শব্দগুলো ইংরেজদের নয়

শুধু বাংলা ভাষা নয়, বিশ্বের সব উন্নত ভাষাই ভিনভাষা থেকে শব্দ ধার করে। ভাষাতত্ত্বে এই ধার করা শব্দগুলোকে বলে কৃতঋণ শব্দ।

ইংরেজি ভাষায় কৃতঋণ শব্দের পরিমাণ যেকোনো ভাষার চেয়ে অনেক বেশি। তবে ইংরেজদের বৈশিষ্ট্য হলো কৃতঋণ শব্দকে তারা নিজেদের মতো করে বানিয়ে নেয়। ফলে শব্দগুলোকে আর বিদেশি শব্দ বলে মনে হয় না।

অভিধানের গল্পে আজ বাংলা ভাষায় আসা এমন কিছু শব্দের কথা থাকছে, যেগুলো ইংরেজি ভাষা থেকে এলেও সেগুলো কিন্তু ইংরেজি নয়।

অ্যাডমিরাল

ইংরেজি ভাষী ও ইংরেজি ভাষা প্রভাবিত দেশগুলোর নৌবহরের প্রধান বা নৌসেনাপতির পদবি হলো অ্যাডমিরাল। অ্যাডমিরালের নিচের পদ ভাইস অ্যাডমিরাল এবং ওপরের পদ অ্যাডমিরাল অফ দ্য ফ্লিট। পদবিগুলো বাংলাদেশেও একই ভাষায় ব্যবহৃত হয়।

ইংরেজি অ্যাডমিরাল শব্দের ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। বহর বলে একটা শব্দ আছে বাংলায়। কাপড়ের সঙ্গে শব্দটির সম্পর্ক বেশি, যেমন—শাড়ির বহর, লুঙ্গির বহর, প্যান্টের কাপড়ের বহর ইত্যাদি। বহর বলতে প্রধানত বোঝায় কাপড়ের চওড়ার দিক—বিস্তার বা ওসার। ভিন্ন ক্ষেত্রেও বহর ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার শ্লেষাত্মক একটি লাইন—মাথায় ছোট বহরে বঙ্গে বাঙালি সন্তান।

বহর আরবি শব্দ। বহর শব্দের অর্থ দরিয়া, সাগর বা মহাসাগর। দরিয়া ফারসি শব্দ।

সমুদ্র গভীর। তল খুঁজে পাওয়া ভার। সমুদ্রের গভীরতার সূত্রে বাংলা ভাষায় বহর শব্দের আরেক অর্থ গভীরতা। এই গভীরতা বা বইয়ের ব্যঙ্গাত্মক প্রয়োগই বেশি, যেমন—জ্ঞানের বহর, বিদ্যার বহর ইত্যাদি। ‘তোমার বিদ্যার বহর বেশ বোঝা গেল’—কথাটি কিন্তু প্রশংসার নয়।

আতিশয্য অর্থেও বহর শব্দটির ব্যঙ্গাত্মক ব্যবহার রয়েছে। লোকটার টাইয়ের বহর দেখেছ—কারও টাই দেখে এমন কথা বললে লোকটাকে ঠাট্টা করা হয়।

যাহোক, এই বহর শব্দের সঙ্গেই কিন্তু অ্যাডমিরাল শব্দের আত্মিক সম্পর্ক। আরবি ভাষায় নৌসেনাপতিকে বলা হয় আমির আল বহর। আরবি আমির শব্দের অর্থ অধিনায়ক, নেতা। আরবি এই আমির আল বহর পদবিটাই ইংরেজদের বাগ্‌যন্ত্রে প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে হয়ে গেছে অ্যাডমিরাল।

শ্যাম্পু

মাথার চুল পরিষ্কারের জন্য ব্যবহৃত সুগন্ধি ঘন তরল পদার্থ হলো শ্যাম্পু। শ্যাম্পুর বোতল দোকান বা স্টোরে কিনতে পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষায় শ্যাম্পু শব্দটি ইংরেজি থেকে ধার করা। ইংরেজি ভাষায় শব্দটি বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ দুভাবেই ব্যবহৃত হয়। বাংলাতেও তাই। বাংলা ভাষায় শ্যাম্পুর কোনো প্রতিশব্দ নেই।

শব্দ ও চুলে দেওয়ার সামগ্রী হিসেবে বাংলাদেশে শ্যাম্পুর আগমন খুব বেশি দিন আগের নয়। ইংরেজি-বাংলা অভিধানে শ্যাম্পু শব্দের অর্থ দেওয়া আছে—কেশ সংস্কারের জন্য বিশেষ সাবান, চূর্ণক, তরল পদার্থ ইত্যাদি। অভিধানে যা-ই থাক, বাঙালি শ্যাম্পু বলতে বোতলজাত সুগন্ধি ঘন তরল পদার্থই বোঝে। বাঙালি আগে যা দিয়ে চুল পরিষ্কার করত ইংরেজি ভাষায় তাকে শ্যাম্পু বলা হলেও বাঙালি কখনো তা বলবে না।

ইংরেজি ভাষাতেও শ্যাম্পু শব্দটির ব্যবহার বেশি দিন আগের নয়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে ইংরেজি ভাষায় শ্যাম্পু শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। বোঝা যাচ্ছে, শ্যাম্পু শব্দটা ইংরেজদের ধার করা।

ইংরেজরা শব্দটা পেল কোথা থেকে? ভাষাতাত্ত্বিকদের ভাষ্য অনুযায়ী শব্দটি ভারতীয় এবং তা হিন্দি ভাষার শব্দ।

হিন্দি ক্রিয়াপদ চাঁপনা অনুজ্ঞায় হয়েছে চাঁপো। আর এই শব্দটাই বণিক, পর্যটক ও ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মুখে মুখে ঘুরপাক খেয়ে তা শ্যাম্পুরূপে ইংরেজি ভাষায় ঠাঁই নিয়েছে।

হিন্দু চাঁপনা বা চাপো শব্দের অর্থ অবশ্য শরীর দলাইমলাই। কিন্তু তার পরের কাজ হলো চুলের পরিচর্যা করে স্নান করানো। এই কাজটা ছিল একশ্রেণির বৃত্তিজীবীর। ভারতীয় সিনেমার কল্যাণে ব্যাপারটা এখনো দেখতে পাওয়া যায়।

ইংরেজি শ্যাম্পু শব্দে চুল পরিষ্কারের ব্যাপারটাই আছে, দলাইমলাই নেই। বাংলা শ্যাম্পু শব্দটা ইংরেজি অর্থই গ্রহণ করেছে।

বাংলো

ইংরেজি অভিধানে বাংলো শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে সিঁড়ির ধাপবিহীন একতলা ছোট বাড়ি।

বাংলো শব্দটা বাংলা ভাষাতেও আছে। শব্দটা ইংরেজি থেকে ধার করা। বাঙালি যখন বাংলো টাইপের বা প্যাটার্নের বিশেষ ধরনের বাড়ির কথা বলে তখন তার স্মৃতিতে কাজ করে ইংরেজ আমলে জেলা, মহকুমা ও থানা সদরে স্থাপিত ডাকবাংলোর কথা। সরকারি কর্মচারীদের মফস্বল এলাকা পরিদর্শনকালে ব্যবহারের জন্য তখন ডাকবাংলো স্থাপন করা হয়।

এই ডাকবাংলো ছিল প্রধানত দেয়ালঘেরা দোচালা দুই কামরার ছোট বাড়ি। সামনে চওড়া বারান্দা। ডাকবাংলো কোথাও কোথাও চারচালাও হতো। চওড়া বারান্দা থাকত অবশ্যই। চাল প্রধানত হতো টালির। ডাকবাংলো এখনো আছে। তবে বাংলো প্যাটার্ন সব জায়গায় আর নেই। হয়ে গেছে ছাদওয়ালা বাড়ি।

ইংরেজরা ডাকবাংলো বা বাংলো তৈরির সময় মাথায় রেখেছিল সামনে প্রশস্ত দাওয়াযুক্ত বঙ্গদেশ, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের দোচালা খড়ের বাড়ি। এই বিশেষ ধরনের বাড়ির প্যাটার্নটাই তাদের বাংলোর নকশা নির্মাণে প্রণোদিত করে।

হিন্দিভাষী এলাকার লোকেরা এই ধরনের বাড়িকে বলত বাংলো। বাড়ির নাম হিন্দিভাষীদের মুখ থেকে শুনে বাঙালিরা তাদের নিজেদের বাড়ির নাম দেয় বাংলা ঘর।

এই বাংলা বা বাংলা ঘরই ইংরেজি ভাষায় হয়ে যায় বাংলো।

র‌্যাকেট

টেনিস, ব্যাডমিন্টন, স্কোয়াশ খেলার সময় র‌্যাকেট লাগে। র‌্যাকেট হলো ডিশাকৃতি বা গোলাকার হালকা ধরনের ব্যাট। র‌্যাকেটের কাঠের বা ধাতব কাঠামোর মাঝখানে চৌখুপি করে বোনা বিশেষ ধরনের সুতোর জালি শক্ত করে আটকানো। এই কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত ভালো করে আঁকড়ে ধরার জন্য চামড়া দিয়ে জড়ানো হাতল। এই হাতল ধরেই র‌্যাকেট চালানো হয়।

ইংরেজি র‌্যাকেট শব্দের বাংলা কোনো প্রতিশব্দ নেই। বাংলা ভাষাতেও র‌্যাকেট শব্দটাই চলে। টেবিল, চেয়ার ইংরেজি শব্দ হলেও এখন সেগুলো বাংলা শব্দই। তাই র‌্যাকেটও এখন বাংলা শব্দ

যাহোক, ইংরেজি র‌্যাকেট শব্দটা এসেছে আরবি রাহাত শব্দ থেকে। আরবিতে রাহাত শব্দের অর্থ হলো হাতের তালু। র‌্যাকেটের হাতল হাতের তালুর সঙ্গে শক্ত করে সেঁটে থাকে। র‌্যাকেট ধরার এই কায়দা থেকেই আরবি রাহাত থেকে ইংরেজি র‌্যাকেট শব্দটি তৈরি।

গোডাউন

গোডাউনকে আমেরিকানরা বলে ওয়্যারহাউস। ইংরেজরা এখন গোডাউন ও ওয়্যারহাউস—দুটোই বলে। গোডাউন ইংরেজি শব্দ। বাংলা প্রতিশব্দ গুদাম হলেও বাঙালির মুখের ভাষায় ইংরেজি গোডাউন শব্দটাই চলে বেশি। ইদানীং ওয়্যারহাউস চলছে। ইংরেজি গোডাউন এবং বাংলা গুদাম শব্দের অর্থ পণ্যাগার বা পণ্যসামগ্রী সংরক্ষণ করার স্থান।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় ভাষায় গুদাং হলো পণ্যাগার মালয়ি এই গুদাং শব্দ ইংরেজিতে হয়েছে গোডাউন এবং পতু‌র্গিজ ভাষায় হয়েছে গোদাউ। তবে বাংলা গুদাম শব্দ মালয় ভাষা থেকে আসেনি। এসেছে হিন্দি ভাষা থেকে। হিন্দি ভাষা এই শব্দটা সম্ভবত পতু‌র্গিজ ভাষা থেকে ধার করেছে।

অলংকরণ: শিখা