পাপেটনাচের ইতিকথা

এক বাসায় একজোড়া মোজা ছিল। তারা ছিল দুই ভাই। এক সকালে ডান পায়ের মোজা ভাই দেখে বাঁ পায়ের মোজা ভাই নেই। গেল কোথায়? ডান পায়ের মোজা ভাই তো বয়সে ছোট। বড় ভাইকে ছাড়া তার কেমন জানি ভয় ভয় লাগে। ভাইকে না দেখে সে হয়রান হয়ে গেল। পাশেই ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দুই গোলাপি মোজা বোন। তাদের সে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার ভাইটিকে দেখেছ?’ গোলাপি মোজা বোনের একজন উত্তর দিল, ‘তোমার ভাইকে ধুতে নিয়ে গেছে। এত ভাই-ন্যাওটা হয়েছ তুমি। ধুতে যে তোমাকে নেয়নি, সেটাই ভালো। ধোয়ার সময় যা কষ্ট হয়!’

‘কোথায় নিয়ে গেছে?’ কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞেস করে ডান পায়ের মোজা ভাই। তখন গোলাপি মোজা আবার ফোড়ন কাটে, ‘গুগল করলেই পারো!’, বলেই দুই গোলাপি মোজা বোন হাসতে থাকে। এদিকে মোজা ভাইটি কাঁদতে কাঁদতে সারা ঘরে ঘুরতে থাকে আর তার ভাইকে খুঁজতে থাকে। একসময় সেই মোজার মালিকের চোখে পড়ে মোজাটি। সে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই তো আরেকটা মোজা। খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।’ সে মোজাটিকে একদম পুড়ে দেয় ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে। ভাইটির তখন অনেক কান্না পেয়ে যায়। কেমন আজব এক বাক্সে বন্দী হয়েছে সে! তার কান্না শুনে তখন পাশ থেকে জবাব এল, ‘কাঁদছিস কেন? আমি তো এইখানেই।’ ভাইকে দেখে খুশি তো আর ধরেই না ডান পায়ের মোজা ভাইয়ের!

ব্রিটেনের একটি পাপেট শোতে মেতে উঠেছে শিশুরা
ব্রিটেনের একটি পাপেট শোতে মেতে উঠেছে শিশুরা

ইউটিউবে এ রকম অনেক পাপেটের ছোট গল্প পাওয়া যায়। আঙুল, মোজা, পেনসিল কিংবা পুতুল দিয়ে নানানভাবে তৈরি করা হয় পাপেট শো। এসব পুতুল বা পাপেট প্রথম কোথায় আবিষ্কার করা হয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে নাকি মিসরে প্রথম কাঠের পুতুল তৈরি করা হয়েছিল। সুতোয় বাঁধা থাকত পুতুলগুলো। পর্দার আড়াল থেকে দু-একজন মানুষ সেসব সুতো নাড়িয়ে-চাড়িয়ে পুতুলগুলোর অঙ্গভঙ্গি তৈরি করত। এভাবে একটি কাহিনি উপস্থাপন করা হতো দর্শকদের সামনে। মূলত তাদের রীতিনীতি, সংস্কৃতি অন্যদের কাছে তুলে ধরার জন্যেই তৈরি করা হয়েছিল এই পাপেট শো। কোনো কোনো উত্স বলে ভারতে এর জন্ম। মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি নাকি পাপেট শোর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো। জাপানিদের পাপেট শোর গল্পটা আবার একটু ভিন্ন। তখনকার সময় নাকি জাপানি জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীরা একটু বেশি পারিশ্রমিক নিতেন। এ জন্য কাঠের পুতুল দিয়ে গল্প উপস্থাপন শুরু করেন অনেক নির্মাতা, যা পরে জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে বিনোদনের। পাপেট শো হতো প্রাচীন গ্রিসেও। সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকে গ্রিসের অনেক দার্শনিক তুলে ধরেছেন এই পুতুলনাচ দিয়ে। উনিশ শতকে ইতালি, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেনসহ সব দেশেই ছড়িয়ে পড়ে এই পাপেট শো। তখন শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই থাকে না এটি, বিভিন্ন অন্তর্নিহিত বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম হয়েও দাঁড়ায় এটি।

বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনে প্রচারিত পাপেট ড্রামা বুলু-জিনিয়া ও ডাকাতদল
বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনে প্রচারিত পাপেট ড্রামা বুলু-জিনিয়া ও ডাকাতদল

আমাদের দেশেও পুতুলনাচ খুব জনপ্রিয়। তোমাদের দাদু-নানুদের কাছ থেকে এর গল্প অনেকে নিশ্চয়ই শুনেছ। শহরে তো খুব একটা দেখা যায় না। তবে গ্রামের মেলায় এখনো পুতুলনাচ দেখানো হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার করা হয় ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানটি। গান শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে ‘মিঠু’ আর ‘মন্টি’ এই দুই পুতুলের কাণ্ডকারখানা ছোটরা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে।

মুস্তাফা মনোয়ারের সৃষ্ট পারুল মন জয় করে নিয়েছে সবার
মুস্তাফা মনোয়ারের সৃষ্ট পারুল মন জয় করে নিয়েছে সবার

এবার আসি মুস্তাফা মনোয়ারের কথায়। তাঁর কথা শুনলেই মাথায় আসে ‘মনের কথা’র। হ্যাঁ, বিটিভিতে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে ছবি আঁকা শেখান তিনি, সঙ্গে থাকে পুতুল। পুতুল খেলা দেখান বলেই ছোটরা তাঁকে খেতাব দিয়েছে ‘পুতুলওয়ালা’। মনের কথার অন্যতম পাপেট বা পুতুলটির নাম ‘পারুল’। ‘পারুল’ নামটি কিন্তু হুট করেই দেওয়া হয়নি। এ নামটি ঠিক করার পেছনেও কারণ রয়েছে। ওই যে গান শুনেছ না? ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো... একটি পারুল বোন আমি তোমার’ বাংলাদেশের লোকগাথা রয়েছে এই গানে। পারুল যেভাবে সাত ভাইকে জাগিয়ে তোলে, একসময় ‘মনের কথা’র পারুলও বাংলাদেশের এই পুতুলনাচকে ফিরিয়ে আনবে,  ঐতিহ্যকে তুলে ধরবে। এই উদ্দেশ্যেই মনের কথায় পারুল নামের চরিত্রের সৃষ্টি করা হয়েছিল।

শিল্পীর তুলিতে প্রাচীন চীনের পাপেট শো
শিল্পীর তুলিতে প্রাচীন চীনের পাপেট শো

আমাদের শৈশবের বড় অংশ ঘিরেই রয়েছে পুতুল। আর আমাদের ঐতিহ্যে রয়েছে পুতুলনাচ। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটা কিন্তু কিশোর-তরুণদের হাতেও। তোমার যদি পাপেট নিয়ে আগ্রহ থাকে, তবে দেরি না করে কাজ শুরু করে দাও। এতে ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বিনোদনটাও কম হবে না!