ছোট্ট একটা বাঘের গল্প

মুস্তাফিজুর রহমান
মুস্তাফিজুর রহমান

সুন্দরবন নামটা শুনলেই বিশাল একটা জঙ্গলের কথা মনে হয়। যেন এই জঙ্গলের মাঝে কোথাও কোনো ফাঁক নেই।

কিন্তু কী জানো, সুন্দরবনের মাঝে মাঝে ছোট ছোট খোলা মাঠ আছে; দূর থেকে দেখলে খেলার মাঠ বলে মনে হয়। এখানে কারা খেলে? কারা বনের মাঝে এই মাঠগুলোতে ব্যাট-বল নিয়ে ছোটে!

এর উত্তর আমিও জানি না। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, সুন্দরবনের বাঘগুলো এসব খোলা মাঠে মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলে। না হলে সুন্দরবনের কোল থেকে এমন করে ছোট্ট একটা বাঘ মিরপুরে চলে আসে কী করে!

হ্যাঁ, মুস্তাফিজুর রহমান নামে ছোট একটা বাঘের কথা বলছিলাম। মুস্তাফিজদের বাড়ি আসলেই প্রায় সুন্দরবনের মধ্যে। সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ থানায় জন্ম মুস্তাফিজের। সেখানেই বড় হয়ে উঠেছেন; এই বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত জীবনটা ওই কালীগঞ্জের তেঁতুলিয়া গ্রামেই কেটেছে।

এই বরেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠেই কেটেছে মুস্তাফিজের শৈশব
এই বরেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠেই কেটেছে মুস্তাফিজের শৈশব

তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে সাতক্ষীরা শহরে আসতে যত সময় লাগে, তার চেয়ে কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। দাদা-নানার কাছে শুনেছেন, তাঁর জন্মের আগে তাঁদের গ্রামে বসেই নাকি বাঘের ডাক শোনা যেত। তবে আফসোস, তিনি নিজে কখনো বাঘের ডাক শোনেননি।

বাঘের ডাক তিনি শুনুন আর না-ই শুনুন; ভারতকে অন্তত বাঘের ডাক শুনিয়ে দিয়েছেন।

তেতুলিয়া মিলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মুস্তাফিজ এই মাঠেই খেলেছেন ক্রিকেট
তেতুলিয়া মিলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মুস্তাফিজ এই মাঠেই খেলেছেন ক্রিকেট

মুস্তাফিজ বল হাতে কী করেছেন, তা এতক্ষণে তোমরা নিশ্চয়ই জেনে ফেলেছ। সবাই জানো, তারপরও একটু বলেই নিই। ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে যে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নামল বাংলাদেশ, তার প্রথম ম্যাচে জীবনের প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমেছিলেন মুস্তাফিজ।

প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই পাঁচটা উইকেট তুলে নিয়েছেন। এটা এমন কোনো বিশাল ব্যাপার নয়। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন অনেকেই। তবে আসল কাজটা করলেন পরের ম্যাচে। এবার নিলেন ছয উইকেট। এতে অনেক রেকর্ড হয়ে গেল। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই পাঁচটা বা তার বেশি উইকেট নেওয়া দ্বিতীয় বোলার হয়ে গেলেন। আর তৃতীয় ওয়ানডেতে....

আমরা তো শুধু এসব রেকর্ড দেখছি; কিন্তু পণ্ডিতেরা বলছেন, মুস্তাফিজকে শুধু এই উইকেট সংখ্যা দিয়ে চেনা যাবে না। যে বল তিনি করছেন, তাকে ইতিমধ্যে রহস্য-বলও বলা শুরু হয়ে গেছে। সে যাই হোক, এসব বলের রহস্য-টহস্য নিয়ে পণ্ডিতেরা ভাবুন; আমরা ভেবে দেখি সুন্দরবনের বাঘ ঢাকায় এল কী করে!

