কন্যাদের মধ্যে মোগল সম্রাট শাজাহানের প্রিয় ছিলেন জাহানারা। প্রথম জীবনে মোগল সাম্রাজ্যে সম্রাটের প্রিয়তম কন্যা জাহানারার মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশি। শেষ জীবনে অবশ্য জাহানারার জীবন কেটেছে অন্ধকার কারাগারে। ভাই সম্রাট আলমগীর বা আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যে জাহানারার সেই মর্যাদা আর ছিল না। সে অন্য গল্প। বরং আমাদের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় গল্পটাই বলি। কেউ কেউ বলেন , জাহানারা নিজেই আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে। একদিন সুগন্ধি মাখতে গিয়ে আগুনে ভীষণ রকম পুড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আবার অনেকে বলেন, জাহানারা নন, আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন তাঁরই একজন প্রিয় বাঁদি। আর তাকে বাঁচাতে গিয়ে শাহজাদি জাহানারা নিজে দগ্ধ হন। জাহানারার জীবন সংশয় দেখা দিল। নানাভাবে চিকিৎসা করিয়েও লাভ হলো না। অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকল।
ঘটনাটির খুব ভালো বিবরণ আছে যাযাবরের বিখ্যাত উপন্যাস দৃষ্টিপাত-এ। লেখকের কল্পনায় ঘটনাটি ছিল এ রকম: বিচলিত শাহজাহান এত্তালা দিলেন এক সাহেব চিকিৎসককে। গ্যাব্রিয়েল বাউটন। সুরাটে ইংরেজ কুঠির ডাক্তার। বাউটন বললেন , ওষুধ দেওয়ার আগে রোগিণীকে দেখা চাই।...শেষ পর্যন্ত পিতৃস্নেহের কাছে হার মানল সামাজিক প্রথা। শাহজাহান সম্মত হলেন বাউটনের প্রস্তাবে। অল্পকাল মধ্যে আরোগ্য লাভ করলেন জাহানারা। তাঁর অনুরোধে শাহজাহান বাউটনকে দিতে চাইলেন পুরস্কার—যা চাইবে, তা-ই পাবে।
আভূমিনত কুর্নিশ করে বাউটন বললেন, নিজের জন্য কিছুই চাইনে। কলকাতার এক শ চল্লিশ মাইল দক্ষিণে বালাসোরে ইংরেজের কুঠি নির্মাণের জন্য প্রার্থনা করি এক টুকরো ভূমিখণ্ড। ইংরেজকে দান করুন এ দেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার। বাউটনের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। সময়টা ছিল ১৬৫০ সাল।
প্রশ্ন করতে পারো, এত কিছু থাকতে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার কেন চাইলেন ইংরেজ ডাক্তার। কারণ, ব্যবসা করার জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ সে সময়ে আর ছিল না। এতে নিশ্চিত মুনাফা। কারণ, এখনো মুনাফা ঠিক হয় কর দেওয়ার পর। আর যদি শুল্ক বা কর দিতে না হয়, তাহলে তো পুরোটাই লাভ।
ইতিহাস বলে, ইংরেজরা সেই যে এ দেশে ঢুকল, আর বের হলো ১৯৪৭ সালে। এর আগে ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক রাজকীয় সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। মূলত এটি ছিল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রাথমিক অবস্থায় এ কোম্পানি দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করে। ১৬৩৩ সালে তারা উড়িষ্যায় পৌঁছায় এবং হরিহরপুর ও বালাসোরে কুঠি স্থাপন করে। এরপরেই সম্রাট শাজাহান তাদের শুল্ক অব্যাহতি দেন।
আমরা সবাই জানি এরপরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপ। এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছেই পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতা হারিয়েছিলেন। তারপর একসময় এই কোম্পানিটি পুরো ভারতবর্ষই অধিকার করে নেয়। সবকিছুরই পেছনে ছিল মূলত অর্থনীতি। এর ব্যাখ্যাও আছে। সেটা বলি। ইংরেজরা বিনা শুল্কে ব্যবসা করতে শুরু করায় তারা অন্যদের তুলনায় প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে থাকার সুযোগ পায়। কারণ , অন্যদের ব্যবসা করতে হতো শুল্ক বা কর দিয়েই। এতে অন্য যে ব্যবসায়ীরা ছিলেন , তাঁরা লোকসানে পড়েন। অনেকেই বাধ্য হন ব্যবসা বন্ধ করে দিতে। ফলে একসময়ে দেশীয় ব্যবসায়ীশ্রেণি ক্রমেই বিলীন হতে থাকে। তখন টিকে থাকতে দেশের ব্যবসায়ীরা নতুন এক ব্যবসা শুরু করলেন। তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে লগ্নি -বাণিজ্য শুরু করেন। অর্থাৎ , তাঁরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অর্থ ধার দেওয়া শুরু করেন। এর বিনিময়ে পেতেন সুদ। কোম্পানির শেয়ারে তাঁরা বিনিয়োগ করা শুরু করেন।
আমরা যাকে কোম্পানির কাগজ বলি, সেগুলো আসলে এসবই।
একটু বুঝিয়ে বলি। ধরো বিদেশি ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশে এসে বললেন, তাঁরা এখানে একটা সিমেন্ট কারখানা করবেন। অনুমোদন দেওয়া হলে তাঁরা কি সব অর্থ নিজের দেশ থেকে আনবেন? মোটেই তা নয়। তাঁরা এখানকার ব্যাংক থেকেই ঋণ নেবেন, অথবা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলবেন। সেই অর্থ বিনিয়োগ করে যে আয় করবেন, সেখান থেকেই ঋণ পরিশোধ করবেন। এভাবেই চলে সবকিছু। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তা -ই করত। তখন তো ব্যাংক বা শেয়ারবাজার ছিল না। ছিল কোম্পানির কাগজ। এর মাধ্যমে তাদের অর্থ ধার দিতেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ঐতিহাসিকেরা বলেন, সে সময়ে অর্থলগ্নিকারী সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন মূলত তিনজন। আরও ছোট ছোট ব্যবসায়ী থাকলেও বড় ছিলেন তাঁরাই। যেমন মাড়োয়ারি জগৎ শেঠ পরিবার, কলকাতার আরেক মাড়োয়ারি উমিচাঁদ এবং মুর্শিদাবাদের আর্মেনীয় বণিক খাজা ওয়াজিদ। এর মধ্যে জগৎ শেঠের কিন্তু নিজস্ব টাঁকশাল ছিল। একসময়ে জগৎ শেঠরা ব্যাংকও দিয়েছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে সমস্যা ছিল মূলত নবাব আলিবর্দি খানের সময় থেকেই। তবে চূড়ান্ত বিরোধ দেখা দেয় তাঁরই দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় বসার পর থেকে। তিনি এসে ইংরেজদের অতিরিক্ত আধিপত্য আর সহ্য করলেন না। কারণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না , রাজনীতিতেও নাক গলাতে শুরু করে। পুরো একটি ক্ষমতাবলয় তৈরি করে তারা।
সবচেয়ে বড় কথা, বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার সুযোগেরও ব্যাপক অপব্যবহার করে। এ নিয়ে বিরোধ চরম আকারে ধারণ করলে বাংলার নবাব কলকাতা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে দেন। বিতাড়িত ইংরেজরা আশ্রয় নেয় মাদ্রাজে। বাংলা থেকে ইংরেজ চলে গেলে সমস্যায় পড়েন জগৎ শেঠরা। তাঁদের লগ্নি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ে যান। তখন তাঁরা চেষ্টা চালাতে থাকেন কীভাবে আবার ইংরেজদের ফিরিয়ে আনা যায়। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা ও সহায়তাকারী ছিলের জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ ও খাজা ওয়াজিদ। জগৎ শেঠ দলে নিয়ে আসেন সেনাপতি মীর জাফরকে। এরপরেই সেই ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ, সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, মৃত্যু এবং এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশের শুরু। আর সবকিছুরই শুরু হয়েছিল সম্রাট শাজাহানের দেওয়া সেই বিনা শুল্কে ব্যবসার অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। দেখলে তো , ইতিহাসের গল্প আসলে অর্থনীতিরও গল্প।