কী বিপদ

‘দয়া করে সিটবেল্ট বাঁধুন,’ আল ধরে ককপিটের দিকে যাওয়ার সময় বললেন বিমানবালা।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন মুনিম সাহেব। রাত হলেও, বাইরেটা অন্ধকার নয়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। বিমানের একটা ইঞ্জিন যখন চালু হতে যাচ্ছে, তাঁর ধারণা হলো কালো মেঘের মতো কুৎসিতদর্শন ধোঁয়া বেরোতে দেখবেন তিনি। যদিও সে রকম কিছু দেখতে পেলেন না। প্রথম ইঞ্জিনটা খকখক করে বার কয়েক কাশি দিয়ে চালু হওয়ার সময় ফিউজিলাজ কাঁপতে লাগল। সেই কাঁপন আরও বাড়ল দ্বিতীয় ইঞ্জিন চালু হতে। মৃদু কাশি হয়ে উঠল প্রবল যান্ত্রিক গর্জন। এবার সিটবেল্ট তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি পেটের কাছে জোড়া লাগালেন। প্লেন কাঁপছে তাই আমিও কাঁপছি, ভাবলেন তিনি। তাঁর বসার ধরন আড়ষ্ট, শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত।

অ্যাপ্রনের দিকে রওনা হয়ে গেছে ডিসি-৭, ওড়ার জন্য দৌড় শুরু করবে ওখান থেকে।

রানওয়ের কিনারায় পৌঁছে থামল প্লেন। জানালা দিয়ে যতটুকু সম্ভব নিজের পেছন দিকের বিমানবন্দর দেখার চেষ্টা করলেন মুনিম সাহেব। প্লেন হঠাৎ ছুটতে শুরু করায় একটা ঝাঁকি খেলেন, ইঞ্জিনের গর্জন তুঙ্গে ওঠার পর ভয় পেলেন কানের পর্দা না ফেটে যায়। এমন ভঙ্গিতে হাঁ করলেন, যেন মুখ দিয়ে সব আওয়াজ বের করে দেবেন। তাঁর চোখে অসুস্থ লোকের চকচকে ভাব ফুটে উঠেছে, হাত হয়ে গেছে শক্ত মুঠো।

কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে পা দুটো এক ঝটকায় টেনে নিলেন। ঝাঁকি খেয়ে ঘুরে গেল মাথা, দেখলেন সেই সুন্দর বিমানবালা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। ‘স্যার, আপনি ভালো আছেন তো?’ উত্তরে মুখটা ঝাঁকালেন তিনি। বিমানবালার হাসি আরও উজ্জ্বল হলো, তিনি চলে যাচ্ছেন।

প্লেন ছুটছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মুনিম সাহেব দেখছেন কালো রানওয়ে দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ছুটে আসছে। ডানার কিনারা থেকে ফ্ল্যাপ নামার সময় যান্ত্রিক গুঞ্জন ভেসে এল। তারপর দেখলেন দৈত্যাকার চাকার সঙ্গে রানওয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। জমিন খসে পড়ার মতো নিচে নেমে যাচ্ছে। বিমানের তলা দিয়ে ঝাপসা প্রবাহের মতো পেছন দিকে ছুটছে গাছপালা।

ডিসি-৭ ধীর ভঙ্গিতে ডান দিকে ঘুরে যাচ্ছে, যেন কুয়াশার ভেতর মিটমিট করা তারার জগতে উঠতে চায়। ইঞ্জিনের গর্জন আগেই কমে গেছে, এখন শুধু মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বিমান এখন পুরোপুরি সিধে। সব খুব স্বাভাবিক। আকাশে সবাই তারা নিরাপদ। শান্তিময় উপভোগ্য পরিবেশ।

তারপর সেটা নষ্ট হয়ে গেল। কোটের পকেটে হাত ভরে খবরের কাগজ বের করলেন মুনিম সাহেব। ভাঁজ খুলে পড়ছেন। বরাবর যা দেখে আসছেন, দুনিয়ার অবস্থা তাঁর মতোই করুণ। কূটনৈতিক জগতে চলছে চরম রেষারেষি, জাপান আর আফগানিস্তানে ভূমিকম্প, দক্ষিণ আমেরিকায় খুনোখুনি, ইয়েমেন আর পাকিস্তানে বন্দুকযুদ্ধ, উত্তর আমেরিকায় টর্নেডো, ভারত মহাসাগরে সুনামি। তিনি বসে আছেন স্বর্গে, তাঁর কাছে রিপোর্ট যাচ্ছে দুনিয়ার সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে—ভাবলেন মুনিম সাহেব।

পনেরো মিনিট পর কাগজটা একপাশে গুঁজে রাখলেন। চিন্তার কথা হলো তাঁর পেটের অবস্থা ভালো নয়। পাশাপাশি এক জোড়া ওয়াশরুম দেখা যাচ্ছে, দুটোর মাথাতেই লাল আলো জ্বলছে—অর্থাৎ খালি নেই। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন, তারপর কেউ দেখে ফেলার আগেই আবার ভেতরে ঢোকালেন। মাথার ওপরে আলোটা অসহ্য লাগছে, বোতাম টিপে নিভিয়ে দিলেন। তাকালেন জানালার বাইরে।

কেবিনের দৈর্ঘ্য বরাবর আরোহীরা প্রায় সবাই ঘুমানোর প্রস্ত্ততি হিসেবে যে যাঁর সিট লম্বা করে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন। মোবাইল ফোনে সময় দেখলেন মুনিম সাহেব। এগারোটা বাইশ। মুখ দিয়ে ফুঁ-উ-উ-উ করে ক্লান্ত বাতাস ছাড়লেন। যেমনটি ধারণা করেছিলেন, প্লেনে ওঠার আগে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে লাভ হয়নি কোনো। ওয়াশরুম থেকে এক মহিলা বেরিয়ে আসছেন দেখতে পেয়ে ঝট করে দাঁড়ালেন তিনি, ছোঁ দিয়ে ব্যাগটা নিলেন, তারপর আল ধরে হন হন করে এগোলেন।

তাঁর সিস্টেম, যেমনটি আশা করা হয়েছিল, সহযোগিতা করছে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ ক্লান্ত সুরে গোঙালেন। তারপর কাপড়চোপড় ঠিকঠাক করলেন। হাত-মুখ ধোয়ার পর ব্যাগ থেকে টয়লেট কিট বের করলেন। টুথব্রাশে পেস্ট লাগালেন। দাঁত ব্রাশ করার সময় অবলম্বন হিসেবে এক হাতে ঠান্ডা বাল্কহেড ধরে আছেন, পোর্ট দিয়ে বাইরে তাকালেন। ইনবোর্ড প্রপেলার দেখা যাচ্ছে, মাত্র এক ফুট দূরে। মুনিম সাহেব কল্পনা করলেন ওটা ভেঙে যদি ছুটে আসে, তাঁর গোটা অস্তিত্ব কিমা হতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগবে। অকস্মাৎ পেটে শূন্য একটা অনুভূতি হলো। ভয় পেয়ে ঢোঁক গিললেন, ফলে গলায় খানিকটা পেস্ট মাখানো লালা আটকে গেল। ঘরঘর করতে করতে বেসিনে থুতু ফেললেন। ও আল্লাহ, উচিত ছিল প্লেনে চড়ার আগে গোটা দশেক ঘুমের ওষুধ খাওয়া।

টুলকিট ব্যাগে ভরছেন, চামড়ার তৈরি বড় এনভেলাপটা দেখে হকচকিয়ে গেলেন। এই যাহ্‌, মারাত্মক কাণ্ড ঘটে গেছে! তিনি ব্যবসায়ী, তাঁর কাছে লাইসেন্স করা পিস্তল থাকতেই পারে, কিন্তু তিনি যদি ভুল করে সেটা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন, সেই ভুল ধরার দায়িত্ব এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির নয়? মুনিম সাহেব বুঝলেন, এটা বেসরকারি বিমান বলে সম্ভব হয়েছে।

আছে যখন, থাক। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। বেগতিক দেখলে কোনো একটা সিটের তলায় পিস্তলটা ফেলে রেখে যাবেন। থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা করতে, থাই মেটাল ডিটেক্টর যদি তাঁর কাছে পিস্তল পায়, সন্ত্রাসী বলে জেলহাজতে চালান  করে দেবে থাই পুলিশ। কাজেই সাবধান!

পিস্তলসহ ধরা পড়লে কী ঘটবে? কিছু ঘটার আগেই মুনিম সাহেব কাঁপতে শুরু করলেন। সেটা এমন অদম্য, থামাতে না পেরে তাঁর কান্না পেতে লাগল। ‘আল্লাহ্‌, আমাকে ছাড়ো!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘আমাকে ছেড়ে দাও! ছাড়ো আমাকে!’ ফোঁপানোর যে আওয়াজ কানে ঢুকছে, সেটাকে কোনো রকমে নিজের বলে চিনতে পারছেন।

অকস্মাৎ শিরদাঁড়া খাড়া করলেন মুনিম সাহেব। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসল। পিস্তলটা আবার এনভেলাপে ভরে ব্যাগে রেখে দিলেন। এনভেলাপের ওপর চাপালেন ব্রিফকেস, চেইন টেনে বন্ধ করলেন ব্যাগ, তারপর দরজা খুলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে এসে ব্যাগ রাখলেন ব্যাগের জায়গায়। নিজের সিটে বসলেন, বোতাম টিপে পেছন দিকে নামালেন সেটা, চোখ বুজলেন। তিনি একজন ব্যবসায়ী, কাল সকালে অনেক কাজ করতে হবে, কাজেই এখন না ঘুমালেই নয়।

বিশ মিনিট পর। ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে বোতামে চাপ দিলেন মুনিম সাহেব, সিটের সঙ্গে সিধে হয়ে বসলেন, চেহারায় পরাজয় মেনে নেওয়ার ছাপ। লড়াই করে লাভ কী? পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে রাতটা তাঁকে জেগে কাটাতে হবে। তবে তাই কাটান। কাগজটা তুলে বাচ্চাদের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন। একটা ধাঁধা পড়ছেন, কিন্তু শেষ করতে পারলেন না, হাত থেকে কাগজ পড়ে গেল। সিধে হয়ে কাঁধ দুটো পালা করে ডললেন। এবার কী? তাঁর ঘুম আসছে না। চোখ দুটো অসম্ভব ক্লান্ত হওয়ায় পড়তেও পারছেন না।

ঘড়ি বলছে এখনো কমবেশি পাঁচ ঘণ্টা লাগবে ব্যাংককে পৌঁছাতে। মুনিম সাহেবের ইচ্ছে হলো যত জোরে পারা যায় চিৎকার করেন। একদিকে ইচ্ছেটা অদম্য হয়ে উঠছে, আরেক দিকে লোকে কী বলবে ভেবে শঙ্কিত হয়ে সেটাকে মেরে ফেলতে চাইছেন। দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলেন, ভাবছেন—দেখি কী করে আওয়াজ বেরোয়! মুখের ভেতর দাঁতগুলো পরস্পরের সঙ্গে এত জোরে চেপে আছে যে তাঁর চোয়াল ব্যথা করছে। মুখ থেকে একটা হাত সরিয়ে এক ঝটকায় জানালার পর্দা টেনে বাইরে তাকালেন।

মুনিম সাহেব দেখলেন ডানার আলোগুলো বারবার জ্বলছে আর নিভছে। আমি তাহলে এখানে, না, মাটি থেকে বিশ হাজার ফুট ওপরে? আটকা পড়ে আছি অ্যালুমিনিয়ামের একটা খোলের ভেতর— না পারব ছুটে কোথাও পালাতে, না পারব প্রাণ বাঁচানোর জন্য লাফ দিতে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোঁক গিললেন। লিকলিকে সরু বিদ্যুতের রেখা চিরে দিল দিগন্তের কাছাকাছি পুরো আকাশকে। তার মানে কি ঝড় আসছে? আকাশের মাঝখানে একটা বিন্দুর মতো প্লেনে তুমি বসে আছ, আর সেই বিন্দুর চারপাশে নির্দয় প্রকৃতির তাণ্ডব নৃত্য চলতে থাকবে, এটি মোটেও সুখ পাওয়ার মতো কোনো ছবি নয়। আকাশে তিনি স্বাভাবিক নন, স্বীকার করলেন। অতিরিক্ত গতি তাঁকে সুস্থ থাকতে দেয় না। আসলেও তাঁর উচিত ছিল অনেক বেশি ঘুমের বড়ি খেয়ে প্লেনে ওঠা। ভাগ্য ভালো যে তাঁর সিট ইমার্জেন্সি ডোরের কাছে পড়েছে। আচ্ছা, দুর্ঘটনাবশত ওই ভারি দরজা যদি খুলে যায়? বাইরের বাতাস স্রেফ গিলে নেবে তাঁকে—তাঁর পতন শুরু হবে, শুরু হবে চিৎকার—আমৃত্যু। চোখ মিটমিট করে মাথা নাড়লেন মুনিম সাহেব। হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। এই সেরেছে! প্লেনের ডানার ওপর কী ওটা? কিছু যেন একটা চরছে! সর্বনাশ...না, মহাসর্বনাশ! চোখের ভুল? না! প্রচণ্ড ভয়ে বমি পাচ্ছে তাঁর।

ও আল্লাহ্‌, প্লেন আকাশে ওঠার আগে ডানার ওপর চড়ে বসেছিল একটা কুকুর কিংবা বিড়াল। আল্লাহই মালুম কীভাবে এখনো ওখানে টিকে আছে ওটা। অসুস্থকর একটা চিন্তা। বেচারি অবলা জানোয়ার, আতঙ্কে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এও তো চিন্তার বিষয় যে ও রকম বাতাসতাড়িত এবং মসৃণ একটা জায়গায় কীভাবে সে নখ আটকানোর মতো খাঁজ বা ভাঁজ খুঁজে পেল? এটা তো আসলে সম্ভবই নয়। হতে পারে ওটা স্রেফ একটা পাখি। আবার বিদ্যুৎ চমকাল, এবার কাছাকাছি। তার আলোয় মুনিম সাহেব পরিষ্কার দেখতে পেলেন, কুকুর-বিড়াল বা পাখি নয়, ওটা একটা মানুষ।

তিনি নড়তে পারছেন না। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখছেন প্লেনের ডানার ওপর হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে এগোচ্ছে কালো আকৃতিটা। অসম্ভব! বিভিন্ন মাত্রায় বিস্ময়ের ধাক্কা লাগছে মাথায়, তারই এক ভাঁজে শব্দটা তৈরি হলেও তিনি শুনতে পেলেন না। তিনি শুধু পেশি ছেঁড়ার ক্ষমতা রাখে হৃৎপিণ্ডের এমন লাফানি আর বাইরের ওই মানুষটা সম্পর্কে সচেতন।

অকস্মাৎ গায়ে এক বালতি ঠান্ডা পানি ঢেলে দেওয়ার মতো প্রতিক্রিয়া হলো। তাঁর মন লাফ দিয়ে একটা ব্যাখ্যা খুঁজছে। ওই লোক নির্ঘাত একজন মেকানিক বা অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবে। গ্রাউন্ড ক্রুদের কেউ। মেরামতের কাজ শেষ করতে পারেনি, তার আগেই প্লেন ছেড়ে দিয়েছে। কিংবা হয়তো ডানার ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্লেন ছাড়ার পর ওখানে ওই লোক টিকে আছে কীভাবে, বাতাস তার সব কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার পরও? বিশ হাজার ফুট ওপরের বাতাস বরফের চেয়ে বেশি ঠান্ডা না? অক্সিজেনও তো খুব কম? তাহলে শ্বাস নিচ্ছে কীভাবে? মুনিম সাহেব নিজেকে আর কিছু চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘স্টুয়ার্ডেস! স্টুয়ার্ডেস!’

তাঁর গলার স্বর ফাঁপা, বেসুরো, গোটা কেবিনে ছড়িয়ে পড়ল। মুখে ডাকছেন, ডাকছেন বোতামে চাপ দিয়েও। আল ধরে প্রায় ছুটে এলেন বিমানবালা, চেহারায় সতর্ক ভাব। মুনিম সাহেবের চোখ-মুখ দেখে ঘাবড়ে গেলেন, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

‘এটা আপনাদের কী রকম প্লেন সার্ভিস হলো? পাইলটরা কানা নাকি, ডানায় মেকানিককে রেখে প্লেন ছেড়ে দিলেন?’

‘জি! স্যার?’

