শিল্পাচার্যের ছবির জগতে

কোনো স্বপ্ন থাকলে তা পূরণের জন্য অনেক সময় পাগলামি আর জেদ লাগে। শিল্প আর আঁকাআঁকি নিয়ে আগ্রহটা ছোট বয়স থেকেই বাড়াবাড়ি রকমের ছিল জয়নুলের। তা না হলে কেউ কি বাড়ি থেকে পালায় শুধু আর্ট স্কুল দেখতে! বয়স তখন মাত্র ষোলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে কয়েক বন্ধু মিলে ময়মনসিংহ থেকে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। উদ্দেশ্য ‘কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস’ দেখা। সাধারণ পড়াশোনায় মন নেই, পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তরের বদলে আঁকেন ছবি, এমন ছেলেকে ঠেকাবে কে! শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই সব ছেড়ে ছুড়ে চলে গেলেন কলকাতায়। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ১৯৩২-৩৩ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢুকে পড়লেন তাঁর স্বপ্নের আর্ট স্কুলে।

জয়নুল, মানে যাঁকে আমরা শিল্পাচার্য বা শিল্পগুরু হিসেবে জানি, সেই জয়নুল আবেদিনের শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। ১৯১৪ সালে (২০১৪ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে) কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কিশোরগঞ্জ তখন ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে। বাবা চাকরি করতেন পুলিশ বিভাগে। ঘুরেছেন ময়মনসিংহের এক থানা থেকে আরেক থানায়। ১৯২৬ সালের দিকে থিতু হয়েছেন ময়মনসিংহে। আঁকাআঁকির প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সেখানকার প্রকৃতি। ময়মনসিংহে স্কুলে পড়তে বিকেলে প্রায়ই ছবি আঁকতে বসে যেতেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। নদকেই মানতেন জীবনের ‘শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক’ হিসেবে।

কলকাতা আর্ট স্কুলে নিজের আঁকাআঁকি দিয়ে তিনি শুরু থেকেই মুগ্ধ করেছেন তাঁর শিক্ষক ও সহপাঠীদের। বিষয় বাংলাদেশের প্রকৃতি, নদী, গ্রাম, গ্রামের মানুষ, তাদের জীবনসংগ্রাম। স্কুলে ছাত্রদের আঁকা ছবি নিয়ে বছর বছর প্রদর্শনী হয়। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় বার্ষিক প্রদর্শনীতে দেওয়া তাঁর ছবির নাম ছিল ‘বাঁশের সাঁকো’। গ্রামে খালের ওপর যে বাঁশের সেতু থাকে, তেমনি একটি সেতুর ওপর দিয়ে মাথায় পুঁটলি নিয়ে পার হচ্ছে দুজন মানুষ। এটাই ছিল সেই ছবির বিষয়। ছবিটি আলাদা করে সবার নজর কাড়ে। ছবিটির জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকেও তিনি পান বিশেষ সম্মান।

জয়নুল আবেদিনের নবান্ন শিরোনামের এই ছবিটি তেলরং ও মোমে আঁকা
জয়নুল আবেদিনের নবান্ন শিরোনামের এই ছবিটি তেলরং ও মোমে আঁকা

আর্ট কলেজে পড়াশোনার মূল কাজটি তো ছবি আঁকা। জয়নুলের নেশা আর পড়াশোনা মিলেমিশে একাকার। ছবি আঁকার অনুশীলন করতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন কলকাতার আশপাশে। গেছেন সাঁওতাল পরগনায়, এঁকেছেন তাদের ছবি, সেখানকার ল্যান্ডস্কেপ। মাঝে মাঝে ময়মনসিংহ ফেরেন, সেই প্রকৃতি ও নদের কাছে। সেসবের ছবি আঁকেন। জয়নুল তাঁর কাজ দিয়েই নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরতে পেরেছেন। এমন প্রতিভাকে হারাতে চায়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি সেই স্কুলে নিয়োগ পান অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে। পড়াশোনা শেষ করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে।

তেতাল্লিশের মন্বন্তরের দৃশ্য ধরা পড়েছে শিল্পাচার্যের তুলিতে
তেতাল্লিশের মন্বন্তরের দৃশ্য ধরা পড়েছে শিল্পাচার্যের তুলিতে

১৯৩৯ সালে তিনি পুরোদস্তুর স্থায়ী শিক্ষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুও সে বছর। ১৯৪২ সালে এর ধাক্কা এসে কলকাতাতেও লাগে। জাপানি বিমান থেকে কলকাতায় বোমা ফেলার পর জয়নুল বেশ কিছুদিনের জন্য ময়মনসিংহে চলে আসেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় ফিরে গিয়ে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। দেখেন, খাবারের অভাবে কীভাবে মানুষ রাস্তাঘাটে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া পচাবাসি খাবার নিয়ে কীভাবে কুকুরে-মানুষে লড়াই করছে। এই দুর্ভিক্ষ ভেতর থেকে নাড়া দেয় প্রকৃতিপ্রেমী জয়নুলকে। তিনি আঁকেন দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ কিছু ছবি। কালো রঙে তুলির টানে আঁকা শক্তিশালী এই ছবিগুলোই হয়ে উঠেছে সেই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক।

শিল্পাচার্যের বিখ্যাত ছবি দ্য স্ট্রাগল
শিল্পাচার্যের বিখ্যাত ছবি দ্য স্ট্রাগল

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে কলকাতা আর্ট স্কুলের চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন জয়নুল। তত দিনে নিজের ভেতরে তৈরি হয়েছে বড় এক স্বপ্ন, একটি আর্ট কলেজ লাগবে ঢাকায়। কাজটি সহজ ছিল না। পাকিস্তানের মতো মুসলিম একটি দেশে আর্ট কলেজ করার বিরোধিতাও হয়। কিন্তু জয়নুল দমে যাওয়ার মানুষ নন। বিভিন্ন পর্যায়ের বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় এই লড়াইয়ে জয়ী হন তিনি। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে জনসন রোডে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটের পুরোনো ভবনের নিচতলায় দুটি ঘরে শুরু হয় গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টসের। পরে তিনি এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চারুকলা অনুষদ, সেটার শুরুটা হয়েছিল এভাবেই জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে।

ছবি আঁকার নেশা থেকে আর্ট স্কুলে পড়েছেন, পরে ছাত্রদের শিখিয়েছেন। নিজে আর্ট কলেজ গড়েছেনও। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে যে লোকশিল্প জাদুঘর, সেটা জয়নুলের স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন। নিজের ছবি প্রদর্শনের জন্য একটি সংগ্রহশালা গড়তে চেয়েছেন তাঁর সেই ময়মনসিংহে, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। সেটাও পূরণ করেছেন। এ দেশে শিল্পচর্চার তিনিই গুরু। সবার কাছে তাঁর পরিচিত ও স্বীকৃতি তাই ‘শিল্পাচার্য’ হিসেবে।

তথ্যসূত্র: জয়নুল আবেদিন: নজরুল ইসলাম (আর্ট অব বাংলাদেশ সিরিজ, ১৯৯৭, শিল্পকলা একাডেমি)। জয়নুল আবেদিন, সৃষ্টিশীল জীবনসমগ্র: সৈয়দ আজিজুল হক (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫)।