রহস্যভেদ

গগন তাদের পাড়ায় একজন ছোটখাটো গোয়েন্দা হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছে। পাড়ার কত রকম মানুষের যে সমস্যা সমাধান করেছে তার ইয়েত্তা নেই। মুরগি চুরির রহস্য উদ্ঘাটন থেকে শুরু করে ডাইনোসর চুরির রহস্যও সে ভেদ করেছে। অবশ্য সত্যি ডাইনোসর না। একটা ডাইনোসরের বড় প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি ভাস্কর্য রতনদের বাসা থেকে চুরি হয়েছিল, সেটার রহস্যও সে ভেদ করেছিল।

তবে ইদানীং তেমন কোনো রহস্য ভেদ করতে পারছে না। আসলে সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তাই এখন আর তার তেমন আগ্রহ নেই। বরং পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। আর ঠিক তখনই একদিন পাড়ার ফজলু হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির,

     গগন দোস্ত, আছিস?

     হ্যাঁ, আছি তো। কী ব্যাপার? 

     একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি তোর কাছে।

     কী সমস্যা?

     বড় ধরনের সমস্যা।

     খুলে বল।

      হয়েছে কি, বাবার এক পরিচিত লোক বাবার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ধার করেছিল...

      হুম, তারপর?। 

     তারপর লোকটা গায়েব, তাকে আর খঁুজে পাওয়া যাচ্ছে না। 

     এটা তো হতেই পারে, লোকটা টাকা মেরে ভেগে গেছে। 

     ব্যাপারটা ঠিক তা না। লোকটা বাবার খুব পরিচিত। টাকাটা ধার করেছিল নিজের কী একটা অপারেশন করার জন্য। আমরা খবর পেয়েছি অপারেশন করেছেও, তারপর আর তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। অফিসে নেই, বাসায় নেই, কোথাও নেই। 

     খুবই স্বাভাবিক। হয়তো বিদেশ চলে গেছে। এমন ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। এ আর নতুন কী?

     না দোস্ত, তুই একটু চেষ্টা করে দেখ না লোকটাকে ধরতে পারিস কি না।... বাবার এতগুলো টাকা!

     উফ... তুই একটা পাগল। এটা আসলে কোনো গোয়েন্দা দিয়ে রহস্য ভেদ করার মতো সমস্যা না যে আমি সমাধান করব। একটা লোক ভালো মানুষ সেজে অপারেশন করার কথা বলে তোর বাবাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে টাকা নিয়ে ভেগে গেছে। এর আমি কী সমাধান করব?

     তার মানে তুই কিছু করবি না? 

     আশ্চর্য, তুই রেগে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে। আচ্ছা বল তো লোকটা কিসের অপারেশনের কথা বলেছিল?

     তা তো জানি না। বাবাকে বলেছিল জটিল অপারেশন। 

     কেন হসপিটাল?

     যদ্দুর মনে হয় সিটি সেন্টার হসপিটাল।

     অপারেশনের পর খোঁজ নিয়েছিলি? 

     নিয়ে লাভ কী হতো, অপারেশন করে চলেই গেছে কবে। 

     লোকটা নাম কী? 

     মোরশেদ আকন্দ।

     দেখতে কেমন?

     এই যে ছবি নিয়ে এসেছি। ছবিটা হাতে নিয়ে গগন তাকিয়ে থাকল। একটা ভালো মানুষের ছবি। দেখে মনে হয় না এই লোক কারও পাঁচ লাখ টাকা মেরে দিতে পারে। গগন দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে এই প্রথম সে কোনো কেসে কিছু করতে পারবে না। তবে সেটা ফজলুকে বলল না। বলল,

     ঠিক আছে, তুই যা দেখি কিছু করতে পারি কি না। লোকটা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য তো দিতে পারলি না। তারপরও দেখি।

     না দোস্ত, প্লিজ তুই একটু চেষ্টা কর। বুঝিস তো বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা। 

     দেখি কী করা যায়।

ফজলু চলে গেলে পরে গগন পড়তে বসল আবার। কিন্তু মোরশেদ আকন্দের ব্যাপারটা মাথায় ঘুরতে লাগল। একটা লোক টাকা ধার করে ভেগে গেছে। এর মধ্যে আসলে কোনো রহস্য নেই। এর কী সমাধান করবে সে? আর তখনই তার মনে পড়ল আরে সিটি সেন্টার হসপিটালে তো ছোট মামা ডাক্তার। উনার কাছে কিছু তথ্য কি পাওয়া যেতে পারে? গগন ততক্ষণে বুঝে গেছে এই রহস্যের কিছু একটা করতে না পারলে তার আর পড়া হবে না। সে প্রথমে ছোট মামাকে ফোন দিল।

     ছোট মামা, আমি গগন।

     বল। 

     তুমি কি এখনো সিটি সেন্টার হসপিটালে আছো?

     আছি তো, কেন? 

     আচ্ছা মামা, তোমাদের এখানে কী কী অপারেশন হয়? 

     কেন বাপ, তোর না সামনে পরীক্ষা। তোর এখন অপারেশনের খোঁজের দরকার পড়ল কেন? আবার কোনো গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিস নাকি? 

     প্লিজ মামা, বলো না। 

ছোট মামা এক গাদা অপারেশনের নাম বলে গেল। তবে একটা অপারেশন খট করে গগনের মনে ধরল।

দ্বিতীয় ফোনটা করল ফজলুকে।

     হ্যালো ফজলু?

     কে, গগন? রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলেছিস নাকি?

     আরে না, আচ্ছা বল তো তোরা ওই লোকটার বাসায় খোঁজ নিসনি?

     হ্যাঁ, বাবা গিয়েছে, আমি গিয়েছি। বাসায় অন্য সবাই আছে কিন্তু ওই লোকটাই নেই। 

     বাসার লোকজন কি লোকটার জন্য চিন্তিত?

     না, এটাই আশ্চর্য। বাসার লোকজন খুবই স্বাভাবিক আছে। লোকটা নেই এই নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। 

     আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। কাল বিকেলে আমবাগানে আসিস। এর মধ্যে আমি আরেকটু খোঁজখবর নিই... 

     আচ্ছা। 

আমবাগান জায়গাটা গগনের বেশ প্রিয়। আমের গাছ মাত্র একটা, বেশির ভাগই অন্য গাছ। তারপরও জায়গাটার নাম আমবাগান। গগনদের বাসার কাছেই। গগন গিয়ে দেখে ফজলু আগে থেকেই বসে আছে। ফজলু বসে ছিল, গগনকে দেখে এক রকম লাফিয়ে উঠল।

     দোস্ত, পেরেছিস?

     কী?

     রহস্য উদ্ঘাটন করতে?

     মনে হয় পেরেছি।

     ওহ্‌, গ্রেট। তাহলে আমরা টাকা ফেরত পাব?

     মনে হয় না।

     কেন?

     কারণ, লোকটাকে তোরা ধরতেই পারবি না।

     মানে? কেন পারব না?

     কারণ, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি লোকটা যে অপারেশন করেছে সেটা হচ্ছে ‘প্লাস্টিক সার্জারি’। লোকটা তার চেহারা বদলে ফেলেছে! এখন তোরা পারলে লোকটাকে তার নতুন চেহারায় খুঁজে বের কর।

ফজলুর মুখটা হাঁ হয়ে যায়। গগন মুচকি হেসে বলে, ‘মুখটা বন্ধ কর, এখানে অনেক মশা। একটা-দুইটা মশা তোর মুখে ঢুকে যেতে পারে।’ ফজলুর অবশ্য মুখ বন্ধ করার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।

অলংকরণ: তুলি