গুড্ডুবুড়া তো আবারও হাসির কাণ্ড করে ফেলল।
তারা বেড়াতে গেছে তার ফুপুর বাড়িতে। ফুপুর বাড়িতে একটা টিয়াপাখি আছে। সেই টিয়াপাখির ঠোঁট একেবারে লাল টকটকে।
গুড্ডুবুড়া ভাবল, আহা, আমার ঠোঁটও যদি এই রকম টুকটুকে লাল হতো। তাহলে কী মজাই না হতো।
সে তার ফুপাতো ভাই শান্তকে বলল, ভাইয়া, টিয়াপাখির ঠোঁট এত লাল কেন?
শান্তর বয়স দশ বছর। সে ভীষণ দুষ্টু। সে বলল, টিয়াপাখি কী খায়, দেখো। তাহলেই বুঝবে, তার ঠোঁট লাল কেন?
শান্ত নিয়ে এল একেবারে টকটকে লাল কাঁচা মরিচ।
সেটা টিয়াপাখিটার সামনে রাখতেই পাখিটা ঠুকরে ঠুকরে মরিচ খেতে লাগল।
গুড্ডুবুড়া তো বুঝে ফেলল তাকে কী করতে হবে। লাল রঙের টুকটুকে মরিচ খেতে হবে। এই তো!
শান্ত একটু চোখের আড়াল হয়েছে।
অমনি গুড্ডুবুড়া ফুপুর রান্নাঘরে গিয়ে সবজির ডালা থেকে গোটা পাঁচেক লাল রঙের কাঁচা মরিচ নিয়ে চিবুতে শুরু করে দিল।
ঝোঁকের মাথায় কিছুক্ষণ মরিচ চিবিয়ে খানিকটা খেয়ে ফেলে বুঝতে পারল কত বড় ভুল সে করে ফেলেছে। ঝালে তার মুখ পুড়ে যাচ্ছে, জিব জ্বলে যাচ্ছে, দুই কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মনে হয় সে মরেই যাবে। এখন সে কী করবে। সে কাঁদতে লাগল। চেঁচাতে লাগল।
তারপর তার মনে হলো, চিনি খাওয়া যেতে পারে। সে চিনির বয়াম খঁুজতে লাগল।
প্রথমে সে পেল লবণের বাটি। সেটাকেই চিনি ভেবে মুখে পুরতেই মুখটা আরও বিস্বাদ হয়ে গেল। ওয়াক ওয়াক করে মুখের লবণ ফেলে দিল সে।
তারপর একটা কৌটা দেখতে পেল। ঢাকনাটা খুললেই ভেতরে দেখতে পেল চিনির মতোই একটা কিছু। সেটাই মুখে দিল সে। বড় খসখসে। আসলে তা ছিল ইসবগুলের ভুসি। সেটা তার শ্বাসনালিতে গেল ঢুকে। সে হাঁচি দিচ্ছে, কাশি দিচ্ছে।
ততক্ষণে শান্ত ভাইয়া এসে হাজির। এই, কী হয়েছে?
কী হয়েছে, সেটা বলার মতো অবস্থা কি তখন আছে নাকি গুড্ডুবুড়ার।
শান্ত তাকে প্রথমে পানি দিয়ে বলল, কুলি কর। তারপর দুটো রসগোল্লা দিয়ে বলল, নে, খেয়ে নে।
গুড্ডুবুড়ার তো আবার সমস্যা আছে। সে আজেবাজে জিনিস খাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আসল খাবার সে কিছুতেই খাবে না।
রসগোল্লা দেখেই সে নাক সিটকাচ্ছে। না, খাব না।
খা। ঝালটা যাবে।
খানিকক্ষণ পরে গুড্ডুবুড়া খানিকটা সুস্থ হলো। শান্ত বলল, শোন। ঠোঁট লাল করার উপায় হলো লিপস্টিক। এই সহজ ব্যাপারটা তুই জানিস না।
ফুপুর ড্রেসিং টেবিলে একটা লিপস্টিক ছিল। শান্ত সেটা এনে দেখাল গুড্ডুকে।
দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, গুড্ডুবুড়া তখন বসে বসে লিপস্টিক খেতে লাগল।
একটু একটু করে লিপস্টিকটা কামড় দেয়। কুটুর কুটুর করে চিবোয়। আর কোত করে গিলে ফেলে।
তার পুরোটা মুখ লাল। তার ঠোঁট লাল।
একটু পরে বাথরুমে গিয়ে সে চেঁচাতে লাগল।
তার পেশাবও লাল।
ফুপু দৌড়ে এলেন।
কী হয়েছে?
গুড্ডুবুড়া দেখাল। ওই দেখো।
ফুপু দেখলেন, কমোড লাল হয়ে আছে।
তিনি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন, ওরে তোর কী অসুখ হলো রে। তোর মাকে আমি এখন কী জবাব দেব রে।
শান্ত উঠল। সেও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।
গুড্ডুবুড়ার থুতু লাল। পেশাব লাল। হাত লাল। জিব লাল। ব্যাপার কী।
শান্ত বলল, এই রকম হলো কেমন করে?
গুড্ডুবুড়া বলল, তুমিই তো বুদ্ধি দিলে।
কী বুদ্ধি?
