বাসায় যখন কারও আসার নেই

মুকিম দরজা খুলে একটু সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ওরা ঢোকে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। দুজনই মুকিমের বয়সী। তবে তারা ওকে কড়ে আঙুলও মনে করে না। এতটুকু পাত্তা না দিয়ে ড্রয়িংরুমে পা দেয়।

মেয়েটা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে—‘দ্যাখ! দ্যাখ! আমার সোফা। ঠিক দেয়াল ঘেঁষে আছে। আমার ১০ পয়েন্ট।’ ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ঝালরের পর্দা ঠেলে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকায়—‘দেখো! ডাইনিং টেবিলটাও ঠিক আমাদের

মতো সেট করা। ছয়টা চেয়ারের পাহারায় দাঁড়ানো। আমারও ১০ পয়েন্ট।’

মেয়েটা ছেলেটার দিকে ফেরে—‘কিন্তু তোমার টিভি কই? ড্রয়িং-ডাইনিংয়ের কোথাও নেই। তোমার ১০ পয়েন্ট কাটা।’

ছেলেটার উচ্ছ্বাসে জল পড়ে। নেতিয়ে যায় মন।

এদের কাণ্ডকারখানায় মুকমি হতবাক। হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের পানে। এরা কারা? এল কোত্থেকে? আবার দেখো, বাসার সোফা-টেবিল-টিভি সব নিজেরা ভাগ করে নিচ্ছে। চোর-ডাকাত? মাস্তান-লুটেরা? চেহারা-সুরতে তো তা মনে হচ্ছে না। বরং দেখতে ভদ্র-সুজনের মতোই তো লাগছে। ছেলেটার পরনে জিনসের প্যান্ট আর গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি। তাতে বেশ মানিয়েছে। আর ফরসা ফুটফুটে চেহারার মেয়েটা পরে আছে গোলাপি ফ্রক।

ফ্যানের বাতাসে তার চারধারের উড়ু উড়ু ভাব। তার নিচে টাইট টাইস। একবারে পুতুলর মতো। কিন্তু তাদের মতো অচল নয়। বরং সারাক্ষণ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে যাচ্ছে। ছোটাছুটি করছে। বিজয়ীর মতো উচ্ছ্বাস-আনন্দে টইটম্বুর যেন-বা।

মুকিম আগে কখনো ওদের দেখেনি। আত্মীয়স্বজন কেউ নয়। অথচ দেখো কাণ্ড—বাসার সবকিছু যেন ওদের চেনা। কোথায় কী আছে—ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, টেবিল, চেয়ার এমনকি বেড—সব ওদের জানা। এ রুম থেকে সে রুমে ঘুরে ঘুরে দেখে। জিনিসপত্রের হিসাব মেলায়। মুকিমও বাধ্য ছেলের মতো ওদের পিছু পিছু হাঁটে। সব রুম ঘোরঘুরি হলে, হিসাব মিলানো শেষে আবার সবাই ড্রয়িং রুমে ফেরে। তখন যেন ওদের মুকিমের প্রতি নজর পড়ে। মেয়েটা জিজ্ঞেস করে— তোমরা এখন এ বাসায় থাকো? তোমাদের বাসা?

অ্যাঁ! বলে কী? আমাদের বাসায় এসে আমাকেই জিজ্ঞাসা ‘তোমাদের বাসা এটা?’ মুকিম হা হয়ে মেয়েটার দিকে তাকায়। কিন্তু তাতেও মেয়েটার হুঁশ হয় না। তার উচ্ছ্বাসের জোয়ার কুলকুল করে এগোতেই থাকে—‘তোমারা তো দুই মাস আগে এ বাসায় এসেছ? তার আগে আমরা ছিলাম। অনেক দিন, অনেক বছর। একেবারে ছোটবেলা থেকে। তাই মায়া পড়ে গেছে। দেখতে এলাম বাসাটা কেমন আছে। তোমরা দেখি খুব আদর-যত্ন করে রেখেছ। সবকিছু চকচকে নতুন। ছিমছাম গোছানো। আর কেমন নীরব-নির্জন। আমরা কিন্তু বাসাটাকে জ্বালিয়ে মারতাম। সারাক্ষণ দাপাদাপি, হইচই। দেয়ালে আঁকাআঁকি। রং-পেনসিলের দাগাদাগি।’

তাই বুঝি! মুকিম হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ওহ্‌! তাহলে তোমরা এ বাসার আগের ভাড়াটে। তাই বাসার অলিগলি, রাজপথ সব চেনা জানা। কিছু জিজ্ঞেস না করে এক চক্কর ঘুরে আসতে একবারও হোঁচট খেতে হয়নি। কিন্তু ‘আমার সোফা’ ‘আমার ফ্রিজ’ ‘তোমার টেবিল’ কেন? জিনিসপত্র সব ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানে কী? মুকিম তার হিসাব মেলাতে পারে না। তাই অবাক হয়ে তাকায়।

ড্রয়িংরুমে মুখোমুখি সোফায় বসা। দুজন দেখতে প্রায় একই রকম। যেন একই ছাঁচে গড়া দুটো মুখ। ভাইবোন তো বটেই। শুধু কি তা-ই? তারপরও কী যেন আছে দুজনের মধ্যে। প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।

শেষে একসময় মুখে বাক্যে রূপ দিয়েই ফেলে—‘তোমরা কি টুইন? মানে যমজ?’

‘হা হা হা।’ মেয়েটার উচ্ছ্বাসে যেন আরেক দফা জোয়ার আসে। উছলে পড়ে মুখে—‘ধরে ফেলেছ? তুমি তো খুব বুদ্ধিমান। হ্যাঁ, আমরা টুইন ভাইবোন। ও প্রমিত আর আমি প্রমিতা।’

এতক্ষণে মুকিম যেন পায়ের তলায় মাটি পায়। নিজ বাসভূমে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। ওদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ভঙ্গিতে হাত বাড়ায়—‘আমি মুকিম। স্কুলের খাতায় মুকিম মনোয়ার।’

ওরাও একজনের পর আরেকজন হাত বাড়ায়। সহজ ভঙ্গিতে হাত মেলায়। যেন আগের সব ঝুট-জামেলা মিটমাট হয়ে গেছে। এইমাত্র আবার একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছে। বন্ধুর কাছে আবার গোমর কিসের। লুকা-ছাপা কেন? তাই প্রমিতা তাদের গোমর ফাঁস করে—‘জানো, আসার আগে আমরা একটা খেলা তৈরি করি। দেখব তোমাদের বাসার জিনিসপত্র কীভাবে সাজানো। আমাদের যেমন ছিল তেমন নাকি ভিন্ন কোনো ঢঙে। নতুন কোনো অ্যাঙ্গেলে? একটা জিনিস আমাদের মতো করে সাজালে ১০ পয়েন্ট। আমি পাঁচটার নাম করি, প্রমিত পাঁচটার। তারপর কল বেল টিপি। বাসায় ঢুকেই তাই মেলাতে লেগে যাই। দেখে নিই কার কয়টা মিলল। আমার সব কটি মিলে গেছে। সোফা, ফ্রিজ, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর মাস্টার বেড। তোমরা যেখানে যেমন রেখেছ, আমাদেরগুলোও অমন ছিল। তাই আমার পয়েন্ট ফিফটি। প্রমিতের একটা মেলেনি—টিভি। আমাদেরটা ছিল ড্রয়িংরুমের কোনায়। তোমরা রেখেছো বেডরুমে। তাই ওর ১০ পয়েন্ট কম। ফোরটি। হা হা, আমি জিতে গেছি। আই অ্যাম দ্য উইনার...। চলো সেলিব্রেট করি। ফ্রিজে আইসক্রিম আছে? নিয়ে আসি।’

প্রমিতা সোফা ছেড়ে ওঠে। মুকিম হেল্প করতে আগায়। ‘না না, দরকার নেই। বাসার কোথায় কী আছে আমার জানা।’

প্রমিতার বাধা পেয়ে মুকিম আবার বসে পড়ে। রাগ ওঠে মনে—ওহ্‌! ভাবখানা এমন যেন বাসাটা ওদের। ইচ্ছে করে গলা ধাক্কা দিই। ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করি। না, থাক। দুই দণ্ড কথা তো বলা যাচ্ছে। তা ছাড়া একা দুজনের সঙ্গে পাবর কী করে, অ্যাঁ?

প্রমিতা তিন বাটি আইসক্রিম নিয়ে আসে। তা মুখে নিয়েও তার উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে না—ওহ্‌! জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, তুমি কোন স্কুলে পড়ো?

—মোহাম্মাদপুর মডেলে।

—আমরা প্রিপারেটরিতে। দুজন একই ক্লাস—ফোরে। জানো, আমাদের, রোল নম্বরও জোড়া লাগানো। একটার পিঠে আরেকটা। ছয় আর সাত।

—বাহ্‌! তোমরা সবখানেই টুইন।

—হ্যাঁ, আমাদের আরও দুই ভাইবোন আছে টুইন। তারা আসার পর আমরা এ বাসা ছেড়েছি। আরও বড় বাসা নিতে হয়েছে। এই তো, দুটো গলির পরেই আমাদের নতুন বাসা। আসো একদিন। সবাই মিলে অনেক মজা হবে।

—না, আমি যেতে পারব না। মুকিমের গলায় অসহায় ভাবের আনাগোনা। ‘আম্মু যেতে দেবে না। আমি একা তো তাই আম্মু কোথাও যেতে দেয় না।’

—আমরা ঘুরে বেড়াই। দুজনে মিলে স্কুলে যাই। আবার নিজেরাই একা একা ফিরি। বাসায় দুপুরে খেলি। বিকেল হলেই আবার মাঠে খেলতে যাই। সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে আসে। তাদের সঙ্গে খেলি।

—তোমাদের আম্মু যেতে দেয়? বকে না?