মুস্তাফিজরা চার ভাই।

এই তোমার-আমার মতো আরকি। গ্রামের বাড়ির উঠোনে শীতকালে রাতে ব্যাডমিন্টন, দুপুরে টেনিস বলের ক্রিকেট আর বর্ষাকালে ফুটবল খেলে কাটত সময়। মাঝে মাঝে পাশের স্কুলের মাঠেও খুব ক্রিকেট-ফুটবল চলত। এর মধ্যে মুস্তাফিজের সেজো ভাই দেখলেন, ছোট ভাইটা তাঁর দারুণ ফাস্ট বল করে।

বলে গতি নেই বিরাট কিছু; কিন্তু বাঁ হাতে আস্তে করে যে বলটা করে, তা কেউ খেলতে পারে না।

এই সেজো ভাই, মানে মোখলেসুর রহমান এলাকায় বেশ নামকরা ব্যাটসম্যান ছিলেন; ছিলেন কেন, এখনো আছেন। স্থানীয় রাজাপুর আরপি সংঘ নামে একটা ক্লাবও আছে তাঁদের। সেই ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যেতেন, অন্য ক্লাবের হয়েও ‘খ্যাপ’ খেলতে যেতেন।

মুস্তাফিজের বাবা আবুল কাসেম গাজী ও সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান
মুস্তাফিজের বাবা আবুল কাসেম গাজী ও সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান

ছোট ভাইটার বাঁহাতি বোলিং নজরে আসার পর মোখলেসুর রহমান বিভিন্ন জায়গায় ভাইকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। অল্প কদিনের ভেতর টের পেয়ে গেলেন, এই ছোট ভাইটা তাঁর আসলে অনেক বড় ক্রিকেটার। এবার তাঁকে নিয়ে চললেন সাতক্ষীরা শহরে। সেখানে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট শুরু করলেন ছোট ভাইটা; মানে মুস্তাফিজুর রহমান।

জেলা পর্যায়ে ক্রিকেট খেলতে গেলে রোজ অনুশীলন করা চাই। কিন্তু ৪৫ কিলোমিটার দূরের শহরে রোজ ভোরে, বিশেষ করে শীতের ভোরে কী করে যাবেন মুস্তাফিজ। আবারও মোখলেসুর রহমান এগিয়ে এলেন। নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে কনকনে ঠান্ডায় ভোররাতে রওনা হতেন ভাইকে পেছনে বসিয়ে।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের বাড়িতে মুস্তাফিজের বাবা-মা অন্যান্য আত্মীয় স্বজন
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের বাড়িতে মুস্তাফিজের বাবা-মা অন্যান্য আত্মীয় স্বজন

ভাইয়েদের এই প্রবল চেষ্টায় জেলা পর্যায়ে মুস্তাফিজ নাম করে ফেললেন; বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতায় ঠাঁইও পেয়ে গেলেন। আর এখানেই চোখে পড়লেন জাতীয় পর্যায়ের কোচদের। ঢাকায় ফাস্ট বোলিং ট্রায়ালে ডাকা হলো মুস্তাফিজকে। পাশাপাশি জাতীয় দলের নেটেও বল করতে বলা হলো। ব্যস, বদলে গেল মুস্তাফিজের জীবন।

বরেয়ার নব জীবন ক্লাবের মুস্তাফিজের বন্ধুরা
বরেয়ার নব জীবন ক্লাবের মুস্তাফিজের বন্ধুরা

জাতীয় দলের কোচ, নির্বাচক, ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজারদের চোখে পড়লেন তিনি। তাঁকে নিয়ে টুকটাক কাজ শুরু হলো। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়লেন জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের। না চেনা এই ছেলেটির বল খেলতে গিয়ে নেট অনুশীলনে খুবই বিভ্রাটে পড়লেন তারকা ব্যাটসম্যানরা। তাঁরাই বললেন, একে চাই।

জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের অনুশীলনে আরও দুর্ভোগে ফেলতে আবিষ্কার করে ফেললেন এখন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত অস্ত্র অফ কাটার। মুস্তাফিজ নিজেই বলছিলেন, ‘একদিন বিজয় ভাই (এনামুল হক বিজয়) বললেন, তুই স্লোয়ার করে এভাবে বল করতে পারবি। আমি করলাম। উনি আউট হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, এটা অনেক ভালো বল।’

মুস্তাফিজের এই বলটা যে অনেক ভালো বল, তা এখন তো সারা পৃথিবীই জানে!

ঢাকার এই মাঠেই জীবনের প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমে জাত চিনিয়েছেন মুস্তাফিজ
ঢাকার এই মাঠেই জীবনের প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমে জাত চিনিয়েছেন মুস্তাফিজ

ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি