নীল হাতি

নীলক্ষেত থেকে হাতিটা কিনে এনেছিলাম। ছোট একটা কাচের হাতি। নীলক্ষেত থেকে কেনা বলেই কি না জানি না কিংবা হাতিটার রং নীল বলেই কি না কে জানে, হাতিটার নাম হয়ে গেল নীল হাতি। বাসার বাচ্চারা হাতিটাকে খুব পছন্দ করে ফেলল। তারা সবাই যেকোনো নতুন জিনিস পেলেই লুফে নেয়। বেশ কিছুদিন হাতিটাকে নিয়ে শিশুমহলে লুফালুফি চলল। অন্য অনেক খেলনার মতোই কদিন পর পুরোনো হয়ে গেলে হয় ফেলে দিত নাহয় কোথাও ভেঙে পড়ে থাকত। কিন্তু এই নীল হাতিটা ভেঙেও গেল না, বাচ্চারা কোথাও ফেলেও দিল না। হাতিটার কেমন মায়াকাড়া চেহারা, দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। অতএব সে আমাদের ঘরে স্থায়ী সদস্য হয়ে গেল।

বাচ্চাদের মোহ কিছুটা কেটে যাওয়ার পর কিছুদিন হাতিটাকে বসার ঘরে টিভির স্ট্যান্ডে সাজিয়ে রাখা হলো। এরপর তার স্থান হলো শোকেসের ভেতর। আরও অনেক শৌখিন দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে শোকেসের ভেতর তার দিন কাটতে লাগল। নানা কাজের ভিড়ে হাতিটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

একদিন বাসায় ফিরে দেখি বিরাট হইচই। আমার ভাগনেরা সব বসার ঘরে গোলমাল করছে। আমার বোন ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোকেসের চাবি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল বাচ্চারা সবাই বায়না ধরেছে তারা কাচের হাতি ছাড়া খেলবে না। আরও জানা গেল যে তারা নাকি হাতিটাকে শোকেসের ভেতর ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। 

আমার আপা বললেন, কোত্থেকে কী ছাইপাশ কিনে এনেছিস আর এদিকে আমার হয়েছে যত জ্বালা। আমি চাবি খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও।

আমি বললাম, বাচ্চারা সব আমার কাছে আসো। দেখো কেমন ম্যাজিক দেখাই।

ম্যাজিকের কথায় বাবু, বিলু, টুনি—এরা সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। আমি সবাইকে দেখিয়ে তাদের মাথার ওপর দিয়ে আমার হাতটা ঘুরিয়ে আনলাম। এরপর একটু কৌশলে আমার প্যান্টের পকেট থেকে চাবিটা বের করেই ছুড়ে মারলাম ছাদের দিকে।

ছুমন্তর ছু। চাবি পড়ছে। পড়ছে।

বাচ্চারা সবাই অবাক হয়ে দেখল চাবি পাক খেতে খেতে ছাদের দিক থেকে নেমে আসছে। সবাই হুল্লোড় করে উঠল। শোকেস খুলে হাতি বের করে দিলাম।

আমার ভাগনে বিলু বলল, শরীফ মামা, জানো হাতিটা না হাঁটতে পারে।

তা তো পারবেই। এটা তো আর যেনতেন হাতি না। এ হচ্ছে গিয়ে নীল হাতি। দ্য ব্লু এলিফ্যান্ট।

বাচ্চারা খেলনা হাতি নিয়ে চলে গেল। আমিও আমার কাজে লেগে পড়লাম। ভেবেছিলাম বাচ্চাদের খেয়াল, ওদের মাথা থেকে হাতির ভূত দুই দিনেই নেমে যাবে। কিন্তু ভূত তো নেমে গেলই না বরং সিন্দাবাদের ভূতের মতো আরও জাঁকিয়ে বসল। ওরা সারাক্ষণ মেতে আছে হাতি নিয়ে। পড়াশোনা শিকেয় উঠল। টুনি আর বিলু কিছুতেই হাতি ফেলে স্কুলে যাবে না। বাবু খাওয়ার সময়ও হাতে হাতি নিয়ে বসে থাকবে। কেউ অন্য কোনো খেলনা এখন আর ছুঁয়েও দেখবে না। সবাই মিলে সামান্য একটা কাচের হাতি নিয়ে কাড়াকাড়ি-মারামারি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। আমার আপা মহা রেগে গিয়ে হাতিটাকে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রাখলেন।