জানালার দিকে আঙুল তাক করলেন মুনিম সাহ্বে। ‘ওদিকে তাকান, বাইরে! অক্সিজেনের অভাবে একজন খাবি খাচ্ছে। একটা মানুষ!’ তাঁর মুখের চারপাশের পেশি নড়াচড়া করছে। ‘দেখুন, ভালো করে দেখুন!’ লম্বা করা হাত কাঁপছে। ধপাস করে সিটে বসে পড়লেন, আঙুল দিয়ে আবার বাইরেটা দেখাচ্ছেন। ‘সে ডানার ওপর ক্রল করছে...’ তাঁর গলার ভেতর আটকে গেল বাকি শব্দ। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন ডানা একদম খালি, সেখানে কেউ নেই।

ওখানে বসে কাঁপতে লাগলেন মুনিম সাহেব। ডানা থেকে চোখ সরিয়ে জানালার কাচের ওপর বিমানবালার প্রতিবিম্ব দেখছেন। সুন্দর মেয়েটার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

অবশেষে বিমানবালার দিকে ফিরলেন তিনি। লিপস্টিক লাগানো লাল ঠোঁট ফাঁক হতে দেখলেন, কিন্তু তারপরও মেয়েটি কিছু বললেন না। ঠোঁট আবার জোড়া লেগে গেল, শুধু একটা ঢোঁক গিললেন।

‘আমি দুঃখিত,’ মুনিম সাহেব বললেন। ‘ওটা নিশ্চয় একটা...’

আলের উল্টোদিক থেকে এক টিনএজ মেয়ে তাঁকে দেখছে, ঘুম ঘুম চোখে কৌতূহল।

গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বিমানবালা জানতে চাইলেন, ‘আপনাকে কিছু দেব, স্যার?’

‘এক গ্লাস পানি,’ মুনিম সাহেব বললেন।

ঘুরে আল ধরে ফিরে যাচ্ছেন বিমানবালা।

কিশোরী মেয়েটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন মুনিম সাহেব। চোখ বুজলেন। এক লোক কিন্তু ছিল ওখানে, ভাবলেন তিনি। ছিল যে তাতে কোনো ভুল বা সন্দেহ নেই। ছিল, অথচ থাকার কথা নয়, থাকা সম্ভবও নয়।

তাঁর চিন্তা কি জট পাকিয়ে যাচ্ছে?

চোখ বুজে স্ত্রীর কথা ভাবছেন। এখন যদি তাঁর পাশে থাকত লরেলি, কী করত সে? লরেলি কি চুপ করে থাকত, ভয় পেয়ে একদম বোবা? নাকি অভয় আর সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাঁর চারপাশে পাখা ঝাপটানো পরির মতো ছোটাছুটি করত, হাসত, ভান করত সে কিছু দেখেনি? তাঁর ছেলেমেয়েরা কী ভাবত? অনুভব করলেন বুকের মাঝখানে একটা কান্না বিস্ফোরিত হবে বলে হুমকি দিচ্ছে।

‘এই নিন, আপনার পানি, স্যার।’

দ্রুত মোচড় খেয়ে চোখ খুললেন মুনিম সাহেব।

‘আপনাকে একটা চাদর বা কম্বল এনে দেব?’

‘না।’ মাথা নাড়লেন মুনিম সাহেব। ‘ধন্যবাদ।’ ভাবলেন, আমি এতটা বিনয় আর ভব্যতা দেখাচ্ছি কেন?

‘যদি কিছু দরকার হয়, বোতামে একটা চাপ দিলেই হবে,’ মেয়েটি বললেন।

মাথা ঝাঁকালেন মুনিম সাহেব। হাতে পানিভর্তি কাগজের কাপ, সিটে বসছেন, শুনতে পেলেন তাঁর পেছনের এক আরোহী চাপা গলায় বিমানবালাকে কিছু বলছেন। অপমানে আর অনুতাপে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে নিজের ব্যাগটা টেনে আনলেন কোলের ওপর, খেয়াল রাখছেন কাপের পানি যাতে না ছলকায়। ব্যাগ খুলে ওষুধের কৌটা নিলেন। প্যাঁচ ঘুরিয়ে কৌটার মাথা খুললেন, ভেতর থেকে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট বের করে মুখে পুরলেন, পানি খেলেন ঢক ঢক করে। চাপ দিয়ে খালি কাপটাকে তুবড়ে সিটের পকেটে রেখে দিলেন। তারপর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে পর্দাটা টেনে দিলেন। যাও, খেল খতম। একবার কারও দৃষ্টিবিভ্রম ঘটলে সেটাকে পাগলামি বলা চলে না।

খানিক পর আপনমনে ফিক ফিক করে হাসলেন মুনিম সাহেব। ভয় পেলে মানুষের দৃষ্টিভ্রম হতে পারে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। প্লেনে চড়ার আগে থেকেই তাঁর জানা ছিল তিনি ভয় পাবেন। চড়তে হয়েছে বাধ্য হয়ে, আর কোনো বিকল্প নেই দেখে। দৃষ্টিভ্রম অনেকেরই হয়, হতে পারে, কিন্তু তাঁরটা, মাশাআল্লাহ, যাকে বলে একদম...রাজকীয়!  বিবস্ত্র একজন মানুষকে ডিসি-৭-এর ডানায় হামাগুড়ি দিতে দেখেছেন, প্লেন যখন বিশ হাজার ফুট ওপরে উড়ছে।

কিন্তু নিজের সঙ্গে তাঁর এই কৌতুক বেশিক্ষণ টিকল না। হঠাৎ শীত করতে লাগল তাঁর। দৃশ্যটা এত পরিষ্কার ছিল, এত স্পষ্ট আর স্বচ্ছ। চোখ এ রকম একটা জিনিস কীভাবে দেখতে পাবে যদি না তার অস্তিত্ব থাকে? যেটা শুধু তাঁর মস্তিষ্কে আছে, বস্ত্তজগতে নেই, সেটাকে এ রকম সম্পূর্ণতা বজায় রেখে একটা কাজ করতে কীভাবে দেখলাম আমি? তিনি ঘুমিয়ে পড়েননি যে স্বপ্ন দেখেছেন। আকৃতিটা ছিল একদম নিখুঁত, কাজেই দেখার ভুলই বা কীভাবে বলা যায়! স্পষ্টই ত্রিমাত্রিক একটা বস্ত্ত, একটা প্রাণ, একজন মানুষ। এটাই সবচেয়ে ভীতিকর। ওটা স্বপ্ন বা স্বপ্নের মতো কিছু ছিল না। ডানার দিকে তাকাতেই...

একটা প্রবল ঝোঁকের মাথায় হাত বাড়িয়ে পর্দা সরালেন মুনিম সাহেব। তিনি বুঝতে পারলেন না, অন্তত সঙ্গে সঙ্গে, বাঁচবেন কি না। মনে হলো তাঁর বুক আর পেটে যা কিছু আছে সব ছাতু বা কাদা হয়ে গেছে। বন্দী হৃৎপিণ্ড ফুলে ঢোল, যেকোনো মুহূর্তে ফেটে যাবে। মুনিম সাহেব বসে আছেন, একজন পঙ্গু মানুষ।

মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে, মাঝখানে বাধা বলতে শুধু একপ্রস্থ কাচ, তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে লোকটা।

কদর্য একটা মুখ; এমন একটা মুখ যেটাকে মানুষের মুখ বলা কঠিন। নোংরা, ক্ষতবিক্ষত, কর্কশ। নাকটা বিবর্ণ মাংসের স্তূপ, ফাটা ঠোঁট লালচে রসে ভেজা, উদ্ভট আকৃতির দাঁত বাইরে বেরিয়ে এসে ও-দুটোকে ফাঁক করে রেখেছে। ওটার অপলক চোখ কোটরের ভেতর লুকিয়ে আছে। বীভৎস ওই মুখটাকে ঘিরে রেখেছে রাশি রাশি নোংরা চুল—সে চুল শুধু মাথা আর মুখে গজায়নি, নাক আর কান থেকেও গোছায় গোছায় বেরিয়ে এসেছে।

চেয়ারে কাঠ হয়ে বসে আছেন মুনিম সাহেব, তাঁর শরীর বা মন প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। মগজ বিশ্লেষণ করতে পারছে না। ঠান্ডা বিস্ময়ে জমাট বেঁধে গেছে সব। মুনিম সাহেব এমনকি চোখের পলক পর্যন্ত ফেলতে পারছেন না। একা শুধু হৃৎপিণ্ড নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ওই অদ্ভুত জীব যেমন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, তিনিও ওটার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছেন।

তারপর একটা কৌশল করলেন। চোখ বুজে ভাবলেন, আমি কাউকে দেখিনি, ওখানে কেউ নেই। দাঁতে দাঁত পিষছেন। নিশ্বাস ফেলছেন থেমে থেমে, নাকের ফুটো কাঁপিয়ে। ওটা ওখানে নেই! আসলেও নেই! কক্ষনো ছিলনা!

 সিটের হাতল শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন। শক্ত করলেন সবগুলো পেশি। বাইরে কোনো লোক নেই, সারাক্ষণ শোনাচ্ছেন নিজেকে। ডানার ওপর কোনো মানুষ ওত পেতে বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে, এটা অসম্ভব। মুনিম সাহেব চোখ খুললেন। সিটকে গেলেন তিনি, পারলে সিটের ভেতরে সেঁধিয়ে যান। লোকটা তো ওখানে আছেই, তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেও। নিজের তালুর গভীরে নখ বেঁধাচ্ছেন মুনিম সাহেব। ব্যথাটা ছড়াতে লাগল। ব্যথা তীব্র হয়ে উঠতে বিশ্বাস জন্মাল তিনি ঘুমাচ্ছেন না, জ্ঞানও হারাননি।

ধীরে ধীরে অবশ হাতটা বোতামের দিকে নিয়ে গেলেন। কাঁপা আঙুল খুঁজে নিল বোতামটা। তারপর ভাবলেন একই ভুল দুবার করছেন না তো? মুখ বিকৃত করে ভেঙচালেন ওটাকে, হাত ঝাপটা দিয়ে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করলেন। তাঁর আকস্মিক নড়াচড়া ছোট ছোট চোখ দিয়ে অনুসরণ করছে ওটা। তারপর আবার হাসতে লাগল।

খুব সাবধানে বোতামে চাপ দিলেন মুনিম সাহেব—একবার, দুবার। এবার  আসুন, ভাবলেন তিনি। নিজের নিখুঁত চোখ নিয়ে চলে আসুন, তারপর আমি যা দেখছি আপনিও তাই দেখুন—তবে জলদি!

কেবিনের পেছন দিক থেকে ভেসে এল পর্দা সরানোর আওয়াজ। হঠাৎ করে তাঁর শরীর শক্ত হয়ে গেল। লোকটা মাথা ঘুরিয়ে ওই শব্দের দিকে তাকাল। হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। জলদি, ভাবছেন। আল্লাহর দোহাই লাগে, জলদি করুন!

ব্যাপারটা মাত্র এক সেকেন্ডে শেষ হয়ে গেল। চোখ ঘুরিয়ে মুনিম সাহেবের দিকে তাকাল ওই লোক, ওর ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল দানবসুলভ অশুভ হাসি। তারপর এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘বলুন, স্যার?’

পাগল হওয়ার যে কী যন্ত্রণা, সেটা অন্তত এক মুহূর্ত পুরোপুরি ভোগ করলেন মুনিম সাহেব। লোকটা যেখান থেকে লাফ দিয়েছে আর বিমানবালার মুখ, পালা করে এই দুই জায়গায় ছুটছে তাঁর দৃষ্টি। একসময় দম আটকালেন।

তাঁর চোখে রাজ্যের হতাশা দেখতে পেলেন মেয়েটা। ‘আপনার কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

মেয়েটার চোখের দৃষ্টি দেখে মুনিম সাহেব বুঝতে পারলেন, একে বলে লাভ নেই, বিশ্বাস করবেন না। ‘সত্যি আমি দুঃখিত,’ বললেন তিনি। এত শুকনো একটা ঢোঁক গিললেন, গলার ভেতর কর্কশ আওয়াজ হলো। ‘কিছু না। আমি ক্ষমা চাইছি।’

বোঝাই যাচ্ছে কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছেন না তরুণী। প্লেন একটু কাত হয়ে পড়ায় মুনিম সাহেবের পাশের সিটের মাথা ধরে ভারসাম্য রক্ষা করছেন তিনি, অপর হাত কামিজের কিনারা ছুঁয়ে অসাড় ভঙ্গিতে ঝুলছে। ‘ঠিক আছে,’ অবশেষে বললেন। ‘আপনার যদি কিছু লাগে... জানেনই তো।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ধন্যবাদ। ঝড়-টর আসছে নাকি বলুন তো?’

তড়িঘড়ি করে একটু হাসলেন বিমানবালা। ‘খুবই ছোট একটা,’ বললেন। ‘চিন্তিত হবার মতো কিছু না।’

মাথা ঝাঁকালেন মুনিম সাহেব। বিমানবালা ফিরে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি আর ডাকব না। ডাকতে না চাইলেও আপনাকে আবার আমার ডাকতে হতে পারে। আপনার যে ট্রেনিং, তাতে খুব ভালো করে জানা আছে যে আরোহী ডানায় লোক আছে বলে ভাবে তার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে।

 ভাবে?

 ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে বাইরে তাকালেন মুনিম সাহেব। ডানার গাঢ় উত্থানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এগজস্ট দেখছেন, দেখছেন মিটমিট করা আলো। লোকটাকে যে তিনি সত্যি দেখেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজের চারদিকে যা কিছু আছে, প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সচেতন তিনি, তারপরও কীভাবে ও রকম উদ্ভট একটা জীব কল্পনা করতে যাবেন? ওটা যদি তার কল্পনা হয়, বাকি সবও কি কল্পনা? তিনি কি সত্যি কোনো প্লেনের আরোহী নন? তিনি কি ঢাকা থেকে ব্যবসার কাজে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে যাচ্ছেন না? তিনি কি মুনিম চৌধুরী নন? এই পৃথিবীতে তিনি কি জন্মাননি?

কোনটা বাস্তব? কোনটা মায়া?

হঠাৎ ড্রোন প্লেনের কথা মনে পড়ল। মার্কিনিদের দেখাদেখি রাশিয়াও নাকি ড্রোন বানাচ্ছে, তবে চালকবিহীন নয়—ওটা চালাবে রোবট।

আমি কি তাহলে একটা রোবট দেখলাম? রাশিয়ানরা কি তাহলে রক্ত-মাংসের রোবটও বানিয়ে ফেলেছে? হতে পারে, অসম্ভব কী!

মুনিম সাহেব ভাবছেন, লোকটা আবার কখন আসবে। এই মুহূর্তে প্লেনের ডানা খালি। তারপর, চোখের পলকে, কোত্থেকে কে জানে লাফ দিয়ে চলে এল। ব্যাপারটা খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন তিনি—কোনো সংঘর্ষ হয়নি বা চাপ পড়েনি, যেন মনে হলো বাতাসও সরে জায়গা করে দিল না। যেন একটা ভঙ্গুর জিনিস খুব সাবধানে নামল—ছোট্ট, লোমশ, তাল সামলানোর চেষ্টায় হাত দুটো দুপাশে মেলে দেওয়া।

মুনিম সাহেব টান টান হয়ে আছেন। ওটার সবকিছু লক্ষ করছেন। হ্যাঁ, ওটার দৃষ্টিতে জ্ঞান বা বুদ্ধির ঝিলিক আছে। লোকটা—ওটাকে তিনি কি একজন মানুষ বলে ভাববেন? আচ্ছা থাক, এ প্রসঙ্গে পরে চিন্তা করা যাবে। লোকটার মুখের চতুর হাসি যেন বলতে চাইছে সে তার বুদ্ধির সাহাযে্য মুনিম সাহেবকে বোকা বানিয়েছে। তার প্ররোচনাতেই স্টুয়ার্ডেসকে ডেকেছেন তিনি, আর স্টুয়ার্ডেস আসামাত্র সে চলে গিয়ে তাঁকে হাসির পাত্র বানিয়েছে।

উত্তেজনায় কাঁপছেন মুনিম সাহেব। এভাবে চলতে পারে না। তাঁর একার দেখায় কোনো কাজ হবে না। বাকি সবাইকেও দেখতে হবে। প্রমাণ করতে হবে ওখানে ওই লোক সত্যি আছে। মরিয়া হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছেন। আলের উল্টোদিকে বসা ওই কিশোরী! তাঁর একেবারে পাশেই তো। তিনি যদি ওদিকে ঝুঁকে ওর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেন, ওর ঘুম ভাঙান, ও কি তাহলে দেখতে পাবে না?

না। ওই মেয়ে দেখতে পাওয়ার আগেই লাফ দিয়ে চলে যাবে লোকটা। লাফ দিয়ে ব্যাটা যাচ্ছে কোথায়? সম্ভবত ফিউজিলাজের মাথায়, যেখানে বসে থাকলে কেউ তাকে দেখতে পাবে না—এমনকি ককপিট থেকে পাইলটরাও দেখতে পাবেন না।

মুনিম সাহেব হঠাৎ দেখলেন নিজেকে গালাগাল করে ধুয়ে দিচ্ছেন তিনি। ওর ম্যানেজার হাবিবুর একটা ক্যামেরা সেধেছিল, কিন্তু নিলে সম্মান কমে যাবে ভেবে নেননি। সঙ্গে এখন একটা ক্যামেরা থাকলে অনায়াসে ওই লোকের ছবি তুলতে পারতেন। তিনি যে ভুলভাল কিছু দেখছেন না সেটা সহজেই প্রমাণ করা যেত। কিছু না, নিজের আহাম্মকির কারণে সুযোগটা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

একটু ঝুঁকে জানালার আরও কাছাকাছি হলেন। তাঁর ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠল। কী করছে লোকটা?

