পানির তলায় বিশাল এক প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন। পরে যখন ডুবুরি নামানো হলো, ওরা কিছুই দেখতে পেল না। স্থানীয় লোকের ধারণা, এত লোকের আনাগোনা আর যন্ত্রপাতির খোঁচাখুঁচিতে বিরক্ত হয়ে নিজেদের বাসাবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে দানবগুলো।’

‘গেছে না ছাই!’ হাত নেড়ে যেন রবিনকে উড়িয়ে দিল কিশোর। ‘যে প্রাণী নেইই, তাকে খুঁজে পাবে কী করে?’

‘কিন্তু লক নেস মনস্টার ছিল, তার অনেক প্রমাণ আছে। ছবি, ফটোগ্রাফ—সবই আছে।’ মুসা বলল। ‘ওসব প্রাণী খুব লাজুক স্বভাবের। মানুষের সামনে আসতে চাইত না। সে জন্যই লুকিয়ে থাকত লক নেসের গভীর পানির তলায়। ওদের এত সাবধানতার পরেও অনেকেই কিন্তু দেখে ফেলেছে ওদের। একবার না, বহুবার।’

‘কেমন ছিল দেখতে?’ জিজ্ঞেস করল ফারিহা।

লম্বা দম নিল মুসা। ‘কালো রং। ছিপছিপে। গলাটা লম্বা। সাপের মাথার মতো ছোট্ট মাথা। ডাইনোসরের প্রজাতি হতে পারে।’

হেসে উঠল রবিন। ‘মিস নেসির গলা লম্বা, মাথাটা ছোট।’

‘ঠিক! এই কথাটাই তো বোঝাতে চাইছি আমি এতক্ষণ ধরে!’ চিৎকার করে উঠতে গিয়েও কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেলল মুসা। ‘লক নেস মনস্টার স্কটল্যান্ডের লক থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে মনস্টার লেকের পানিতে।’

 পাঁচ

 ‘তোমার মাথা, ছাগল কোথাকার!’ রেগে গেল কিশোর। ‘মিস নেসি দেখতেই অমন। উনি দানব, গলা কেটে ফেললেও এ কথা বিশ্বাস করব না আমি।’

‘কেন, নামের সঙ্গেও যে মিল আছে সেটা খেয়াল করোনি?’ তর্কে হারতে রাজি না মুসা। যুক্তি দেখাল, ‘তাঁর ডাকনাম নেসি। লক নেস মনস্টারের ডাকনামও নেসি রেখেছে স্কটল্যান্ডের লোকে।’

‘তাই তো!’ উত্তেজিত হয়ে উঠল ফারিহা। ‘মিলে যায়! সব মিলে যায়!’

‘তাঁর এভাবে গায়েব হয়ে যাওয়াটাও কিন্তু অদ্ভুত,’ সমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হলো মুসা। ‘সেই যে পানিতে নামল, উঠল তো না আর। এতক্ষণ করেছেটা কী?’

‘নিশ্চয় উঠে চলে গেছে,’ কিশোর বলল। ‘আমরা তো আর সারাক্ষণ পানির দিকে তাকিয়ে থাকিনি। মিস্টার উলফের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখনই নিশ্চয় কোনখান দিয়ে উঠে চলে গেছেন মিস নেসি। এখন হয়তো ডাইনিং টেবিলে বসে শাক চিবোচ্ছেন। দেহ স্লিম রাখার জন্য। ফালতু পেঁচাল বাদ দিয়ে চলো খাবার খেতে যাই।’

‘কিন্তু পানি থেকে তাঁকে উঠতে দেখলাম না কেন আমরা?’ ভয়ে ফিসফিস করে বলল ফারিহা।

‘দেখবে কী করে? পানিতেই ছিল যে,’ মুসা বলল। ‘এখনো আছে। ঝপাং করে একটা শব্দ হয়েছিল ভুলে গেছ? মিস নেসিই করেছেন।’

‘দেখো, ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে,’ গুঙিয়ে উঠল ফারিহা।

‘দূর! কিসের ভয়? ওঠো,’ ফারিহার হাত ধরে টান মারল কিশোর। ‘চলো, ভাগি। নইলে মুসা আমাদের শুধু লেকের দানব না, জলার রাক্ষস আর সাগরের জলকুমারীও দেখিয়ে ছাড়বে।’

লেকের পারের রাস্তা দিয়ে আগে আগে হেঁটে চলল ফারিহা ও মুসা। পেছনে কিশোর আর রবিন। হঠাৎ তাদের পাশে ঝপাং করে প্রচণ্ড জোরে এক শব্দ হলো পানিতে। ঘাই মারল কিসে যেন। বিকট চিৎকার দিয়ে দৌড় মারল ফারিহা। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে বাকি তিনজনও একই কাণ্ড করল।

একদৌড়ে একেবারে কেবিনের ডাইনিং রুমে ঢুকে পড়ল ফারিহা।

ডাইনিং রুমে ঢোকার পর হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ‘দৌড় দিলে কেন?’

ফারিহার মুখ লাল। হাঁপানির চোটে কথা বলতে পারল না কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘পানিতে ঝপাং করে উঠল দানবটা, শোনোনি?’

‘তোমাকে তো বললাম দানব-ফানব কিছু নেই। সব মুসার বানানো গপ্পো। এসব বলে ভয় দেখানোর চেয়ে বসে বসে রূপকথার বই লিখলে ভালো করবে ও। গোয়েন্দাগিরি ওর কাজ না।’

কেঁপে উঠল ফারিহা। ‘বুঝলাম। কিন্তু ওই লেকের ধারে-কাছে যেতে রাজি না আমি। এই ক্যাম্পেই থাকব না। বাড়ি চলে যাব।’

‘কে নিয়ে যাবে?’ রবিন বলল, ‘মিস্টার উলফ তো আর দিয়ে আসতে যাবেন না।’

কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল ফারিহা। ‘তাহলে খালাকে ফোন করব। এসে নিয়ে যাবে।’

‘এখানে টেলিফোন নেই।’

‘তাহলে মিস্টার উলফের মোবাইল ফোনটা দিয়ে করব।’

চলে গেল ফারিহা।

‘সর্বনাশ করবে!’ গুঙিয়ে উঠল রবিন। ‘অ্যান্টি শুনলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রকি বিচের সব লোকে জেনে যাবে।’

ঠোঁট কামড়াল কিশোর। ‘জানুক না। দানব থাকলে মানুষকে সাবধান করে দেওয়াই উচিত।’

কিশোর আর রবিনের দিকে তাকাতে লাগল মুসা। ‘মিস্টার উলফ ঠিকই বলেছেন। মনস্টার উডের লেক সব প্রাণীর জন্যই নিরাপদ আশ্রয়।’

‘দানবের জন্যও?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘হ্যাঁ, তাহলেও,’ মাথা ঝাঁকাল মুসা। ‘যতক্ষণ না দানবটা মানুষের কোনো ক্ষতি করে। ওটা যাতে নিরাপদে থাকে, সেদিকটাও দেখতে হবে আমাদের।’

ফিরে এল ফারিহা।

‘মাকে ফোন করেছ?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।

ফারিহার মুখ দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে। ‘একটা কথাও বিশ্বাস করেনি খালা।’

পিঠ চাপড়ে ফারিহাকে সান্ত্বনা দিল মুসা। ‘ভয় নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মিস্টার উলফের গর্জন শোনা গেল। হাতে করে খাবারের ট্রে নিয়ে এসেছেন। ‘অ্যাই, বিচ্ছুরা, খেয়ে ফেলো এগুলো। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

মুসা হাসল। ‘এত খিদে পেয়েছে আমার, হাতি খেয়ে ফেলতে পারব।’

‘তিমি খেতে পারবে না?’ গর্জন করেই রসিকতার জবাব দিলেন মিস্টার উলফ। ট্রে-গুলো ওদের হাতে ধরিয়ে দিলেন।

খাবারের দিকে এক নজর তাকিয়েই গুঙিয়ে উঠল ফারিহা। ‘মাছ!’

মিস্টার উলফ বললেন, ‘মাছ স্বাস্থে্যর জন্য ভালো। খেয়ে দেখো, পছন্দ হবে। সারা সপ্তাহ ধরেই মাছ খাই আমরা এখানে।’

‘আমার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।’ ট্রেটা নিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ল ফারিহা। মুসা, কিশোর আর রবিনও বসল একই টেবিলে। ফারিহা খুঁটতে থাকল শুধু। কিশোর আর রবিন স্বাভাবিক খাওয়াই খেল। মুসা গপগপ করে সব গিলে ফেলে আরও খাবার আনতে উঠে গেল।

খাওয়ার পর বাইরে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে বসল ছেলেমেয়েরা। নানা রকম মাছের ছবি দেখাতে লাগলেন মিস নেসি। মাছগুলোর বর্ণনা দিতে লাগলেন।

‘এ রকম মাছ আর দেখিনি আমি,’ কাঁটাওয়ালা একটা মাছ দেখিয়ে বলল কিশোর।

মিস নেসি হাসলেন। ‘এগুলো প্রাগৈতিহাসিক মাছ। খুব সামান্যই টিকে আছে এখনো লেক আর সাগরের গভীর পানিতে। দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে খুব কম লোকের। গভীর পানিতে আরও নানা রকম অদ্ভুত জীব বাস করে।’

‘এই যেমন, জলদানবের মতো প্রাণীরা!’ ফিসফিস করে বলল মুসা।

খানিক পর যার যার কেবিনে ফেরার সময় ওদের কানে এল ব্যাগপাইপ বাজানোর শব্দ।

‘কী ভয়ানক শব্দ! শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয় আমার,’ ফারিহা বলল।

‘এত বাঁশি বাজান কেন তিনি?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘আমার মনে হয় ওই বাঁশি বাজিয়েই রূপান্তর ঘটান মিস নেসি,’ নিচুস্বরে ব্যাখ্যা করল মুসা। ‘বাঁশির শব্দ কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া করে তাঁর শরীরে। মানুষ থেকে দানবে পরিণত হন তিনি। তার মানে লক নেস মনস্টার হয়ে যান।’

বাকি তিনজনের কেউ মুসার কথার জবাব দিল না। চিন্তিত মনে হচ্ছে কিশোরকে। ফারিহার হাঁটার গতি বেড়ে গেল।

অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশে তারার মেলা। আবছা আলোয় মিস্টার উলফকে দেখতে পেল ছেলেমেয়েরা। ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। হাতে একটা বড় কড়াই।

‘মাছের কড়াই,’ কিশোর বলল।

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ মুসার প্রশ্ন।

‘লেকে,’ রবিন বলল। ‘চলো, দেখে আসি কী করেন।’

পা টিপে টিপে মিস্টার উলফকে অনুসরণ করল ওরা। কড়াই থেকে সমস্ত মাছ লেকের পানিতে ঢেলে দিতে দেখল।

‘লেকের পানি নষ্ট করে দিচ্ছেন তো তিনি,’ ফারিহা বলল। ‘দূষিত করে দিচ্ছেন।’

‘আস্তে,’ সাবধান করল রবিন। ‘শুনে ফেলবেন।’

‘দূষিত করছেন না,’ মুসা বলল।

‘তা তো করছেনই,’ জোর দিয়ে বলল ফারিহা। ‘পানিতে ওগুলো পচবে। পানি দূষিত করবে।’

‘বললাম না, তা তিনি করছেন না,’ আবার বলল মুসা।

‘তাহলে কী করছেন?’

‘দানবটাকে খেতে দিয়েছেন।’

তাকিয়ে রয়েছে ওরা। মাছগুলো যেখানে ফেলেছেন মিস্টার উলফ, সেখানকার পানিতে শত শত বুদবুদ উঠতে দেখল।

‘সত্যিই তো দানব!’ ফিসফিস করে বলল ফারিহা। ‘নইলে এত ভুড়ভুড়ি দিচ্ছে কিসে?’

 ছয়

 পরদিন সকালে ব্যাগপাইপের শব্দে ঘুম ভাঙল ওদের। মুসা যখন ফারিহার সঙ্গে ডাইনিং রুমের দিকে রওনা হলো, তখনো হাই তুলছে ফারিহা।

ফারিহাকে দেখে রবিন বলল, ‘কি, মুখ-চোখের অবস্থা এমন কেন? ঘুমাওনি নাকি?’

‘না,’ আবার হাই তুলল ফারিহা। ‘মিস নেসির ব্যাগপাইপ সারা রাত ঘুমোতে দেয়নি আমাকে।’

‘আমিও শুনেছি,’ রবিন বলল। ‘কিন্তু সারা রাত তো একটানা বাজাননি। থেমে থেমে বাজিয়েছেন।’

‘মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে নিয়েছেন আরকি,’ মুসা বলল। ‘দানবেরও ঘুম পায়।’

‘চুপ!’ সাবধান করল রবিন। ‘আস্তে।’ চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ দেখছে কি না। ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, আমরা কাছাকাছি থাকলে মিস নেসি চুপ থাকেন?’

ফারিহা বলল, ‘অনেকেই অন্যের সামনে গান গাইতে লজ্জা পায়। মিস নেসি বেশি লাজুক। বাঁশি বাজাতেও লজ্জা পান। কথাও কম বলেন।’

‘খেয়াল করেছি,’ মুসা বলল। ‘মন খারাপ হয়ে যায় বলে ব্যাগপাইপ বাজান তিনি। বাড়ির জন্য, অর্থাৎ লক নেস লেকটার জন্য মন কেমন করে তাঁর। করবেই। বাড়ির জন্য সবারই করে। বাঁশি বাজিয়ে দেশের কথা মনে করেন তিনি। ফিরে যেতে চান নিজের লেকে, নিজের বাসায়।’

এত জোরে হেসে উঠল কিশোর, হাতের দুধের গ্লাস থেকে দুধ ছলকে পড়ল। ‘আরে গাধা, মিস নেসি দানব না। বংশীবাদক। বাজাতে ইচ্ছে করে বলেই বাজান। আর বাড়ি যেতে মন এত অস্থির হলে চলেই তো যেতে পারেন। এখানে তো কেউ তাঁকে আটকে রাখেনি।’

‘তবে কাল রাতে দানবটাকে দেখেছি আমরা এটা ঠিক,’ কেঁপে উঠল ফারিহা। ‘পানিতে ভুড়ভুড়ি দিচ্ছিল।’

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। আরেক টুকরো রুটি তুলে নিল। ‘দানব দেখলাম কোথায়? পানিতে ঝপাং শব্দ শুনেছি কেবল, আর বুদবুদ দেখেছি। তাতেই প্রমাণ হয়ে গেল না ওটা দানব।’

‘ছোট মাছেও অবশ্য বুদবুদ তোলে।’ দুধের গ্লাসে চুমুক দিল রবিন। ‘একবার গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একটা পুকুরে রুটি ফেলেছিলাম। ছোট ছোট মাছেরা একসঙ্গে মিলে সেই রুটি খাওয়ার সময় প্রচণ্ড ভুড়ভুড়ি তুলছিল।’

‘মনস্টার লেকের পানিতে যে ভুড়ভুড়ি দেখেছি আমরা, ওগুলোও ছোট মাছের। মরা মাছ খেতে এসে হুড়োহুড়ি লাগিয়েছিল জ্যান্ত মাছেরা। ইচ্ছে করেই ওদের খেতে দিয়েছেন মিস্টার উলফ। তাতে একসঙ্গে দুটো কাজ হয়েছে। জ্যান্ত মাছগুলো খাবার পেয়েছে। আবার মরা মাছ পচে বনের পরিবেশও দূষিত হয়নি।’ প্যানকেকের শেষ টুকরোটা মুখে পুরল কিশোর। ‘দানবের ভাবনাটা আসলে মুসার দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে চলো মজার জিনিস খুঁজি। যেমন, গুপ্তধন।’

নাশতা সেরে লেকের পারে রওনা হলো ওরা। কিন্তু লেকের কিনারে বালুর চরায় এসে থমকে দাঁড়াল মুসা। চিৎকার করে বলল, ‘দেখো দেখো!’

চারপাশে তাকাল কিশোর। ‘কই, কিছু তো দেখছি না।’

‘গুপ্তধন পেয়ে গেলে নাকি?’ ফারিহার প্রশ্ন।

মাথা নেড়ে মাটির দিকে দেখাল মুসা। ‘না। পায়ের ছাপ। দানবের পায়ের।’

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ফারিহার। চুপ হয়ে গেছে কিশোর আর রবিন। তাকিয়ে আছে ছাপগুলোর দিকে। অনেক বড় ছাপ। সামনের দিকটা ব্যাঙের পায়ের মতো।

‘জলদানব গেছে এখান দিয়ে,’ দাগের কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে শুরু করল ফারিহা।

নিচু হয়ে ছাপগুলো ভালোমতো পরীক্ষা করল কিশোর। ‘এগুলো দানবের পায়ের, আমি বিশ্বাস করি না। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে।’

বালুতে গভীরভাবে বসে যাওয়া একটা ছাপের ওপর হাত রাখল মুসা। ‘না, এর একটাই ব্যাখ্যা। জলদানব। আর দানবটার নাম নেসি।’

‘লক নেসের দানব এখানে এসে হাজির হয়েছে!’ চেঁচিয়ে উঠল ফারিহা। ‘এখন আমরা কী করব!’

 সাত

 ‘কিন্তু জলদানব মনস্টার উড লেকে এসেছে কেন?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘মিস্টার উলফ কী বলেছেন মনে নেই?’ মুসা বলল, ‘প্রাণীরা যখন দেখবে এখানে ওরা নিরাপদে থাকতে পারছে, একে একে সবাই এসে হাজির হবে।’

এক গাছি চুল আঙুলে জড়াতে লাগল ফারিহা। ‘আমি জানতাম জলদানবেরা শুধু সাগরে বাস করে।’

‘তাই তো,’ কিশোর বলল। ‘জলদানব সাগরের খোলা পানি বাদ দিয়ে চিপার মধ্যে অভয়াশ্রমের পানিতে থাকতে আসবে না। আর বালুর চরায় হেঁটে বেড়াবে না।’

‘কিন্তু লক নেসের দানব আসবে,’ জোর দিয়ে বলল মুসা। ‘কারণ সাগরের চেয়ে লেকই ওটার বেশি পছন্দ। মনস্টার উডের লেকটা নিশ্চয় পাতাল নদী দিয়ে সাগরের সঙ্গে যুক্ত। কৌতূহলী বিজ্ঞানীদের অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে এখানে চলে এসেছে নেসি, শান্তিতে থাকার জন্য।’

‘আমি বাড়ি যাব,’ ফুঁপিয়ে উঠল ফারিহা।

লেকের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুসা। ‘কিন্তু লোকে যখন জানবে মনস্টার লেকে দানব ঢুকেছে, দল বেঁধে ছুটবে সবাই। কৌতূহলী দর্শকে ভরে যাবে মনস্টার উড।’

হাসল কিশোর। বলল, ‘এত দিন শুনেছি, মানুষকে ভূতে ধরে। এখন দেখছি, তোমাকে দানবে ধরেছে।’

কিশোরের কথায় সুর মিলিয়ে রবিন বলল, ‘মিস নেসি দানব নন।’

‘এত শিওর হলে কী করে?’ ফারিহার প্রশ্ন।

ওর দিকে তাকাল রবিন। ‘জলের দানব ব্যাগপাইপ বাজাতে পারে না।’

‘আর জলে ডুব দিতে ডুবুরির পোশাকও পরতে হয় না ওদের,’ যোগ করল কিশোর।

‘তোমাদের কথাই যেন ঠিক হয়,’ ফিসফিস করে বলল ফারিহা। ‘কারণ, তিনি আসছেন!’

মিস নেসিকে আসতে দেখল ওরা। কালো স্কুবা সুট পরেছেন। ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে সেটা থেকে। পায়ে ফ্লিপার। বালিতে সেটার ছাপ পড়ছে। কিশোর লক্ষ করল, ছাপগুলো অনেক বড়, আর সামনের দিকটা ব্যাঙের পায়ের মতো। পাশে পাশে হেঁটে আসছেন মিস্টার উলফ। সঙ্গে ক্যাম্পের অন্য ছেলেমেয়েরা।

চট করে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল কিশোর, মুসা, রবিন ও ফারিহা। এক সারিতে ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল দলটা। হাত তুলে বালুতে পড়া ফ্লিপারের ছাপ দেখাল কিশোর। ‘মুসা, ওই যে ছাপগুলো দেখো। বালুর চরা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মিস নেসির ফ্লিপারের ছাপ পড়েছিল, সেটাই আমরা দেখেছি। তার মানে, মিস নেসি দানব নন। এসো, যাই।’

পিছু নিল চারজনে। পানির কিনারে কাঠের মঞ্চের দিকে চলেছে সবাই। মোটো জোসি আর আরেকটা ছেলের পেছনে নিজেদের আড়াল করে রাখতে চাইল ফারিহা ও মুসা। কিন্তু সারির পাশ কাটিয়ে সবার সামনে চলে গেল কিশোর।

‘পানিতে নামব কখন?’ মিস নেসিকে জিজ্ঞেস করল সে।

মুখে এসে পড়া ভেজা চুলের গোছা সরালেন সুইম কোচ। তাঁর হাতটা কাঁপতে দেখল কিশোর। মনে হলো, ঠান্ডায়।

‘বছরের এ সময়ে জঙ্গলে ঘেরা এসব পুরোনো লেকগুলোর পানি ভীষণ ঠান্ডা থাকে,’ মিস নেসি জবাব দিলেন। ‘সুট পরে না নামলে ঠান্ডায় জমে মরবে। তাই, তোমাদের জন্য ওয়েট সুট কিনে রেখেছেন মিস্টার উলফ।’

কাছেই রয়েছে বোট-হাউস। সেখানে এসে কালো রঙের পোশাকগুলো পরল ওরা। ডকে ফিরে এল। ওয়েট সুট পরাতে এক ঝাঁক কালো রঙের পেঙ্গুইনের মতো দেখাচ্ছে ছেলেমেয়েগুলোকে। সবাই উত্তেজিত। মাস্ক আর স্নরকেল লাগিয়ে পানিতে নামার জন্য অস্থির। কেবল ফারিহা বাদে। মুসার হাত খামচে ধরে বলল, ‘আমার নামতে ভয় লাগছে।’

‘খারাপ লাগবে না দেখো,’ উৎসাহ দিল কিশোর। ‘অনেক মজার জিনিস দেখতে পারব। লেকের তলায় কাদার ওপর ছড়ানো মোহর পেলেও অবাক হব না। বহুকাল আগে এ অঞ্চলে চোর-ডাকাতে ভর্তি ছিল। ওরা ফেলে যেতে পারে।’

মহা উৎসাহে পানিতে ঝপাঝপ লাফিয়ে পড়তে শুরু করল ছেলেমেয়েরা। ‘ইয়াহু!’ বলে চিৎকার দিয়ে পানিতে লাফ দিল কিশোর। মোটো জোসি ঝাঁপ দিতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেল পানিতে। তাতেও তার আনন্দের কমতি নেই। চিৎকার-চেঁচামেচি হট্টগোলে কান ঝালাপালা। বোকা হয়ে তাকিয়ে রইলেন মিস নেসি। কানে আঙুল দিলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘আরে থামো থামো! চেঁচানো থামাও!’

বহু কষ্টে ছেলেমেয়েদের চেঁচানি বন্ধ করা গেল অবশেষে। কাঁপা গলায় মিস নেসি বললেন, ‘এত চেঁচানো সহ্য হয় না আমার। পানির নিচে এত শব্দ করবে না। পানিতে সামান্য শব্দও খুব জোরে হয়।’

মুসার কানে কানে বলল ফারিহা, ‘শুনলে?’

‘শুনলাম,’ জবাব দিল মুসা। ‘এবং এতে অবাক হইনি আমি। শব্দের অত্যাচারেই লক নেস মনস্টার নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল, ভুলে গেছি মনে করেছ।’

‘মিস্টার উলফকে সাবধান করে দেওয়া দরকার,’ ফারিহা বলল। ‘লক নেসের দানব আমাদের সবাইকে গিলে ফেলার আগেই।’

পানির দিকে এগিয়ে গেল মুসা। ‘আরও আগেই বলা উচিত ছিল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

 আট

 পানিতে নামলেন মিস নেসি। ফারিহা আর মুসা বাদে বাকি সবাই তাঁকে অল্প পানিতে ঘিরে দাঁড়াল। মাস্ক ও স্নরকেল ব্যবহার করে কীভাবে ডুব-সাঁতার দিতে হয় শিখিয়ে দিতে লাগলেন তিনি। লেকের কিনারে সাঁতরাতে শুরু করল ছেলেমেয়েরা। নতুন ধরনের পোশাক পরে মজা পেয়ে গেছে। সাঁতরানোর চেয়ে দাপাদাপি করছে বেশি।

মোহরের খোঁজে বারবার ডুব দিতে লাগল কিশোর। লেকের মাঝখানে চলে এসেছে খেয়ালই রইল না।

হঠাৎ তার চিৎকারে ফিরে তাকাল ফারিহা। হাত দিয়ে পানিতে চাপড় মেরে ভেসে থাকার চেষ্টা করতে দেখল কিশোরকে।

‘অ্যাই!’ চেঁচিয়ে উঠল ফারিহা। ‘কিশোর ডুবে যাচ্ছে! ডুবে যাচ্ছে!’

এক মুহূর্ত দেরি না করে পানিতে ডুব দিলেন মিস নেসি। লম্বা গলাটা আরও লম্বা করে দিয়ে, নিঃশব্দে। সাপের দেহের মতো বেঁকে গিয়ে পানিতে তলিয়ে গেল তার পেছনটা। 

‘খোদা! আমার বন্ধুকে বাঁচাও!’ গলা কাঁপছে মুসার।

চিৎকার করে উঠল ফারিহা, ‘বেঁচে গেছে! মিস নেসি ওকে ধরে ফেলেছেন!’

‘কোনো মানুষকে এত তাড়াতাড়ি সাঁতরাতে দেখিনি আমি!’ মৃদুস্বরে বলল মুসা। ‘আর ডুব দেওয়ার কায়দাটা দেখেছিলে?’

‘তোমার ওই দানবের কিচ্ছা এখন বন্ধ করো তো, মুসা!’ বিরক্ত হয়ে বলল রবিন। ‘বরং কিশোরকে বাঁচিয়েছেন বলে মিস নেসির ওপর আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।’

‘নিয়ে এসেছেন, ওই যে,’ হাঁপ ছাড়ল ফারিহা।

মিস নেসি কিশোরকে পানির কিনারে নিয়ে এলে, ধরাধরি করে তাকে তীরে তুলল কয়েকজন ছেলেমেয়ে।

মুখ থেকে মাস্ক আর স্নরকেল টেনে খুলল কিশোর। ঘিরে দাঁড়াল তাকে সবাই। ওদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল সে, ‘এমন করে কী দেখছ তোমরা?’

‘আমরা মনে করেছিলাম তুমি ডুবে মরছ,’ ফারিহা জবাব দিল।

মাথা ঝাড়া দিল কিশোর। পানি ছিটিয়ে গেল চারদিকে। ‘আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি।’

নিজের মুখের মাস্কটা মাথার ওপর ঠেলে তুলে দিলেন মিস নেসি। কিশোরের কাঁধ চাপড়ালেন। ‘এখানে সাঁতার কাটতে নামলে পাড়ের কাছাকাছি থাকবে। নিরাপদ জায়গায়।’

নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল কিশোর। আবার পানিতে নেমে গেলেন মিস নেসি। তাঁর দূরে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করল কিশোর। তারপর নিচু স্বরে মুসাকে বলল, ‘তোমার কথাই মনে হয় ঠিক।’

‘কী ঠিক?’

‘লক নেসের দানব।’

‘তুমিও বিশ্বাস করছ?’ রবিন অবাক।

‘এইমাত্র আমি যা দেখে এলাম,’ কিশোর বলল, ‘তুমি দেখলে, তুমিও জলদানবে বিশ্বাস করতে।’

‘কী দেখেছ?’ ফারিহার প্রশ্ন।

‘পানির নিচে কালো, বড়, একটা কিছু দেখেছি আমি, ডাইনোসরের মতো।’

‘বলো কী!’ চেঁচিয়ে উঠল ফারিহা। ‘এখনই খালাকে জানানো দরকার!

হাত তুলল কিশোর, ‘না, এখন না। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।’

‘কী বুদ্ধি?’ একসঙ্গে প্রশ্ন করল অন্য তিনজন।

‘ওই জলদানবটাকে ধরব আমরা,’ হাসিমুখে ঘোষণা করল কিশোর।

 নয়

 পরদিন সকাল। ভারী মেঘ ঝুলে রয়েছে মনস্টার লেকের ওপর। এ রকম আবহাওয়ায় ভয়ানক ঠান্ডা পানিতে নামা ঠিক হবে না বুঝে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বনের ভেতর বেড়াতে চললেন মিস্টার উলফ। ইচ্ছে করেই দলের একেবারে পেছনে রইল তিন গোয়েন্দা ও ফারিহা। সুযোগ বুঝে সবার অলক্ষে সরে চলে এল ওরা। বোট ডকে এল। এটা আগেই প্ল্যান করে রেখেছিল ওরা।

লাফ দিয়ে একটা নৌকায় নেমে লাইফ জ্যাকেট পরে নিল কিশোর। অন্য তিনজনকে ডাকল, ‘নামো। দানব ধরতে যাব আমরা।’

‘কিন্তু মিস নেসিকে কী জবাব দেবে?’ মুসার প্রশ্ন। ‘যত যা-ই হোক, কাল তিনি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন।’

‘প্রথম কথা হলো, আমি ডুবে মারা যাচ্ছিলাম না,’ জবাব দিল কিশোর। ‘দ্বিতীয় কথা, তিনি একটা দানব, তাই না? তার মানে, তিনি বিপজ্জনক। তা ছাড়া, লক নেস মনস্টারকে ধরতে পারলে বিখ্যাত হয়ে যাব আমরা।’