সবকিছু আগের মতোই চলছিল। হঠাৎ একদিন আপা আলমারি খুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, এই এ দিকে একটু দেখে যা তো। কী কাণ্ড!

কী হয়েছে?

আরে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাচ্চারা অতিরিক্ত করছিল বলে হাতিটাকে আমি আলমারির এই তাকে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন সেটা এখানে নেই।

হয়তো অন্য কোথাও রেখেছ। এখন ভুলে গেছ।

না। এখানেই রেখেছি।

এটা তো এমন কোনো মূল্যবান জিনিস না যে আলমারিতে রাখতে হবে। আমার ধারণা, আছে হয়তো কোথাও।

হারানো হাতি নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাতে চাইলাম না। কিন্তু পরদিন আবার একই কাহিনি। নীল হাতি নিয়ে আবার শোরগোল। ব্যাপার কিছুই না। এবার ঘটনা হলো হাতিটাকে পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই পাওয়া যাওয়া নিয়েও এত চেঁচামেচির কারণ হাতিটাকে পাওয়া গেছে আপার ট্রাংকে। তা ছাড়া সেই ট্রাংক সারা বছর থাকে তালাবদ্ধ। চাবি থাকে আপার কাছে। বিশেষ জরুরি কোনো কারণ না ঘটলে সেই ট্রাংক কখনোই খোলা হয় না। আপার ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র, সামান্য কিছু গয়নাগাটি ছাড়া ট্রাংকে আর কিছুই নেই। তাও আপা সর্বশেষ কবে ট্রাংক খুলেছেন তা মনে করতে পারছেন না। 

রেগে গিয়ে আপা বললেন, তোর এই হতচ্ছাড়া হাতি নিয়ে যা। নিয়ে কোথাও ফেলে দিয়ে আয়।

আপার কথামতো হাতিটাকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলাম। ছোটরা কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করল হাতি খুঁজে না পেয়ে, পরে অন্য খেলায় মত্ত হয়ে হাতির কথা তারা ভুলে গেল। যাক আপাতত শান্তি। সামান্য এক হাতি নিয়ে বাসায় অযথা শোরগোল অন্তত বন্ধ হয়েছে।

রাতে সময়মতোই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে কিসের যেন খুটুরখাটুর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি বিশাল এক মাঠে এসে উপস্থিত হয়েছি। মাঠের চারদিকে বড় বড় পাহাড় আর সেই পাহাড়ের ঢালে ছোট-বড় সব ধরনের গাছ যেন গায়ে জড়াজড়ি করে লেগে আছে। আকাশভাঙা জোছনায় সে বিশাল মাঠটাকে আরও বিরাট, আরও রহস্যময় লাগছিল। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার যেটা হলো, আমার চারদিকে অসংখ্য হাতি; ছোট, বড়, দাঁতওয়ালা, দাঁতছাড়া—সব। আরও অসংখ্য হাতির পাল সে বিশাল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আসছিল। একের পর এক হাতির পাল এসে সে খোলা মাঠে জমা হচ্ছিল। সংখ্যায় তারা এত বেশি যে তাদের গুনে শেষ করা যাবে না। কোনো কোনো হাতির দাঁত এত বিশাল ছিল যে এমনকি আমি চিড়িয়াখানায়ও এত বড় দাঁতের হাতি দেখিনি। বেশির ভাগ হাতির গায়ের রং ছিল ধূসর নীলাভ, সে বিশাল খোলা মাঠে তাদের পায়ের আঘাতে ধুলা উড়ছিল কুয়াশার মতো, সে ধুলার মধ্যে তীব্র জোছনার আলোয় তাদের একেবারে নীল মনে হচ্ছিল।