আবার বিদ্যুৎ চমকাতে ডানা থেকে অন্ধকার যেন আচমকা লাফ দিয়ে সরে গেল, এবং সেই আলোয় মুনিম সাহেব দেখতে পেলেন।

 কৌতূহলী এক শিশুর মতো ডানার কিনারায় সরে গেছে লোকটা, ডান হাত লম্বা করে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকা প্রপেলার ধরতে চাইছে। মুনিম সাহেব হতবাক, সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছেন, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন লোকটার হাত একটু একটু করে প্রপেলারের দিকে এগোচ্ছে। আরও, আরও! তারপর ঝট করে নিজের হাত টেনে নিল লোকটা। গাল হাঁ করে নীরবে চিৎকার করছে। তিনি ওটার চোখে পানি দেখতে পাচ্ছেন, টপ টপ করে ঝরছে। কাঁদবেই তো। প্রপেলারে লেগে তার একটা আঙুল উড়ে গেছে। মুনিম সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

কিন্তু তাঁর বিস্মিত হওয়া বাকি আছে এখনো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন লোকটা আবার ঘুরন্ত প্রপেলারের দিকে ওই আঙুলটা বাড়াচ্ছে—যেটার অর্ধেক উড়ে গেছে। শুধু যে একটা আঙুল বাড়াচ্ছে, তা না, পুরো হাতই। কোনো অবোধ শিশুর দানবসুলভ আচরণ, ওই সচল প্রপেলারের পাতগুলো তাকে ধরতে হবে।

মুনিম সাহেব ভাবছেন: স্থান ও কাল যদি এ রকম উদ্ভট না হতো, কৌতুক জাগানো একটা দৃশ্যে চমৎকার মানিয়ে যেত ওই লোক, কমিকের বইয়ে হোক বা কোনো রূপকথায়—কাল্পনিক চরিত্র কোনোভাবে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।

তীব্র বাতাস ডানা থেকে উড়িয়ে নিতে চাইছে ওটাকে। তার নোংরা, জট পাকানো চুল পতাকার মতো উড়ছে, মনোযোগের সবটুকু প্রপেলারের ওপর। বাস্তবে ঘটতে দেখা এই ঘটনা...এটা কীভাবে আমার পাগলামি হতে পারে? হঠাৎ চিন্তাটা জাগল মুনিম সাহেবের মনে। স্বয়ং প্রকাশ পাওয়া এ রকম আতঙ্ক ছড়ানো প্রহসন আমাকে কেন টার্গেট করবে?

তিনি তাকিয়ে আছেন। লোকটা বারবার সামনে বাড়ছে। বারবার ঝট করে টেনে নিচ্ছে আঙুলগুলো। কখনো দু-একটা আঙুল মুখে পুরে চুষছে, যেন ঠান্ডা করার চেষ্টা। এবং কিছুক্ষণ পরপর, কাঁধের ওপর দিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে তাঁকে।

লোকটা জানে, ভাবলেন তিনি। জানে এই খেলাটা শুধু তার আর আমার মধ্যে। আমি যদি তার অস্তিত্ব অন্য কারও কাছে সত্যি বলে প্রমাণ করতে পারি তাহলে সে হারবে। আর শেষ পর্যন্ত আমিই যদি একমাত্র সাক্ষী থাকি, তাহলে সে জিতবে। মজা পাওয়ার ভাব মন থেকে একদম উধাও হয়ে গেল। মুনিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে আছেন। আশ্চর্য, পাইলটরা কেন ওটাকে দেখতে পাচ্ছেন না?  লোকটা এখন, প্রপেলারের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে, ইঞ্জিনের ঢাকনির ওপর বসে আছে—ঘোড়ার পিঠে চড়ে থাকার ভঙ্গিতে। ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।

তারপর দেখলেন মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিলেন সেটাই ঘটতে চলেছে—ঢাকনির স্ক্রু খুলছে লোকটা। মানে? তার উদ্দেশ্য কি? ঢাকনি খুলে ইঞ্জিনে হাত দেবে? মাঝ আকাশে থামিয়ে দেবে ইঞ্জিন? দুটোকেই? তাহলে...নির্ঘাত পপাত ধরণিতল!

আমার তো কোনো উপায় নেই! ভাবছেন মুনিম সাহেব। আমি তো এমন কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না যাতে এতগুলো মানুষ মারা যাবে! বোতাম আমি যদি না টিপি, তাহলে কে টিপবে? আর কেউ তো বিপদটা দেখতে পাচ্ছে না!

আবার খেলা শুরু হলো। বোতাম তিনি টিপে দিয়েছেন।

কেবিনের পেছন দিক থেকে ত্রস্ত পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। তার মানে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেছেন স্টুয়ার্ডেস। এক সেকেন্ডের জন্য মুনিম সাহেবের মনে হলো লোকটাকে এবার তিনি বোকা বানিয়েছেন—স্ক্রু খোলার পর সে এখনো ঢাকনির কিনারায় আঙুল বা নখ ঢোকানোর চেষ্টা করছে। তবে, একেবারে শেষ মুহূর্তে, স্টুয়ার্ডেস পৌঁছানোর ঠিক আগে, কাঁধের ওপর দিয়ে মুনিম সাহেবের দিকে একবার তাকাল। পরক্ষণে দেখা গেল বাতাসে উড়ছে সে—এই ছিল, এই নেই!

‘বলুন?’ হাসিমুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন তরুণীটি।

‘আপনি একটু বসবেন, প্লিজ?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

ইতস্তত করছেন মেয়েটি। ‘মানে...আমি?’

‘প্লিজ।’

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে, সাবধানে, তাঁর পাশের সিটে বসলেন তরুণী। ‘কী ব্যাপার, মিস্টার মুনিম?’ জানতে চাইলেন।

নিজেকে শক্ত করলেন মুনিম সাহেব। ‘ওই লোক এখনো বাইরে,’ বললেন তিনি।

কথা না বলে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন স্টুয়ার্ডেস।

‘আপনাকে আমার কথাটা বলার কারণ হলো,’দ্রুত বলে গেলেন মুনিম সাহেব, ‘একটা ইঞ্জিনে হাত দিচ্ছে সে।’

নিজের অজান্তেই জানালার দিকে তাকালেন মেয়েটি।

‘না, না, তাকাবেন না,’ সাবধান করলেন ওঁকে। ‘এখন ওখানে নেইও সে।’ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। ‘কী ঘটছে বলি তাহলে...আপনাকে এখানে আসতে দেখলেই লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে।’

মেয়েটি কি ভাবছেন চিন্তা করে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন মুনিম সাহেব। ঠিক এই গল্পটাই অন্য কেউ তাঁকে বললে তিনি বিশ্বাস করতেন না, মুখের ওপর বলে দিতেন, আপনি একটা মিথ্যুক। আচ্ছা, নিজেকে আমি নিজের কাছে পাগল সাব্যস্ত করছি না তো?

‘আমি যেটা বলতে চাইছি,’ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ বজায় রেখে বললেন তিনি, ‘ব্যাপারটা যদি আমার কল্পনা না হয়, এই প্লেন বিপদের মধ্যে আছে। অর্থাৎ আমরা সবাই বিপদের মধ্যে আছি।’

‘হ্যাঁ,’ বললেন মেয়েটি।

‘আমি জানি,’ মুনিম সাহেব বললেন, ‘আপনি ভাবছেন আমার মাথাটা গেছে।’

‘অবশ্যই না,’ বললেন মেয়েটি।

‘আমার দাবি শুধু এটুকু যে,’ বললেন মুনিম সাহেব, রাগের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে, ‘আমি যা বলেছি পাইলটদের তা জানান। বলুন তাঁরা যেন ডানার ওপর একটু নজর রাখেন। তাঁরা যদি কিছু দেখতে না পান—ঠিক আছে। কিন্তু যদি দেখতে পান...’

তাঁর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ওখানে বসে থাকলেন স্টুয়ার্ডেস। মুনিম সাহেবের হাত শক্ত মুঠো, কোলের ওপর কাঁপছে।

‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

সিট ছেড়ে সিধে হলেন মেয়েটা। ‘ওঁদের বলব আমি,’ জানালেন তিনি। আল ধরে ককপিটে ফিরে যাচ্ছেন। আস্তে ধীরে যাচ্ছেন, যাতে মনে না হয় তাঁর কাছ থেকে পালাচ্ছেন।

জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকালেন মুনিম সাহেব। তিনিও তাকালেন, লোকটাও আবার ফিরে এল। উড়ে এসে এমন ভঙ্গিতে নামল ডানার ওপর, যেন অদ্ভুতদর্শন একজন ব্যালে ডান্সার। তাঁর চোখের সামনে আবার নিজের কাজ শুরু করল সে। ইঞ্জিন কেসিংয়ের ওপর উঠে বসে দুপাশে খালি পা দুটো ঝুলিয়ে দিল, আঙুল দিয়ে প্লেট তোলার চেষ্টা করছে।

আচ্ছা, তাঁর এত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার কী? মুনিম সাহেব ভাবলেন। শয়তানের ওই ধাড়ি আঙুলের নখ দিয়ে স্ক্রু খোলার ভানই শুধু করতে পারবে, সত্যি সত্যি তো আর খুলতে পারবে না। পাইলটরা ওটাকে দেখতে পান বা না পান তাতে কিছু আসে যায় না, অন্তত প্লেনের নিরাপত্তার দিক থেকে।

তবে তাঁর ব্যক্তিগত কারণে...

ঠিক সেই মুহূর্তে পাজি লোকটা একটা প্লেটের কিনারা তুলে ফেলল। আঁতকে উঠলেন মুনিম সাহেব। হাঁপাচ্ছেন। ‘এখানে! জলদি!’ চেঁচাতে শুরু করলেন। ‘দেখুন!’ স্টুয়ার্ডেসকে দেখতে পেলেন, তাঁর চিৎকার শুনে ছিটকে বেরিয়ে আসছেন ককপিট থেকে। একা নন, সঙ্গে এবার একজন পাইলটও রয়েছেন।

পাইলটের চোখ খুঁজে নিল মুনিম সাহেবকে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক রকম ধাক্কা দিয়ে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিলেন স্টুয়ার্ডেসকে, আল ধরে ছুটে আসছেন।

‘জলদি! জলদি!’ চেঁচাচ্ছেন মুনিম সাহেব। ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলেন লোকটা লাফ দিল ওপর দিকে। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না। এখন প্রমাণ আছে, ওঁদের দেখানো যাবে।

‘কী ঘটছে এখানে?’ জিজ্ঞেস করলেন পাইলট, রুদ্ধশ্বাসে তাঁর সিটের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

‘একটা ইঞ্জিনের প্লেট ছিঁড়ে তুলে ফেলেছে ওই লোক!’ মুনিম সাহেবের গলা কাঁপছে।

‘কী করেছে বললেন?’

‘বাইরের ওই লোকটা!’ মুনিম সাহেব বললেন। ‘আমি আপনাকে বলছি ওই ব্যাটা...’

‘মিস্টার মুনিম, চেঁচাবেন না!’ হুকুম করলেন পাইলট।

মুনিম সাহেবের চোয়াল ঝুলে পড়ল।

‘এখানে আসলে কী ঘটছে আমার জানা নেই,’ বললেন পাইলট। ‘কিন্তু...’

‘আপনি তাকাবেন? দয়া করে আপনি একবার তাকাবেন?’ আবার চেঁচিয়ে উঠলেন মুনিম সাহেব।

‘মিস্টার মুনিম, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি।’

‘আল্লাহর দোহাই লাগে!’ দ্রুত ঢোঁক গিললেন মুনিম সাহেব, অন্ধ রাগ চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। আচমকা পিঠের চাপ দিলেন সিটে, হাত তুলে বাইরেটা দেখালেন। ‘একটি বার, আল্লাহর দোহাই লাগে, তাকাবেন?’ জিজ্ঞেস করলেন। ‘একটি বার?’

কাঁপা কাঁপা শব্দে বুকে বাতাস ভরে ঝুঁকলেন পাইলট। এক মুহূর্ত পরই তাঁর ঠান্ডা দৃষ্টি মুনিম সাহেবের মুখে ফিরে এল। ‘কী দেখব?’ জানতে চাইলেন। কারণ, বাইরে তাকিয়ে কিছুই তিনি দেখতে পাননি।

ঝট করে জানালার দিকে ঘাড় ফেরালেন মুনিম সাহেব। দেখলেন সবগুলো প্লেট স্বাভাবিক পজিশনে রয়েছে। ‘আরে, কী ব্যাপার! একটু দাঁড়ান...আমি তো পরিষ্কার দেখলাম ওদিকের ওই প্লেটটা তুলে ফেলল...’

‘মিস্টার মুনিম, আপনি যদি...’

আমি বলছি, নিজের চোখে দেখলাম প্লেটটা সে তুলে ফেলল,’ বললেন মুনিম সাহেব।

বোকার মতো চেহারা নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন পাইলট, এর আগে স্টুয়ার্ডেস যেভাবে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন সেভাবে তাকিয়ে আছেন।

মুনিম সাহেব কথা বলার সময় কাঁপতে লাগলেন। ‘শুনুন, আমি  দেখেছি তাকে!’ চিৎকার প্রচণ্ড হওয়াতেই তাঁর গলা ভেঙে গেল, সেটা লক্ষ করে পাইলট কাতর হয়ে পড়লেন।

এক মুহূর্তে মুনিম সাহেবের পাশে চলে এলেন তিনি। ‘মিস্টার মুনিম, প্লিজ,’ বললেন তিনি। ‘ঠিক আছে, আপনি দেখেছেন তাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্লেনে আরও প্যাসেঞ্জার আছেন। ওঁদের অস্থির করা আমাদের উচিত নয়।’

এতটাই ঘাবড়ে গেছেন, পাইলট কী বলতে চাইছেন প্রথমে সেটা ‌ঠিক ধরতে পারলেন না মুনিম সাহেব। ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, লোকটাকে আপনি দেখেছেন?’ চোখে-মুখে সংশয় আর অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলেন তিনি।

‘অবশ্যই,’ বললেন পাইলট। ‘কিন্তু আমরা প্যাসেঞ্জারদের ভয় পাওয়াতে চাই না। এটা তো আপনি বোঝেনই।’

‘অবশ্যই, অবশ্যই। আমি চাই না...’

মুনিম সাহেবের পেটের ভেতরটা হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে উঠল, বিশেষ করে নিচের দিকটা যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁর ঠোঁট পরস্পরের সঙ্গে চেপে ধরে পাইলটের দিকে তাকালেন। ‘আমি বুঝেছি,’ বললেন তিনি।

‘আমাদের যে কথাটা মনে রাখতে হবে,’ শুরু করলেন পাইলট।

‘আমরা এবার থামতে পারি,’ বললেন মুনিম সাহেব।

‘স্যার?’

 ঝাঁকি খেলেন মুনিম সাহেব। ‘আপনি এখান থেকে চলে যান,’ বললেন তিনি।

‘মিস্টার মুনিম, কি—?’

‘আপনি চুপ করবেন?’ মুখ সাদা, পাইলটের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, চোখ পাথরের মতো হয়ে আছে।

হঠাৎ পাইলটের দিকে কটমট করে তাকালেন। ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি আর একটা শব্দও উচ্চারণ করব না!’ প্রায় ধমকের সুরে বললেন।

‘মুনিম সাহেব, আপনি আমাদের অবস্থাটাও বোঝার চেষ্টা...’

মোচড় খেয়ে সরে গেলেন মুনিম সাহেব, দৃষ্টিতে প্রবল হিংস্র ভাব এবং অঢেল বিষ নিয়ে তাকালেন ইঞ্জিনের দিকে। তিনি তাঁর দৃষ্টিসীমার এক কোণে দুজন প্যাসেঞ্জারকে দেখতে পেলেন, আলে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ওরে গাধারা! বিস্ফোরিত হলো তাঁর মন। অনুভব করলেন হাত দুটো কাঁপছে, বমি করে ফেলেন কিনা ভয় পাচ্ছেন। কিছু না, নড়াচড়া, ভাবলেন তিনি। ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের মতো দুলছে প্লেন, এদিক সেদিক কাত হয়ে পড়ছে।

 মুনিম সাহেব বুঝতে পারলেন এখনো তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন পাইলট। চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে জানালার কাচে তাকালেন, পাইলটের প্রতিফলন দেখছেন। পাইলটের পাশে গম্ভীর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্টুয়ার্ডেস। গর্দভ! ভাবলেন তিনি—ওরা দুজনেই। তাঁরা যে ফিরে যাচ্ছেন, ভান করলেন সেটা তিনি খেয়াল করছেন না। কাচের ওপর চোখ রেখে দেখছেন আল ধরে কেবিনের শেষ মাথার দিকে চলে যাচ্ছেন দুজন। ওরা আমার কথাই আলোচনা করছে, ভাবলেন। প্ল্যান তৈরি করছেন, আমি হিংস্র হয়ে উঠলে কী করা হবে।

মুনিম সাহেবের চিন্তাভাবনা পাল্টে গেছে। এখন তিনি চাইছেন লোকটা আবার আসুক, এসে ওই ইঞ্জিনটা নষ্ট করে ফেলুক। তা ঘটলে প্রতিশোধ নেওয়ার আনন্দসহ এ রকম একটা সন্তুষ্টি উপভোগ করতে পারবেন যে প্রায় চল্লিশ জন আরোহী আর মাঝ আকাশে প্লেন দুর্ঘটনার মাঝখানে একমাত্র তিনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। তিনি যদি ইচ্ছে করেন তাহলে দুর্ঘটনাটা ঘটবে। নীরস হাসি দেখা গেল মুখে। রাজকীয় একটা আত্মহত্যাও হবে, ভাবলেন তিনি।

খুদে লোকটা আবার কোথাও থেকে ঝুপ করে ডানার ওপর পড়ল। মুনিম সাহেব দেখলেন তিনি যা ভেবেছিলেন সেটাই সত্যি হয়েছে—লাফ দিয়ে চলে যাওয়ার আগে প্লেটটা জায়গামতো বসিয়ে রেখে গিয়েছিল লোকটা। কারণ দেখা যাচ্ছে নখ দিয়ে প্লেটটা আবার তুলতে চেষ্টা করছে সে। ব্যাটার নখ কি ইস্পাতের তৈরি যে এত শক্ত? প্লেট তো বেশ সহজেই উঠছে, ছাড়ানো ছালের মতো উল্টেও যাচ্ছে। ডানার নড়াচড়া খুবই ভাঙা ভাঙা, কিন্তু ওটার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে ওই লোকের কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না।

আরও একবার আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন মুনিম সাহেব। অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। আরও চেষ্টা করতে গেলে পাগল মনে করে বেঁধে ফেলতেন ওঁরা তাঁকে। হ্যাঁ, স্টুয়ার্ডেসকে তিনি আরেকবার বলতে পারতেন পাশে বসুন, অন্তত কিছুক্ষণ বসে থাকুন। কী লাভ হতো তাতে? সাময়িক রেহাই পাওয়া যেত। তারপর? স্টুয়ার্ডেস চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরে আসত লোকটা। কিংবা পাশে বসে থাকলেন তিনি, কিন্তু বসে বসে ঘুমিয়ে পড়লেন—সঙ্গে সঙ্গে ওই অভিশাপ ফিরে আসত আবার। এমনকি স্টুয়ার্ডেস পাশে বসে যদি জেগেও থাকেন, ওই লোককে কে বাধা দেবে দ্বিতীয় ডানার ইঞ্জিনটা নাড়াচাড়া করতে?

ভয়ে কেঁপে উঠলেন মুনিম সাহেব। ও আল্লাহ্‌, কারও কিছু করার নেই! জানালার দিকে ফিরলেন আবার, যে জানালায় তাকালে খুদে লোকটাকে দেখতে পান তিনি, আর তাকাতেই দেখতে পেলেন পাইলটকে—তাঁর প্রতিবিম্ব—কাচের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সরে যাচ্ছে।

এটা এক পাগল করা মুহূর্ত। মুনিম সাহেবকে ভেঙে প্রায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ওই খুদে মানুষ আর পাইলট, পরস্পরের কাছ থেকে মাত্র ক’ফুট দূরে, দুজনকেই দেখতে পাচ্ছেন তিনি, কিন্তু ওরা দুজন পরস্পর সম্পর্কে সচেতন নয়। না, তাঁর এই চিন্তাটা ভুল। পাইলট যখন চলে যাচ্ছে, খুদে লোকটা কাঁধের ওপর দিয়ে সেদিকে তাকাল। সে যেন জানে এখন আর লাফ দিয়ে চলে যাওয়ার দরকার নেই, মুনিম নামে পাগলটার নাক গলানোর সামর্থ্য ফুরিয়ে গেছে।

হঠাৎ প্রচণ্ড রাগে দাঁতে দাঁত পিষছেন মুনিম সাহেব। ভাবলেন, ওটাকে আমি খুন করব! নোংরা একটা জন্তু, তোকে আমি মেরে ফেলব!

বাইরে খক খক করে উঠল ইঞ্জিন, ভাবটা এই থেমে গেল, কিন্তু থামছে না।

এক কি দুই সেকেন্ডের ব্যাপার, কিন্তু ওই অল্প সময়ের ভেতরই মুনিম সাহেবের মনে হলো থেমে গেছে তাঁর হার্টও। জানালার কাচে কপাল চেপে ধরে তাকিয়ে আছেন। লোকটা ইঞ্জিনের ঢাকনিকে পেছন দিকে অনেকটাই বাঁকিয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তে ডানার ওপর হাঁটু গেড়ে রয়েছে, ইঞ্জিনের ভেতর ঢোকাচ্ছে একটা কৌতূহলী হাত।

‘মাফ চাই, না!’ নিজের গলার ফোঁপানি শুনতে পেলেন মুনিম সাহেব। ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, এ কাজ তুমি করো না!’

ইঞ্জিন আবার খকখক আওয়াজ করল। আতঙ্কিত মুনিম সাহেব বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছেন। এরা সবাই কি কালা? স্টুয়ার্ডেসকে ডাকার জন্য বোতামের ওপর আঙুল নিয়ে গেলেন, পরমুহূর্তে এক ঝটকায় টেনে নিলেন হাত। না, এবার ওরা তাঁকে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেবে। মেরে হাড়গোড় গুঁড়ো করলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

অথচ একমাত্র তিনিই জানেন কী ঘটছে, একমাত্র তাঁর পক্ষেই সাহায্য করা সম্ভব।

‘আল্লাহ...’ ব্যথায় ফুঁপিয়ে না ওঠা পর্যন্ত নিচের ঠোঁট কামড়ালেন। আবার মোচড় খেয়ে ঘুরলেন, ঝাঁকি খেলেন স্টুয়ার্ডেসকে দেখতে পেয়ে। আল দুলছে, সেটা ধরে ছুটে আসছেন মেয়েটি। তার মানে উনিও শুনতে পেয়েছেন!

স্টুয়ার্ডেসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মুনিম সাহেব, দেখলেন পাশ কাটানোর সময় তাঁর দিকে একবার তাকালেন। আরও তিনটি সিটকে পেছনে ফেলার পর থামলেন স্টুয়ার্ডেস। মুনিম সাহেব ভাবলেন, তার মানে আরও কেউ শুনেছে!

মুনিম সাহেব দেখছেন স্টুয়ার্ডেস ঝুঁকে দৃষ্টিপথের বাইরে থাকা কোনো প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলছেন।

এই সময় বাইরে আবার খকখক করে উঠল ইঞ্জিন। ঝাঁকি খেয়ে ঘুরলেন মুনিম সাহেব, আতঙ্ক ভরা চোখে তাকালেন। ‘জাহান্নামে যা তুই! মর! মর!’ গুঙিয়ে ওঠার সুরে বললেন।

আবার ঘাড় ফেরালেন। দেখলেন ফিরে আসছেন স্টুয়ার্ডেস। চেহারা দেখে মনে হলো না মেয়েটা ঘাবড়ে গেছেন বা সতর্ক। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন মুনিম সাহেব। এটা সম্ভব না। টলোমলো ভঙ্গিতে হেঁটে কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন স্টুয়ার্ডেস, যেন কিছু্ই হয়নি।

‘না!’ মুনিম সাহেব এখন চেষ্টা করেও নিজের কাঁপুনি থামাতে পারছেন না। কেউ কিছু শোনেনি। কেউ কিছু জানে না।

হঠাৎ ঝুঁকলেন, সিটের তলা থেকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে কোলের ওপর তুললেন ব্যাগ। চেইন খুললেন। ব্রিফকেস বের করে কার্পেটে নামালেন। আবার ব্যাগে হাত ভরলেন, এবার বের করলেন অয়েলস্কিনের এনভেলাপ। তারপর দাঁড়ালেন।

মুনিম সাহেব চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলেন আল ধরে হেঁটে ফিরে আসছেন স্টুয়ার্ডেস মেয়েটা। জুতোর ডগা দিয়ে ঠেলা মেরে ব্যাগটা সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। তারপর বসলেন, এনভেলাপটা রাখলেন নিজের পাশে।

ওখানে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকলেন তিনি, বুকের ভেতর কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস নিয়ে, দেখলেন তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন স্টুয়ার্ডেস।

এনভেলাপটা এবার কোলের ওপর রাখলেন। সাবধানে খুলছেন। হাত স্থির রাখতে না পারায় পিস্তলটা আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিল। ঠেলে সেফটি ক্যাচ অফ করলেন। বাইরে তাকালেন একবার, অনুভব করলেন তাঁর শরীর বরফ হয়ে গেল।

তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে লোকটা।

ঠোঁট দুটো এক করলেন তিনি। তাঁর মনের ইচ্ছে ওই লোকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাহলে? লোকটা কি কারণে তাঁর দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকবে?

স্টুয়ার্ডেসের দিকে ফিরলেন তিনি। একজন প্যাসেঞ্জার তাঁর বাড়ানো হাত থেকে ট্যাবলেট নিচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে আবার বাইরে, ডানার ওপর তাকালেন। খুদে লোকটা আবার ইঞ্জিনের দিকে ঘুরে বসেছে, হাত ঢোকাচ্ছে ইঞ্জিনের ভেতরে। পিস্তল ধরা মুনিম সাহেবের হাত শক্ত হলো। ধীরে ধীরে তুলছেন ওটা।

হঠাৎ পিস্তলটা নামিয়ে ফেললেন। জানালার কাচ খুব বেশি পুরু। বুলেট আরেক দিকে ছুটে গিয়ে প্যাসেঞ্জারদের কাউকে মেরে ফেলতে পারে। শিউরে উঠে ডানার ওপর বসে থাকা খুদে লোকটার দিকে তাকালেন। আবার খকখক করে উঠল ইঞ্জিন, আগুনের এক রাশ ফুলকির বিস্ফোরণ দেখতে পেলেন মুনিম সাহেব—সেটার আলোয় জানোয়ারসদৃশ লোকটা আরও পরিষ্কার ধরা পড়ল তাঁর দৃষ্টিতে।

চোখ ঘুরিয়ে ইমার্জেন্সি ডোরের হাতল দেখলেন। হাতলের ওপর স্বচ্ছ আবরণ রয়েছে। হাত বাড়িয়ে ওটা ধরে টান দিলেন। খুলে আসতে মেঝেতে ফেলে দিলেন স্বচ্ছ প্লাস্টিক। বাইরেটা একবার দেখে নিলেন। লোকটা এখনো আছে, উবু হয়ে বসে ইঞ্জিনে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করছে।

বাঁ হাত বাড়িয়ে দরজার হাতল ধরলেন মুনিম সাহেব। নিজেকে মনে করিয়ে দিলেন, যাই করো, ভালো করে ভেবেচিন্তে দেখে নাও আগে। ওটা ইমার্জেন্সি ডোর, একবার খুললে যে তাণ্ডব শুরু হবে...

এত ভাবাভাবির সময় কোথায়! হাতলে চাপ দিচ্ছেন তিনি। ওটা নিচের দিকে নামছে না। শুধু ওপর দিকে উঠছে। হাতল ছেড়ে দিলেন, পিস্তলটা নিয়ে কোলের ওপর রাখলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে বেল্টটা ঊরুর ওপর আটকালেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে বাইরে বেরোবে বাতাস। প্লেনের নিরাপত্তার স্বার্থে, ওই বাতাসের সঙ্গে তাঁর ভেসে যাওয়া চলবে না।

পিস্তলটা আবার হাতে নিলেন। হার্টবিট শুধু বাড়ছেই। তাঁকে আকস্মিক হতে হবে, হতে হবে অব্যর্থ এবং নিখুঁত। তিনি যদি মিস করেন, লাফ দিয়ে অপর ডানায় সরে যেতে পারে লোকটা। সেটা হবে আরও মারাত্মক। ওখানে, টেইল অ্যাসেম্বিলিতে বসে, গাদা গাদা তার ছিঁড়বে সে, ফ্ল্যাপগুলো প্যাঁচাবে, নষ্ট করবে প্লেনের ভারসাম্য। না, এটাই একমাত্র উপায়। গুলিটা ওটার নিচের দিকে করবেন তিনি, যাতে বুকে কিংবা পেটে লাগে। বাতাস টেনে ফুসফুস ভরে নিলেন মুনিম সাহেব।

এখন, ভাবলেন তিনি। এখন।

ইমার্জেন্সি ডোরের হাতল ধরে টানতে শুরু করেছেন মুনিম সাহেব, এই সময় দেখা গেল আল ধরে হেঁটে আসছেন স্টুয়ার্ডেস। মুহূর্তের জন্য, একটা পা তোলা অবস্থায় জমে পাথর হয়ে গেছেন, কোনো শব্দ করতে পারলেন না। তাঁর চেহারায় স্তম্ভিত আতঙ্ক ফুটে উঠল, একটা হাত তুললেন তিনি, যেন মিনতি করছেন—দয়া করে এ কাজ করবেন না! তারপর, হঠাৎ করে, ইঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল তাঁর চিৎকার, ‘মুনিম সাহেব, না!’

‘পিছু হটেন!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মুনিম সাহেব, হাতলটা ঠেলে তুলে দিলেন ওপর দিকে।

চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেছে দরজা। এক সেকেন্ড আগেও ওটা তাঁর পাশে, তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল। এক সেকেন্ড পর ওটা নেই। ওই একই মুহূর্তে মুনিম সাহেব অনুভব করলেন রাক্ষসতুল্য একটা শক্তিশালী শোষণ সিট থেকে ছিঁড়ে নিতে চাইছে তাঁকে। কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল তাঁর মাথা আর কাঁধ। অকস্মাৎ দেখা গেল বরফ শীতল বাতাস নিচ্ছেন ফুসফুসে। মুহূর্তের জন্য মনে হলো ইঞ্জিনের গর্জন তাঁর কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে। বাতাসের চাপ এত বেশি, সন্দেহ হলো চোখ গলে যাবে। এবং এত কিছুর মধ্যে, লোকটার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন তিনি।

তারপর ওটাকে দেখতে পেলেন।

ডানার ওপর হাঁটছে। গাঁটবহুল মূর্তিটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, লম্বা নখরসহ বাঁকানো হাত দুটো ব্যগ্র ব্যাকুল ভঙ্গিতে সামনে বাড়ানো। হাত তুলে আর দেরি নয়, গুলি করলেন মুনিম সাহেব। সগর্জন বাতাসের ভেতর গুলির আওয়াজটা পটকা ফাটার মতো শোনাল। লোকটা ঝাঁকি খেল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত চালাল। মাথার পাশে ব্যথা অনুভব করলেন মুনিম সাহেব। একদম কাছ থেকে আবার গুলি করলেন তিনি। লোকটাকে পেছন দিকে বেঁকে যেতে দেখলেন। ডানার কিনারায় টলমল করল এক মুহূর্ত, তারপর খসে পড়ল। খসে পড়ল নিরেট কিছুর মতো নয়, কাগজের তৈরি পুতুলের মতো, বাতাসের তোড়ে কোথায় উড়ে গেল কে জানে।

মগজে অসাড় একটা ভাব নিয়ে মুনিম সাহেব অনুভব করলেন তাঁর অবশ আঙুল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো পিস্তলটা। তারপর সবকিছু শীতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ছটফট করছেন তিনি, গোঁ-গাঁ আওয়াজ করছেন। শিরায় উষ্ণ কি যেন অনুভব করলেন, হাত আর পা দুটোকে মনে হলো কাঠের তৈরি। অন্ধকারের ভেতর নানা ধরনের খসখসে আওয়াজ শুনতে পেলেন। কে বা কারা যেন অস্পষ্ট গলায় কী সব বলছে। শুয়ে আছেন তিনি, মুখ উঁচু করে, যেটার ওপর শুয়ে আছেন সেটা যেন সচল—একটু একটু ঝাঁকি খাচ্ছেন। ঠান্ডা বাতাস লাগল মুখে। নিজের নিচে জমিন বা সারফেস ঢালু হয়ে নেমে গেছে বলে মনে হলো তাঁর।

বড় করে শ্বাস ফেললেন। প্লেন ল্যান্ড করেছে, তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাথায় যে চোটটা পেয়েছেন, আর একটা ইনজেকশন, দুটো মিলে শান্ত রেখেছিল তাঁকে।

‘আত্মহত্যা করতে চাইবি, কর, তাই বলে ধরনটা এমন উদ্ভট হতে হবে?’ কোথাও থেকে কেউ একজন বললেন।

মুনিম সাহেব আপন মনে মুচকি মুচকি হাসছেন। তাঁর মনটা ভরে আছে আনন্দে। কথাটা যেই বলে থাকুন, অবশ্যই তিনি ঠিক বলেননি। তাঁর মাথার চোট আর ইঞ্জিনটা পরীক্ষা করা হলে আসল সত্য পরিষ্কার হয়ে যাবে।

তখন ওঁরা বুঝতে পারবেন তিনি ওঁদের সবাইকে বাঁচিয়েছেন। 

বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে

অলংকরণ: মেহেদী হক