—বকবে কেন? আমরা তো দুজন। একজনের কিছু হলে আরেকজন ধরি। পাশে দাঁড়াই। ছোটো ভাইবোন দুজন বড় হলে আরও মজা হবে। সারাক্ষণ শুধু খেলা আর খেলা।

প্রমিতার উচ্ছ্বাসের জেয়ারে মুকিম তলিয়ে যায়। আঁকড়ে ধরার খড়কুটোও পায় না। কারণ, আম্মু ওকে এক মুহূর্তেও জন্যও ছাড়ে না। সারাক্ষণ যেন অদৃশ্য সুতায় বেঁধে রাখে। মনে হয় সারাক্ষণ হাতে-পায়ে না-দেখা বেড়ি বাঁধা। সকালে ড্রাইভার ভাইয়া স্কুলে দিয়ে আসে। আবার দুপুরে নিয়ে আসে। তারপর থেকে বাসায় একা। কারও সঙ্গে একটু কথা বলারও উপায় নাই। আম্মু কোনো কাজের মেয়েও রাখে না। তারা কখন কী আঁচলের তলায় ঢুকায়, ওড়নার খঁুটে বাঁধে তার ঠিক নেই। তাই মুকিমের দুপুর কাটে বই পড়ে, কাটু‌র্ন দেখে, কম্পিউটারে গেম খেলে। কদিন থেকে তা সব বোরিং হয়ে উঠেছে। এক বই কয়বার পড়া যায়। এক কাটু‌র্ন দুবার দেখার কী আছে। আর গেম সব মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই এখন আর উত্তেজনা নেই, মজা সব লোপাট হয়ে গেছে। লম্বা দুপুরে সে তাই জানালার গ্রিল ধরে। তার ফাঁক গলে রাস্তায় চোখ বিছায়। গাড়ি-ঘোড়া, লোকজনের আসা-যাওয়া দেখে।

আজ দুপুরে হঠাৎ কল বেল শুনে ছোটে। এখন কারও বাসায় আসার কথা নয়। তাহলে কে? এক মুঠো বসন্ত বাতাস? তাই কিছু জিজ্ঞেস না করেই দরজা খুলে দেয়। ওরা দমকা হাওয়ার মতো ঢোকে।

হঠাৎ ফোনের আওয়াজে মুকিমের সংবিত ফেরে। জানালার গ্রিল ছেড়ে বেডরুমে যায়। সাইট টেবিলে রাখা ফোন তোলে। এমনিতে আম্মু অফিস থেকে কিছুক্ষণ পরপর খোঁজ নেয়—গোসল করেছ, দুপুরে খেয়েছ, এখন একটু ঘুমাও, আমি এসে হোমওয়ার্ক দেখিয়ে দেব। কিন্তু এখন আবার কেন? অফিস তো শেষ, বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে।

—হ্যালো, আমি আসতেছি। তোমার জন্য কী আনব? আম্মু জিজ্ঞেস করে।

—তিনটা ডেইরি মিল্ক। বড় সাইজের সিল্কবার।

—তিনটা কেন?

—ওরা আছে তো?

মুকিম ফোন রেখে ড্রয়িংরুমে ফেরে। কিন্তু কই, কেউ তো নেই। কে আসবে? আম্মুর নিষেধের দেয়াল টপকে—‘বাইরের ছেলেমেযেদের কাউকে বাসায় ঢুকতে দেবে না। সব দুষ্টুর দল।’

তা ছাড়া নিচে দারোয়ান আছে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পিঁপড়ারও সাততলায় ওঠা সম্ভব নয়। তবে আম্মুর চোখে পড়ে। বাসায় ঢুকেই তাই তার জিজ্ঞাসা—মুকিম, বাসায় কে এসেছিল?

—কই, কেউ না তো।

—ড্রয়িংরুমে তিনটা আইসক্রিমের বাটি কেন। একাই খেয়েছ? এখন জ্বর বাঁধিয়ে বোসো না। গলা বসে যাবে। শেষে গানের পরীক্ষায় ভালো মার্কস তুলতে পারবে না দেখো।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন