বাড়ির বাইরে থেকেই টের পাচ্ছিলাম যে ভেতরে মহা হইচই। অবশ্য এ আর নতুন কী, আমার পুত্রধন বাড়িতে থাকলে এটাই স্বাভাবিক। কয়েক বছর মাত্র বয়স অথচ চব্বিশ ঘণ্টা নাজেহাল করছে সবাইকে। বিশেষ করে আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর কায়দাটা ভালোই আয়ত্ত করেছে এই ব্যাটা!
ভেতরে ঢুকেই দেখি হাতে একটা প্লাস্টিকের বন্দুক একে ফর্টি সেভেন নিয়ে ছোটাছুটি করছে। খাটের নিচে কাকে যেন খুঁজছে, আর চিৎকার করছে, ‘আজ তোদের শেষ করব!’
ও বাবা, খাটের নিচে আবার কী ঢুকল? শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী রে গুটু, খাটের নিচে আবার কাকে মারবি?’ এই মহাশয়ের একখানা পোশাকি নাম থাকলেও আমার কাছে এ ‘গুটু’। গুটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ‘দেখো না বাবা, পিঁপড়েগুলো কী মারটাই না মারল আমাকে! আজ ওদের মেরে শেষ করব!’
‘পিঁপড়ে? মারল তোকে? তা কী করে মারল—ঘুষি, নাকি ল্যাং?’ হাসি-হাসি মুখে বলি আমি।
‘হেসো না’, খ্যাক্ করে ওঠে গুটু, ‘পিঁপড়ের কামড় খেলে বুঝতে মজা!’
‘শোন রে বাপ্ আমার, পিঁপড়ের সাথে লড়াই করে পারবি না। তাও তো এ আমাদের নিরীহ দেশি পিঁপড়ে, পড়তি যদি আফ্রিকার ড্রাইভার অ্যান্টের পাল্লায়, বুঝতি মজা!’
গল্পের পোকা এই জুনিয়ার ওসমান! তাই গল্পের কথা শুনে কাছে ঘেঁষে এসে বসে আমার পাশে। চোখ বড় বড় করে বলে, ‘সে আবার কেমন পিঁপড়ে?’
আমিও ভাবি যে এই অসহ্য হইহল্লা হজম করার চেয়ে আফ্রিকার ড্রাইভার পিঁপড়ের গল্প শোনানো অনেক সহজ। তাই শুরু করে দিই আমিও: এমনিতে বেশির ভাগ পিঁপড়ে শান্তিপ্রিয় হলেও, এদের মধ্যে রীতিমতো রাক্ষুসে হচ্ছে ড্রাইভার অ্যান্ট। এদের ক্ষিধে সর্বগ্রাসী। কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, যাযাবর। সারাক্ষণই চলছে সার বেঁধে বড় দল করে। একটা-দুটো-দশটা নয়, কম হলেও ৮০ হাজার থেকে এক লাখ পিঁপড়ে থাকে এক একটি দলে। ভাবা যায় এক সাথে ৮০ হাজার! ওই দলের চলার পথে ছাগল, গরু, ঘোড়া এমনকি হাতি—যা-ই আসুক না কেন, রেহাই নেই। যদি ওরা আক্রমণ করে তবে বাঁচা মুশকিল। ঝাঁপিয়ে পড়ে একসাথে। তারপর মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সব খেল খতম। পড়ে থাকে শুধু হাড়-হাড্ডি। রাতে শিকার ধরা সহজ বলে রাতে চলাই এদের প্রিয়। শুনে রাখ, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েও রেহাই নেই এই মূর্তিমান যমদূতের হাত থেকে। সাঁতার কেটে শিকার ধরতেও দারুণ পটু এরা।
মার্বেলের মতো চোখ করে গুটু জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে?’
‘হ্যাঁ, একটা উপায় আছে বটে’, বলি আমি, ‘এই রাক্ষুসে পিঁপড়ের হাত থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে কেরোসিন।’
‘কেরোসিন?’
‘হ্যাঁ, কেরোসিন চারপাশে ঢেলেই এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কেরোসিনের গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না এরা।’
ততক্ষণে গল্পের পিঁপড়ে গুটুর মাথায় ঢুকে গিজগিজ করা শুরু করেছে। আমার আরও কাছে ঘেঁষে জিজ্ঞেস করে, ‘এমন আজব পিঁপড়ে নেই আর?’
‘নেই আবার? এই এত্ত এত্ত আছে! যেমন আছে পাতাকাটা বা পাতাখেকো পিঁপড়ে। এরা দিনভর গাছের পাতায় বসে পাতা কেটে টুকরো খুলে মাথায় করে বাসায় নিয়ে যায়। পাতাগুলো এত মসৃণ করে কাটে যে দেখলে মনে হবে ব্লেড দিয়ে কাটা! জড়ো করা পাতাগুলো চিবিয়ে লালায় ভিজিয়ে মণ্ড তৈরি করে। এরপর তাতে এক ধরনের ছত্রাক এনে বসিয়ে দেয় এরা! তারপর রীতিমতো কৃষকের মতো যত্ন-আত্তি করে বড় করে তোলে ওগুলোকে। সেগুলোই পরে পরিণত হয় পাতা কাটা পিঁপড়েদের প্রিয় খাবার ‘ব্রোমাটিয়া’য়! তবে এদের বড় শত্রু ‘অ্যাপোসেফালাজ’ গোত্রের মাছি। ওই মাছি উড়তে উড়তে পাতা কাটাদের মাথায় ডিম পাড়ে। পরে ওই ডিম ফুটে মাছির বাচ্চা বেরিয়ে খেয়ে ফেলে আশ্রয়দাতা ওই পিঁপড়েকেই!’
‘ভয়ংকর!’ আঁতকে উঠে বলে গুটু।
‘ভয়ংকর বটে। তবে পিঁপড়েরাও কম যায় না। এরা এই শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে আবিষ্কার করেছে অভিনব এক পন্থা। পাতা কাটার সময় এদের পিঠের ওপর বসিয়ে দেয় একটু ছোট আকারের পিঁপড়েকে। ওই পাহারাদার পিঁপড়ে পিঠে বসে বসে শুঁড় নাড়িয়ে তাড়ায় ডিম পাড়তে আসা মাছিটিকে!’
‘বাব্বাহ্! বুদ্ধি আছে বটে!’
‘বুদ্ধির দেখেছিস কী আর—পিঁপড়ে রাজ্যে এমন বুদ্ধিমান আরও অনেক।’
‘যেমন?’
‘যেমন পিঁপড়েরা বুদ্ধিমান সামাজিক জীব। পিঁপড়ের দলে থাকে তিন রকম পিঁপড়ে রানি, কর্মী আর পুরুষ। একটি দলে থাকে শ-খানেক রানি, তার কয়েক গুণ পুরুষ, আর হাজার হাজার কর্মী। আমরা সাধারণত এই কর্মী পিঁপড়েদেরই দেখি। সবচেয়ে বড় হয় রানি পিঁপড়ে। ডিম দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই রানিদের। কাজকর্ম করে দিনরাত খেটে মরে কর্মী পিঁপড়ে। তবে স্লেইভ মেকার অ্যান্ট বা দাস-বানানো পিঁপড়েরা ভারি বজ্জাত। এরা অন্যের বাসায় আক্রমণ করে ডিম ফুটে বেরোনো শুককীট ছিনতাই করে এনে তাদের বড় করে দাসে পরিণত করে—কাজ করায় ইচ্ছেমতো।
‘আচ্ছা, এত এত পিঁপড়ে থাকে কোথায়?’
‘ওরে, এদের থাকার জায়গার অভাব নেই। ঢিবি তৈরি করে, গর্ত বানিয়ে, এমনকি গাছের পাতা সেলাই করেও বাসা বানায় এরা। একতলা-দোতলা নয়, ৫০ তলা পর্যন্ত হয় এদের মাঠির তৈরি বাড়ি! কেউ কেউ সার গাছের পাতা, কাগজ, পচা কাঠ ওসবে মুখের লালা মিশিয়ে ছোট ছোট ইটের মতো তৈরি করে বাড়ি বানায়!’
‘এত বুদ্ধি!’ শুনতে শুনতে হাঁ হয়ে গেছে গুটুর মুখ।
‘আরও’ বুদ্ধির ব্যাপার আছে। আমরা যেমন দুধের জন্য গরু পুষি, তেমনি কপি, মুলা এসব গাছের জাবপোকার ডিম ফুটিয়ে সেগুলোকে বড় করে রীতিমতো গরুর মতো করে ব্যবহার করে কোনো কোনো পিঁপড়ে।’
‘মানে।’
‘মানে হলো, এই পোকাগুলোর শরীরের পেছন থেকে বেরোয় মিষ্টি রস। ‘পিঁপড়ের ওই রস দুধ দোয়ানোর মতো করে বের করে খেয়ে নেয়। আবার এ পোকাদের জন্য ঘাস বুনে তৈরি করে গোয়ালঘর। দেখাশোনার জন্য রাখাল পিঁপড়েও নিয়োজিত থাকে। আরও আছে মধু পিঁপড়ে!’
‘সে আবার কে? মধু দিয়ে তৈরি পিঁপড়ে?’
‘বলতে পারিস। দলের অন্যরা মধু খাইয়ে খাইয়ে পেট ভর্তি করে রাখে মধু পিঁপড়ের। তারপর কোনো সময় খাবার অভাব হলে ওই পিঁপড়ের পেটে জমানো মধু খেয়ে নেয়। ঠিক যেন মধু চাষ!
‘ওহ্, পেটে পেটে এত! তা ছাড়া এদের সঙ্গে এঁটে ওঠাও মুশকিল—কী যে কামড় বসায়! সব সময় দেখি লাইন করে দল বেঁধে চলছে—যেন রীতিমতো গুন্ডা দল!’
‘তবে হ্যাঁ, পিঁপড়ে যে সার বেঁধে এগোয়—তার পেছনে অন্য কারণ আছে। আসলে পিঁপড়ের দৃষ্টিশক্তি কম। তাই স্পর্শ আর গন্ধে ভর করেই তারা এগোয়। সে জন্য কর্মী পিঁপড়েদের পেটে থাকে এক গ্রন্থি। ওই গ্রন্থি থেকে চলার পথে একটু একটু তরল বেরোয়। ওই তরলের গন্ধ অনুসরণ করে এগোয় বাকিরা। তবে মরুভূমির পিঁপড়েরা গরম বালুতে পেট লাগাতে পারে না বলে ওই তরল ছিটিয়ে দেয় বাতাসে। আর ওই গন্ধের সূত্র ধরেই এগোয় বাকিরা। আর কামড়ের কথা বললি—সেটার পেছনে থাকে ওদের হুল। সাধারণত কর্মী পিঁপড়েদের শরীরের পেছনে সুইয়ের মতো ছোট্ট একটা হুল থাকে। হুলের সঙ্গে যুক্ত থাকে বিষ থলে। যখন হুল ফুটিয়ে দেয়—যাকে আমরা কামড় বলি, তখন বিষাক্ত ফরমিক অ্যাসিডের কারণে জ্বালা করে শরীর। আবার কোনো কোনো পিঁপড়ের ছোট ছোট দাঁতও থাকে—সেই দাঁত দিয়েও কামড়ে ধরতে পারে এরা।’
‘ওহ্, বাবা! পিঁপড়ের কামড় ভয়ংকর জ্বলার কারণেই তো বন্দুক হাতে মারতে চাইছি ওদের!’
‘অত সহজ নয়! দেখতে ওইটুকু বলে শক্তি কম নয় মোটেও ওদের। নিজের শরীরের ওজনের চেয়ে পঞ্চাশ গুণ বেশি ওজন বইতে পারে অনায়াসে! কেউ কেউ বলে অতি দ্রুত নিজ দৈর্ঘে্যর ৪৮ গুণ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে মাত্র এক সেকেন্ডে! ভাবা যায়?’
একটু মুষড়ে পড়ে গুটু। বলে, ‘তাহলে নিস্তার নেই এই পিঁপড়ের হাত থেকে?’
‘নিস্তার পাওয়া মুশকিল’, উত্তরে বলি আমি, ‘এত এত পিঁপড়ের বাস আমাদের দেশে, কাকে ছেড়ে কাকে ধরবি বল? লাল পিঁপড়ে, কালো পিঁপড়ে, কাঠ পিঁপড়ে, ডেয়ো পিঁপড়ে—এমন নানান পিঁপড়ে আছে আমাদের দেশে। কাঠ পিঁপড়ের শরীরের মাঝে লাল, বাকিটুকু কালো। আকারে বড় এ পিঁপড়ে গাছের শুকনো ছালের নিচে থাকতে ভালোবাসে। এদের হুল-দাঁত দুটোই আছে—কামড়ে ভীষণ জ্বালা। ডেয়ো পিঁপড়ের হুল নেই। তবে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরতে পারে জোরে। লালচে রঙের নালসো পিঁপড়ে থাকে আম-জাম-লিচুগাছে, কামড়াতে ওস্তাদ এরাও। নালসো পিঁপড়েরা গরু হিসেবে জাবপোকা পুষে থাকে। কালো রঙের ছোট ও চঞ্চল পিঁপড়েরা সুড়সুড়ে পিঁপড়ে হিসেবে পরিচিত। গায়ে উঠে পড়লে কামড়ায় না বটে, কিন্তু সুড়সুড়ি লাগে বেজায়!’
যখন বলছি এসব কথা তখন খেয়ালই করিনি কোন ফাঁকে সার বেঁধে লাল পিঁপড়ের দল উঠে আসছে সোফায়। সোফায় হয়তো কোনো আচারের টুকরো সবার অগোচরে পড়ে ছিল—তার লোভেই তাদের আগমন। আনমনে ওই পিঁপড়ের সারির ওপরে রেখেছি আমার হাত। আর যায় কোথায়? সাথে সাথে পুটুস পুটুস কামড়। ওহ্, কী জ্বালা। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠি আমি।
আর বজ্জাত পুটু? দেখি ওই ব্যাটা আমার নাজেহাল দশা দেখে মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়ে হাঃ হিঃ হিঃ করে হাসছে!
ওদিকে এমনিতেই জ্বলছি পিঁপড়ের কামড় খেয়ে, তার ওপর এই ফিচলের এহেন কাণ্ড দেখে জ্বলুনি যেন বেড়ে যায় আমার! দাঁত কিড়মিড় করে বলি, ‘শোন, শুনে রাখ কান খুলে—সময় একদিন আমারও আসবে; সেদিন কাঁদবি তুই, হাসব আমি।’
কামড়ের জায়গায় স্যাভলন লাগাতে যাই আমি। ওদিকে বজ্জাতটা তখনো গা জ্বালা করা হাসি হেসেই চলেছে!