সুমি অথবা রনির গল্প

গ্রামটির নাম খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু গ্রামটির যে ঘটনার কথা বলব, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরে নিই গ্রামটির নাম সখীপুর। সব  গ্রামের মতো এ গ্রামেও এক বাজার আছে, একটা দিঘি আছে। আছে একটা প্রাথমিক স্কুলও। সবাই বলে সখীপুর ইশকুল। কাগুজে নাম, সখীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। 

সেই স্কুলের ক্লাস ফাইভে নয়টি মেয়ে পড়ত। আর ১৫টি ছেলে। এভাবে ছেলেমেয়ে আলাদা করে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু গ্রামটিতে ছেলে আর  মেয়ের মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। এ নয়টি মেয়েরই আর পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই বিয়ে হওয়ার কথা। তবে ছেলেরা জীবন গড়ার জন্য আরেকটু সময় পাবে।

প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে সখীপুর স্কুলমাঠে দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। গ্রামের বয়স্করা পর্যন্ত পান মুখে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবার হলেও সে দুটি দিন এ মাঠে ঘুরতে আসে। মাইকে গান বাজে। সখীপুর স্কুলের ক্লাস ফাইভে পড়া সুমি গত তিনবার দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল একটা করে কাচের প্লেট। এবারও নাম লেখাল সে। মাকে বলল, ‘এইবার জিতলে আমাগো আরেকটা কাচের বাসন হইব।’ মা মুখ ভারী করে বললেন, ‘তুই এইবার দৌড়াইতে পারবি না। তোর বিয়ার কথা চলতাছে। তোর বাপে কাল থাইকা স্কুলে যাইতেও নিষেধ দিছেন। বিয়ার পর জামাই পড়াইলে পড়াইব। আমরা আর পড়ামু না।’

বিয়ে হলে কী হবে, সুমির সে বিষয়ে মাথাব্যথা নেই। কিন্তু দৌড়াতে পারবে না, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তার নাম মাইকে উচ্চারিত হবে না, বান্ধবীরা তার নাম ধরে স্লোগান দেবে না, এটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। সে বলল, ‘আমি দৌড়ামু।’

মা বললেন, ‘অবুঝের মতো কথা কইস না, তুই বড় হইছস না? জামাই কাতার থাকে, ট্যাকা-পয়সাঅলা, অহন দেশে আইসে, তুই দৌড়াইতে গেছস শুনলে বিয়া ভাইঙ্গা যাইতে পারে।’

‘দৌড়াইলে বিয়া ভাঙ্গনের কী আছে, আমি কাচের প্লেট পামু না? ওইটা ওগোরে দিয়া দিমুনে।’

পরদিন থেকে স্কুলে যাওয়া হলো না সুমির। বান্ধবীরা জেনে গেছে ওর বিয়ের কথা। তাদের কাছ থেকে শুনেছেন মামুন স্যার। তিনি স্কুল শেষে সুমিদের বাড়ি গেলেন।

—কই, সুমি আছ নাকি?

—হ স্যার।

—তোমার বাবা কই?

—পুকুরপাড় গেছে।

—চলো, ওনার সঙ্গে কথা বলে যাই।

পুকুরপাড়ে বসে ছাই দিয়ে দাঁত মাজছিলেন সুমির বাবা। 

—ও, মাস্টর সাব নাকি? আসসালামু আলাইকুম।

—ওয়ালাইকুম সালাম ভাই, শুনলাম সুমিরে স্কুল ছাড়াইতাছেন? ওর তো এখনো বিয়ার বয়স হয় নাই।

শব্দ করে প্রায় চার হাত দূরে থুতু ফেললেন সুমির বাবা

—মাস্টার সাব, আপনারে সম্মান করি মানে এই না, বিয়ার বয়স নিয়াও আপনের কাছ থাইকা গিয়ান নিতে হইব। সুমির মারে আমি এর চেয়েও ছোট বয়সে বিয়া করছি।

—কিন্তু এটা তো বেআইনি।

—আইন আমার মাইয়ারে চালাইব না। মাস্টার, ঘরে যান, দুইটা ডাল-ভাত মুখে দিয়া যান।

—না ভাই, আজ যাই।

হাঁটতে শুরু করে একবার ঘুরে তাকালেন মামুন স্যার। সুমির ছোট্ট মায়াকাড়া মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। শেষ যে আশার আলোটা দেখেছিল, সেটাও যে ধ্বংস হয়ে গেল এইমাত্র।

প্রতিযোগিতার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, সুমির দৌড়ানোর ইচ্ছে ততই বাড়ছে। কিন্তু ও স্কুলেই যেতে পারছে না। প্রতিযোগিতার আগের দিন রিকশা দিয়ে মাইকিং করা হয়। সারা গ্রামের মানুষের কানে পৌঁছে যাচ্ছে আগামীকালের অনুষ্ঠানের খবর। ও  সেখানে দৌড়াতে পারবে না, এটা মানতেই পারছে না। দৌড়ালে বিয়ের সমস্যা কী? বিয়ে করলে স্কুলে যেতে পারবে না কেন? স্যার সেদিন বলল, ওকে বিয়ে দেওয়া বেআইনি। বিয়ে কি খুব খারাপ জিনিস? তাহলে ওর বাবা-মা বিয়ে করেছিলেন কেন? এ রকম কত কিছুই না ভাবছিল সুমি। বসে বসে ভাবা ছাড়া এখন কিছু করারও নেই।

মাইকের আওয়াজ বাড়ছে, ওর মন খারাপের পরিমাণও বাড়ছে। ‘প্রিয় গ্রামবাসী, সুখবর! সুখবর! সুখবর! ...’

সুমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, বই-খাতা ছাড়াই স্কুলে ছুটে যায়। মামুন স্যার, বান্ধবীরা তাকে দেখে অবাক। ছেলেদের কয়েকজন ‘কদিন পরে গায়ে, সুমির হইব বিয়ে’ বলে খ্যাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ও দৌড়াবে কাল, সেটা নিশ্চিত করতেই স্কুলে এসেছে।

এদের কথা ওর গায়ে লাগছে না, কানেও ঢুকছে না। স্যার বললেন, ‘মাঠে চলো, এখন প্র্যাকটিস হইব।’  হইহই করে সবাই মাঠে গেল।

হঠাত্ দেখা গেল মাঠের দিকে ছুটে আসছেন সুমির বাবা। এসে কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে সোজা সুমির ঘাড় ধরে হাঁটা শুরু করলেন। রাগে-অপমানে চোখ লাল হয়ে গেল সুমির। চোখ ছলছল করে উঠেছে। ও কাঁদতেও পারছে না। ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। বন্ধুবান্ধবীরা কী ভাববে? আগেও বাবার কাছে সে মার খেয়েছে, তাই বলে সবার সামনে? 

মামুন স্যার, সোহেল, হাশেম, জরিনা, ময়নাদের সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুধু রনি খুশি। সে গত তিনবার সুমির জন্য দৌড়ে প্রথম হতে পারেনি। আগামীবার আর সুযোগ থাকবে না, এরপর ছেলেমেয়ের দৌড় আলাদা। এবারই যৌথ দৌড়ে প্রথম হওয়ার শেষ সুযোগ। সুমি চলে যাওয়ায় ও আশ্বস্ত হয়েছে। আগে বুঝতে পারেনি, কিন্তু গতবারই তার মনে হয়েছিল, একটা মেয়ের কাছে হারাটা ছেলে হিসেবে অপমানজনক! কেন এমন মনে হয়েছে সে জানে না। কিন্তু ছেলেরা, মেয়েদের চেয়ে বড় এটাই সে জেনেছে!

বাড়িতে গিয়ে সুমির বাবা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেন সুমিকে। তার পায়ে না হলেও ১০টা বাড়ি দিয়েছেন। একসময় ও আর কাঁদল না। বাবা মারছেন, আর ও বলছে, আমি দৌড়াব। সুমির মা আর থাকতে না পেরে ছুটে এলেন।

—আর মাইরেন না। পোলাপান মানুষ বুঝে নাই।

—চুপ করো, তুমি থাকতে ও স্কুলে গেল ক্যামনে?

সুমির মা চুপ করে গেলেন।

রাতে খাওয়ার সময়, ওর পা থেকে দড়ি খুলে দেওয়া হলো। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। হাঁটতে গিয়ে দেখল, হাঁটতে পারছে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোমতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মা সারা রাত পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়েছেন। সুমি বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল, ‘মা, আমি দৌড়ে অংশ নিমু, ফার্স্ট অইয়া প্লেট পামু। ও মা আব্বারে কও না...’

সকাল থেকে মাইক বাজছে। মামুন স্যাররা কি জানেন মাইকের আওয়াজে কী তোলপাড়টাই চলছে সুমির মনে।...কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে শিশুদের দৌড় প্রতিযোগিতা। অংশ নেবে...রনি, জাভেদ, হাশেম, কলি, রিপন, সুমি...।

সুমির কানে আর কিছু ঢুকছে না, সে আশপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এদিকে দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য লাইনে দাঁড়াল সবাই। মামুন স্যার চারপাশে সুমিকে খুঁজলেন অযথাই। কাল যা দেখেছেন, তাতে সুমির জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই।

বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। উল্লসিত দর্শকদের চোখ ২৩টি শিশুর পায়ের দিকে। কার ছেলে বা কার মেয়ে এগিয়ে, সেটাই তারা অধীর আগ্রহে দেখছে। সবার চেয়ে এগিয়ে রনি, তার বন্ধুরা চিত্কার করছে ‘রনি রনি রনি...’

মামুন স্যার হঠাত্ দেখলেন স্টার্টিং লাইন থেকে সুমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, স্যার চিত্কার করলেন, ‘এত পরে আইসা তুই পারবি না, পায়ে ব্যথা পাবি।’ সব দর্শকের চোখ এবার সুমির দিকে। এ আজিজ মিয়ার মাইয়া না? ও এত পরে আইসা দৌড় শুরু করছে ক্যান, আরে ও খোঁড়ায় ক্যান? কে শেষ ফিতা ছুঁতে যাচ্ছে, সেদিক আর কারও চোখ নেই।

...আরে এই মাইয়া তো গত কয়েকবার ফারশট হইছিল, এইবার আগে আইলো না ক্যান?

রনি দৌড় শেষ করে অবাক হয়ে শুনল, রনি রনি বলে কেউ চিত্কার করছে না, চারদিকে সুমি সুমি আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সুমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় কুঁচকে যাচ্ছে তার চোখমুখ। কিন্তু তার দৌড় শেষ করা চাই। মামুন স্যার দৌড়ে কাছে গিয়ে বললেন, ‘থাম মা, তোর পায়ের ব্যথা বাড়বে।’ ওর সেদিকে খেয়াল নেই, ও খুঁড়িয়ে ছুটেই যাচ্ছে।

সুমি সুমি আওয়াজে কান ঝালাপালা হলো সুমির বাবা আজিজ সাহেবেরও। কাছেই দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। এসে তাঁর রাগ চলে গেল। মেয়ে কাঁদছে, মামুন স্যারকে কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না, একাই সে দৌড় শেষ করবে। সমস্ত দর্শক অবাক হয়ে দেখছে এক দৃঢ়চেতা শিশুর অসাধারণ দৌড়।

আজিজ সাহেব, দৌড়ে মেয়ের পাশে গায়ে কাঁধে হাত দিয়ে ধরে বাকি পথটুকু পার করে দিলেন। সেকি হাততালি। এমন দৃশ্য তো আর প্রতিদিন দেখা যায় না।

রনির মনটা খারাপ হয়ে গেল, এবারও সে তালি পেল না। এবারও সেই সুমি। পুরস্কার নেওয়ার সময় তার পাশে ছিলেন মামুন স্যার—‘কিরে, তোর মন খারাপ ক্যান?’ ‘স্যার আমি জিতলাম, আর সবাই স্লোগান দিল সুমির নামে?’

—তুই পুরস্কার জিতছোস আর ও জিতসে মানুষের মন।

—স্যার, আমিও মানুষের মন জিততে চাই।

—তাই? সত্যি কইরা বল।

—হ, স্যার।

—তাইলে আমি যেটা বলি, সেইটা করবি? করলে বলমু।

—কন স্যার।

—আয় কান পাত...

মঞ্চ থেকে পুরস্কার নেওয়ার জন্য ডাকা হচ্ছে, প্রথম স্থান অধিকার করেছে রনি। রনি মঞ্চে মাইক হাতে নিয়ে বলল, ‘আইজ এ পুরস্কারটা আমার প্রাপ্য না, বেয়াদবি না নিলে, আমার অনুরোধ, পুরস্কারটা সুমিরে  দেওয়া হোক।

সবাই তালিতে ফেটে পড়ল। বন্ধুদের মাঝ থেকে, রনি রনি বলে আওয়াজ তুলতেই, নিমেষেই পুরো মাঠে ছড়িয়ে পড়ল সে আওয়াজ।...রনি রনি...রনি...

রনি নেমে এসে মামুন স্যারের দিকে তাকিয়ে হাসল। এত আনন্দ জীবনে কখনো পায়নি রনি। সুমিকে মঞ্চে ডাকা হলো, চোখ মুছতে মুছতে তার বাবার কোলে বসে মঞ্চে উঠল সে। পুরস্কার হাতে নিয়ে কী বলবে সে, বুঝে উঠতে পারছিল না। তার বাবা তার হাত থেকে মাইক নিয়ে বললেন, আপনাদের সামনে কথা দিচ্ছি, আমার মাইয়ারে আমি বড় দৌড়বিদ বানামু, পড়াশোনা করামু।   

অলংকরণ: জুনায়েদ

সহযোগিতায় UNFPA