‘কিন্তু দানব হলেও তাঁকে ধরা উচিত হবে না আমাদের,’ ফারিহা বলল। ‘মিস্টার উলফ এ জায়গাটাকে প্রাণীদের অভয়াশ্রম বানিয়েছেন। সব প্রাণীরই এখানে নিরাপদে থাকার অধিকার আছে। লক নেস মনস্টারেরও আছে।’

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল মুসা আর রবিন।

‘বললামই তো, তাঁর কোনো ক্ষতি করা হবে না,’ কিশোর বলল। ‘শুধু দেখব, সত্যি তিনি দানব কি না।’

আর তর্ক না করে লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়ে নৌকায় উঠল অন্য তিন গোয়েন্দাও। দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলল, যেখানে দানবের মতো জিনিসটাকে দেখেছে কিশোর।

‘মনে হয় এখানটাতেই সেদিন ঝপাং করে উঠেছিল,’ লেকের মাঝখানে এসে বলল রবিন।

সবুজ পানির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল ওরা। পানির নিচে দানবটাকে খুঁজছে ওদের চোখ।

‘কিছু দেখা যায়?’ অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল ফারিহা।

‘নাহ্‌,’ মাথা নাড়ল কিশোর। ‘টোপ ফেলে লোভ দেখাতে হবে।’

‘জলদানবের টোপ কী হতে পারে? কী খায়?’ মুসার প্রশ্ন।

‘মাছ! আবার কী?’ ফারিহা বলল।

‘ঠিক। মাছ প্রাণীটার সৃষ্টিই হয়েছে অন্যের খাবার হওয়ার জন্য,’ জিনসের পকেট থেকে একটা ঠোঙা বের করল রবিন। উপুড় করে ঢেলে দিল নৌকার পাটাতনে।

‘এ কী? এ তো আলুর চিপস। মাছ কই!’ বিরক্ত হলো কিশোর।

‘আর কিছু নেই আমার কাছে,’ রবিন বলল। ‘ফেলে দেখা যাক। পানির ওপর পড়লে মাছ ভেবে ভুল করে বসতে পারে দানবটা।’ কয়েকটা চিপস তুলে নিয়ে পানিতে ছুড়ে ফেলল সে।

‘একটা দানবের খোঁজ বোধ হয় আমরা পেয়েই গেছি,’ আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল ফারিহা। দানব দেখার উত্তেজনায়, মনের ভুলেই বোধ হয় চিপস তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে মুসা।

‘অকারণে সময় নষ্ট,’ বিড়বিড় করে বলল ও। ‘মাঝখান থেকে মিস্টার উলফের শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাঁর কথা না শুনে বনের মধ্যে ঘুরতে না যাওয়ার অপরাধে।’

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁড় তুলে নিল রবিন। কিশোরের দিকে তাকাল। ‘এখনো সময় আছে। চলো, ফিরে যাই।’

আচমকা ঝাপটা দিয়ে গেল ঝোড়ো বাতাস। উত্তেজনায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ, আকাশে ঘন হয়েছে কালো মেঘ। বৃষ্টি আসবে।

‘দাঁড়াও দাঁড়াও!’ চিৎকার করে উঠল কিশোর। পানির নিচে কালো একটা বড় ছায়ার দিকে আঙুল তুলল সে। সোজা এগিয়ে আসছে নৌকাটার দিকে।

‘নিচে চলে আসছে! নিচে চলে আসছে!’ চিৎকার দিয়ে উঠল ফারিহা।

‘বসো! বসে পড়ো!’ রবিনও চিৎকার করে উঠল। তবে দেরি হয়ে গেছে। কাত হয়ে গেল নৌকাটা। ছিটকে পড়ল ওরা ঝোড়ো বাতাসে উত্তাল হয়ে ওঠা পানিতে।

 দশ

 ভুস করে পানিতে মাথা তুলল ফারিহা। নৌকাটাকে উল্টো হয়ে ভেসে থাকতে দেখল লেকের পানিতে। মুসা, রবিন আর কিশোর ধরে ফেলেছে ওটাকে। তবে ফারিহা ওদের থেকে অনেকটাই দূরে। হাবুডুবু খেতে খেতে ঢেউয়ের ধাক্কায় সবার কাছ থেকে আরও দূরে সরে যেতে শুরু করল সে।

‘সাঁতরে চলে এসো আমাদের কাছে!’ চিৎকার করে বলল মুসা।

‘আমি সাঁতার জানি না!’ ককিয়ে উঠল ফারিহা।

‘চেষ্টা করো! চুপ করে থেকো না!’ রবিন বলল। ‘আর কিছু না পারলে হাত-পা ছোড়ো!’

চেষ্টা করছে ফারিহা। হাত-পা ছোড়া সার হলো শুধু, এগোতে আর পারল না। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ চিৎকার করতে গেলেও বিপদ। নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকে যায়। ‘আমি ডুবে যাচ্ছি!’

‘ডুববে না,’ মুসা বলল। ‘লাইফ জ্যাকেট পরা আছে। ওটাই তোমাকে ভাসিয়ে রাখবে। পা দিয়ে লাথি মারতে থাকো শুধু পানিতে, ডাঙার কাছে চলে আসতে পারবে।’

‘মনে হয় পারবে না,’ কিশোর বলল। ‘আমাকেই গিয়ে তুলে আনতে হবে।’

তবে তুলে আনতে আর হলো না তাকে। হাত-পা ছুড়ে সামান্য পাশে সরতেই যেন আপনাআপনি চলতে শুরু করল ফারিহা। বেশ দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল নৌকার দিকে। দেখতে দেখতে চলে এল নৌকার কাছে। একটা মুহূর্তও দেরি করল না মুসা। হাত বাড়িয়ে খামচে ধরল ফারিহার লাইফ জ্যাকেট। টানতে শুরু করল। নৌকার কিনার খামচে ধরল ফারিহা। সাদা হয়ে গেছে আঙুলগুলো।

‘তুমি তো সাঁতার জানো না!’ মুসা বলল। ‘এখন পারলে কী করে?’

চোখ এতই বড় বড় হয়ে গেছে ফারিহার, মনে হলো ছিটকে বেরিয়ে আসবে। ফিসফিস করে কোনোমতে বলল, ‘আমি তো পারিনি!’

‘তাহলে এলে কীভাবে এখানে?’ কিশোরও কিছু বুঝতে পারছে না।

‘মনে হলো কিসে যেন ঠেলে নিয়ে এল,’ ফারিহা বলল। ‘শক্তিশালী কিছু। টান লাগল শরীরে।’

‘স্রোতে ঠেলে এনেছে,’ রবিন বলল।

মাথা নাড়ল মুসা, ‘উঁহুঁ, স্রোত না, স্রোত না। নেসি। জলদানব।’

‘এখান থেকে নিয়ে চলো আমাকে!’ চিৎকার করে উঠল ফারিহা। ‘আমি আর একটা সেকেন্ডও থাকতে চাই না এখানে!’

‘আমিও না,’ রবিন বলল। ‘একে তো দানব। তার ওপর ঝড়। ভয়ানক জায়গা এখন এই লেক।’

‘চিৎকার শুরু করি,’ রবিন বলল। ‘কেউ না কেউ শুনতে পাবেই।’

‘সাবধান! চেঁচাবে না!’ মুসা বলল। ‘দানবটা শুনে ফেলবে।’

নৌকাটাকে চিত করার চেষ্টা করল ওরা। তাহলে উঠে বসতে পারবে আবার। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সোজা করতে পারল না।

সাহাযে্যর আশায় দূরে তীরের দিকে তাকাল ওরা।

‘ওই দেখো!’ কিশোর বলল। ‘ডকের ওপর কে জানি এসে দাঁড়িয়েছে।’

‘মিস নেসির মতো লাগছে না?’ রবিন বলল।

‘নৌকা ধরে থাকতে থাকতে কাহিল হয়ে গেছি আমি,’ ফারিহা বলল। ‘চিৎকার করো। ডাক শুনলে আমাদের নিতে আসবেন।’

আবার তীরের দিকে তাকাল ওরা। ডকের ওপর কাউকে দেখা গেল না।

‘তার মানে কেউ আসেনি!’ ফারিহা বলল। ‘ভুল দেখেছি আমরা! সব কজন আজ আমরা দানবের পেটে যাব। মা-গো! ও মা!’ কাঁদতে শুরু করল ফারিহা।

‘সত্যিই আজ আর বাঁচোয়া নেই আমাদের,’ দুঃসাহসী কিশোরও হাল ছেড়ে দিল। ‘দানবের পেটে যাওয়াই কপালে লেখা ছিল।’

হঠাৎ নড়তে শুরু করল নৌকাটা। কিছু একটা যেন নিচ থেকে আঁকড়ে ধরেছে ওটাকে।

‘দানব! দানব!’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল রবিন।

‘ধরে থাকো! ছেড়ো না!’ কিশোরও চিৎকার করে উঠল। ‘যা ঘটে ঘটুক, দানবটা আমাদের গিলে না ফেলার আগে ছেড়ো না!’

এগারো

 ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগিয়ে চলল নৌকাটা। যেই তীরের একেবারে কাছে চলে এল, পায়ের নিচে মাটি ঠেকল ওদের, থেমে গেল নৌকা।

একটা সেকেন্ড আর দেরি করল না গোয়েন্দারা। পায়ের নিচে মাটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাঙায় ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। হ্যাঁচড়েপ্যাঁচড়ে উঠে এল ডাঙায়।

ঠিক এই সময় আশপাশের ঝোপ আর গাছের আড়াল থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল এক ঝাঁক নারী-পুরুষ, টেলিভিশনের লোক সবাই। সবার মাথায় ছাতা। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।

‘জানল কীভাবে ওরা?’ রবিন বলল। ‘নিশ্চয় অ্যান্টি বলে দিয়েছেন।’ মুসার আম্মার কথা বলল ও।

‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে,’ মুসা বলল। ‘মা-ই খবরটা দিয়েছে টেলিভিশনকে।’

ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন মিস্টার উলফ। ফারিহা, মুসা, কিশোর আর রবিনের সামনে এসে গর্জে উঠলেন, ‘এই আবহাওয়ায় লেকে নামা নিষেধ। তোমাদের বনে যেতে বলেছিলাম আমি।’ বৃষ্টির পানি ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়তে শুরু করল তাঁর দাড়ি বেয়ে।

‘আমাদের দোষ কী?’ প্রতিবাদ জানাল কিশোর। ‘দানবটাই তো যত নষ্টের মূল।’

‘তাহলে দানব একটা সত্যি আছে লেকের পানিতে?’ লাফ দিয়ে কিশোরের সামনে এসে দাঁড়াল একজন রিপোর্টার। ঝট করে হাতের মাইক্রোফোনটা ঠেলে দিল মুখের কাছে। কিশোরের দিকে ক্যামেরা তাক করল একজন ক্যামেরা অপারেটর।

প্রথমে ক্যামেরার দিকে তাকাল কিশোর। তারপর রবিনের দিকে। একগাল হেসে বলল, ‘বিখ্যাত হয়ে যাব আমরা।’

‘হয়তো,’ মুখ কালো করে ফেলেছে রবিন। ‘কিন্তু নেসিকে যদি খুঁজে বের করে ধরে ফেলে ওরা, তা হলে কী হবে? সবাই মিলে পরীক্ষা করতে করতেই জীবনটা নরক বনিয়ে ছাড়বে ওর। শান্তি বলে আর কিছু থাকবে না তার জীবনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেও বাঁচতে পারল না বেচারা!’

‘ও আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে,’ ফারিহা রবিনের কথায় সুর মেলাল। ‘সব প্রাণীই স্বাধীনভাবে একটু শান্তিতে বাঁচতে চায়। হোক না দানব।’

কিশোরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন মিস্টার উলফ। জ্বলন্ত চোখে তাকালেন রিপোর্টারের দিকে। গর্জন করে বললেন, ‘আমার ক্যাম্পে চড়াও হওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের? দানব নেই এখানে। দানবটানব কিচ্ছু না। যান।’

‘তাই নাকি, খোকা?’ কিশোরকে জিজ্ঞেস করল রিপোর্টার। ‘লেকে দানব থাকার কথা কিছু জানো নাকি?’