আমি বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আমার চারদিকে অসংখ্য হাতির পাল। জোছনা রাত্রি। বিশাল মাঠে হাতিদের মধ্যে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে ঘন জঙ্গল। চাঁদের আলোয় হাতিরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল। তারা একসঙ্গে শুঁড় ওপরে তুলে দিল। আমার মনে হলো যেন হাতিরা শুঁড় তুলে গান গাইছে। এমন দৃশ্য জীবনে কখনো দেখব ভাবতেও পারিনি। আমি এমনকি বিস্মিত হওয়াও যেন ভুলে গেলাম।

তারপর শুরু হলো হাতিদের নাচ। চাঁদের আলোয় সে এক অদ্ভুত অলৌকিক দৃশ্য! শয়ে শয়ে হাতি চাঁদের আলোয় খোলা মাঠে পা কাঁপিয়ে দুলে দুলে নাচতে লাগল। সে কী বিচিত্র, সে কী অদ্ভুত নাচ! নাচের তালে তালে তারা এদিক-ওদিক তাদের শুঁড় দোলাতে লাগল। মাটিতে একের পর এক তাদের ভারী পায়ের পতনের শব্দে মাটি কাঁপতে লাগল। মনে হলো যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। বাতাসে ধুলা উড়তে লাগল।

আমার নাকে ধুলা ঢুকে গেল। আমি স্থান-কাল-পাত্র ভুলে জোরে হাঁচি দিয়ে উঠলাম। হাঁচির শব্দে হাতিদের মধ্যে যেন সাড়া পড়ে গেল। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-ওদিক ছুটে পালাতে লাগল। এদিকে আমার হাঁচি যেন থামতেই চাইছে না।

আপা কী একটা কাজে বসার ঘরে এসেছিলেন। আমাকে এভাবে হাঁচতে দেখে বললেন, আগেই মানা করেছিলাম ফ্যান চালু রেখে ঘুমাতে। শীত নেমে গেছে এখন, ঠান্ডা তো লাগবেই।

আপা হাতিটা কোথায় বলতে পারো?

সাতসকালে হাতির খবর আমি কীভাবে বলব? বুয়া মনে হয় ফেলে দিয়ে এসেছে।

আমি বিছানা থেকে উঠে বুয়াকে জিজ্ঞেস করতেই সে একগাল হেসে বলল, কখন ময়লার ঝুড়িতে কইরা ময়লার গাড়িতে ফেলাইয়া দিয়া আসছি ভাইজান।

হাতির গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই পাশের বাসার ভদ্রলোক এলেন। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হলো সিঁড়িতে তাঁর ছোট ছেলে একটা কাচের হাতি কুড়িয়ে পেয়েছে। তাঁর ধারণা হাতিটা আমাদের হতে পারে। তাঁর ছেলে হাতিটা পাওয়ার পর টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছিল। কিন্তু এখন সেখানে সেটা নেই। তাঁর ছেলের কান্না থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। ভদ্রলোক জানতে এসেছেন একই রকম আরও কোনো খেলনা হাতি আমাদের বাসায় আছে কি না। থাকলে তিনি সেটা তাঁর ছেলেকে শান্ত করার জন্য কিছুক্ষণের জন্য চেয়ে নিতেন অথবা উপযুক্ত দাম দিয়ে কিনে নেবেন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ও রকম কোনো হাতি আমাদের বাসায় নেই। একটা ছিল, সেটাকে ময়লার ঝুড়িতে করে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে।

ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, ভুতুড়ে হাতি বিদেয় হয়েছে। কিন্তু শোকেসের দিকে চোখ পড়তেই আামাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। যথারীতি বসার ঘরের শোকেসের ভেতর নীল হাতিটাকে দেখা যাচ্ছে। শোকেস বাইরে থেকে তালাবদ্ধ।

অলংকরণ: আবু হাসান