ফারিহা আর রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। তারপর তাকাল মিস্টার উলফের দিকে। মিস নেসি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মিস্টার উলফের পাশে। ভেজা ওয়েট সুট থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে। চুল থেকেও পানি পড়ছে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

হাসিটা ফিরিয়ে দিল কিশোর। তারপর ভারী দম নিয়ে প্রায় ঠোঁটের কাছে ঠেকে থাকা মাইক্রোফোনে বলে উঠল, ‘আপনারা রিপোর্টাররা পাগল হয়ে গেছেন। এত দিন ভাবতাম আমরা ছোটরাই বুঝি এসব দানবফানব তৈরি করি আমাদের মগজের মধ্যে। বড়রাও যে কম না প্রমাণ করে দিলেন সেটা।’

গটগট করে হেঁটে এসে কিশোরের পাশে দাঁড়াল ফারিহা। মাটিতে পড়ে থাকা চিপসের খালি প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানগুলো দেখিয়ে বলল, ‘দানব আসলে তারাই, যারা এসব জিনিস ছড়িয়ে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করে।’

লাল হয়ে গেল রিপোর্টারের মুখ। এক ঝটকায় সরিয়ে নিল মাইক্রোফোন। চিৎকার করে উঠল ক্যামেরা অপারেটরের দিকে তাকিয়ে, ‘বন্ধ করো! সরাও! সরিয়ে ফেলো সব!’

হা-হা করে হেসে উঠল রবিন। রিপোর্টার আর ক্যামেরাওয়ালারা সরে গেল দ্রুত। তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচতে চায় যেন এক অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে।

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। ‘আমি ভেবেছিলাম ওদের সব বলে দেবে তুমি।’

‘কী বলবে?’ মুসা বলল। ‘লেকের পানিতে দানব বলে কিছু নেই?’

‘তা তো নেইই,’ মিস নেসি বললেন। ‘সব বানানো। ভুয়া কথা। দানব বলে কিছু নেই।’

আড়চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।

কিশোর হাসল। ‘তোমাদের মিছে কথা বলেছিলাম আমি সেদিন। লেকের মাঝখানে ডুবে যাওয়ার অভিনয় করেছিলাম। দেখতে চেয়েছিলাম, সত্যি সত্যি নেসি এসে আমাকে ধরে কি না। শিকারকে দুর্বল অসহায় হয়ে যেতে দেখলে অনেক প্রাণীই আক্রমণ করে বসে।’

‘তাহলে তুমি যে বললে ডাইনোসরের মতো কিছু দেখেছ?’

হাসিটা বাড়ল কিশোরের। ‘ভুল বলিনি। পুরোনো একটা ভাঙা নৌকা উল্টে পড়ে আছে লেকের তলায়। পানির মধ্যে ওপর থেকে ডাইনোসরের পিঠের মতোই লাগে।’

‘কিন্তু আমাদের নৌকাটা আজ তাহলে উল্টে দিল কে? কিসের ছায়া দেখলাম?’

‘মেঘের ছায়া। বাতাসে এমনিতেই ঢেউ উঠে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পানির নিচ দিয়ে ছায়া ছুটে আসছে। ঝড়ের সময় পানিতে ও রকম দেখা যায়। আর নিজেদের নৌকা নিজেরাই উল্টে দিয়েছি আমরা। ছায়াটাকে দানব ভেবে একপাশে সরে গিয়েছিলাম। একপাশে ভার বেশি হয়ে যাওয়ায় নৌকা উল্টে গেছে।’

‘নৌকাটাকে তাহলে তীরে ঠেলে আনল কিসে?’

মিস নেসির দিকে তাকাল একবার কিশোর। হাসল। ‘বলব?’

হাসলেন ম্যাডাম। ঘাড় কাত করলেন। ‘বলো।’

‘মিস নেসি এনেছেন। আমাকে সেদিন যেমন করে ঠেলে নিয়ে এসেছিলেন তীরে। নৌকাটাও তিনিই টেনে এনেছেন, পানির নিচে ডুব দিয়ে ছিলেন। স্কুবা সুট আর স্নরকেল পরা থাকায় দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকতে পেরেছেন।’ গায়ে কাঁটা দিল কিশোরের। ‘উহ্‌, শীত লাগছে। এখানে দাঁড়িয়ে আর বকবক না করে চলো কেবিনে যাই। ভেজা কাপড়ে আর পারছি না। শুকনো কাপড় দরকার।’

‘কিন্তু দানব ধরার এ খেলাটা খেললে কেন তুমি?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।

‘প্রমাণ করার জন্য, যে দানব বলে কিছু নেই,’ জবাব দিল কিশোর।

‘মিস নেসি যে পানির নিচে সাঁতার কাটছিলেন, এটা তুমি জানতে?’

‘না, জানতাম না। তবে অনুমান করেছিলাম। কারণ, মিস্টার উলফ চলে গিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর মিস নেসিকে যেতে দেখেছি ডকের দিকে। তারপর আর তাঁকে দেখিনি। তাতে ধরেই নিয়েছিলাম, তিনি পানির নিচে আছেন। তিনি দানব হলে, সেটা প্রমাণ হয়ে যেত। আমাদের একা পেয়ে আক্রমণ করতেন। তা যেহেতু করেননি, বরং সাহায্য করেছেন, তাতে পরিষ্কার বোঝা গেছে, তিনি মানুষ। তবে অত্যন্ত দক্ষ সাঁতারু। আর পানি তাঁর ভীষণ পছন্দ।’

মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন, ‘কী, মুসা, তোমার মাথা থেকে দানবের ভূত গেছে তো?’

‘কথা অনেক হয়েছে,’ হঠাৎ গর্জে উঠলেন মিস্টার উলফ। ‘এখন আমাদের দরকার আগুন। হাত-পা গরম করার জন্য। শরীর গরম করার জন্য দরকার চকলেট মিল্ক।’ জ্বলন্ত চোখে তাকালেন কিশোরের দিকে। ‘এবারকার মতো মাফ করে দিলাম। এরপর যদি আদেশ অমান্য করো, এক মুহূর্তও আর থাকতে দেব না মনস্টার উডে। বের করে দেব।’

অলংকরণ: সাদাত