ওই যে লিপস্টিক খাওয়ার বুদ্ধি।
ওরে আমি তোকে লিপস্টিক খেতে বলেছি? লিপস্টিক তো ঠোঁটে দেয়।
ফুপু বললেন, শান্ত, সব দোষ তোমার। ও ছেলে মানুষ, ও কেন লিপস্টিক ঠোঁটে দেবে।
গুড্ডুবুড়াকে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে। ফুপুই নিয়ে গেলেন। লিপস্টিক খেয়েছে, মরিচ খেয়েছে, কি-না-কি হয়ে যায়।
ডাক্তার বললেন, ছেলেটার তো সব ভালো। কিন্তু ওর সমস্যা হলো ও খায় না। না খেলে যেমন মানুষ বড় হয় না, তেমনি মানুষের বুদ্ধিও হয় না। খেতে হবে। পুষ্টিকর খাবার। ভাত খেতে হবে, দুধ খেতে হবে, ফল খেতে হবে, মাছ খেতে হবে, শাকসবজি খেতে হবে, মাংস খেতে হবে। আর খেলাধুলা করতে হবে। সারাক্ষণ ফাস্টফুড খেলে চলবে না। আর সারাক্ষণ ভিডিও গেমস, কম্পিউটার বা মোবাইলে গেমস খেললে সর্বনাশ। তাহলে এত মোটা হয়ে যাবে যে দরজা দিয়ে বের হতেই পারবে না। আর যত রোগ-শোক হয় মোটা মানুষের। কাজেই পরিমিত খাওয়া, নিয়মিত দৌড়ঝাঁপ—দেখবেন এই ছেলে কত বুদ্ধিমান হয়ে যায়। আর কত ‘ফিট’ একটা ছেলে হয়!
এরপর থেকে গুড্ডুবুড়া খেতে শুরু করল পরিমিত খাবার। দুধ খায়। ডিম খায়। ভাত খায়। মাছ খায়। ফল খায়। শাকসবজি খায়।
আর দৌড়ঝাঁপ করে।
কিছুদিনের মধ্যেই সে হয়ে উঠল একটা বুদ্ধিমান ছেলে।
তাদের বাসার পেছনেই একটা রাস্তা। দোতলা বাসা থেকে রাস্তার সবকিছু দেখা যায়।
একদিন সে দেখে, একটা রিকশা যাচ্ছে। রিকশায় দুজন মহিলা।
আর দুটো লোক ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল।
তারা রিকশার সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
গুড্ডুবুড়ার চোখে পড়ল সব।
লোক দুটোর হাবভাব তো ভালো ঠেকছে না। সে দৌড়ে মায়ের মোবাইল ফোনটা নিয়ে এল। মায়ের মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আছে। সেই ক্যামেরায় ছবি তোলা যায়। খানিকটা ভিডিও রেকর্ডও করা যায়।
লোক দুটো বের করে ফেলল ইয়া বড় দুটো ছুরি।
কী বলল, ঠিক শোনা যাচ্ছে না।
মহিলা দুজন হাতের ব্যাগ দিয়ে দিলেন ওই লোক দুটোর হাতে। তারপর হাতের চুড়ি, কানের দুল পর্যন্ত খুলে দিলেন ওদের হাতে।
বোঝাই যাচ্ছে, লোক দুটো ছিনতাইকারী।
গুড্ডুবুড়া ক্যামেরা জুম করে লোকদুটোর মুখের ছবি তুলে ফেলল বারান্দা থেকে।
তারপর খানিকটা ভিডিও করে ফেলল ছিনতাইয়ের দৃশ্য।
এরপর রিকশাটা মহিলা দুজনকে নিয়ে চলে গেল।
গুড্ডুবুড়া ফোন করল তার মিজান মামাকে। মিজান মামা পুলিশের বড় অফিসার।
হ্যালো, মামা?
কে?
আমি গুড্ডু।
কী রে গুড্ডু।
মামা, আমাদের বাসার পেছনে ছিনতাই হচ্ছে। আমি মোবাইলের ক্যামেরায় সব রেকর্ড করে ফেলেছি। ছিনতাইকারী দুজনকে স্পষ্ট চেনা যায়।
তুই থাক বাসায়। মোবাইল ফোনের ছবিটা যত্ন করে রাখ। আমি আসছি।
একটু পরেই মোটরসাইকেলে চড়ে চলে এলেন মিজান মামা।
মা তো অবাক। এই কী হয়েছে? মিজান তুই কোত্থেকে।
মামা বললেন, এই তো আসছি। একটা কাজ আছে। গুড্ডুবুড়ার সাথে। জরুরি কাজ।
মামা মোবাইল ফোনটা সঙ্গে নিয়ে যাবেন। মা বললেন, কী আজব কথা, মোবাইল ফোন নিয়ে গেলে আমি কথা বলব কী করে।
গুড্ডু বলল, মা, তোমার সিমটা বের করে রাখো। তোমার তো আরেকটা সেট আছে। ওটাতে আমি ঢুকিয়ে দিচ্ছি।
মামা চলে গেলেন মোবাইল ফোন সেটটা নিয়ে।
তাঁর অফিসে গিয়ে তিনি সেই ছবি ঢোকালেন কম্পিউটারে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছিনতাইকারী দুজনকে।
পুলিশের গোয়েন্দারা বসল সেই ভিডিও আর ছবি নিয়ে। তারা চিনে ফেলল, কারা এই ছিনতাইকারী।
দুদিন পরে খবরের কাগজে বের হলো বিশাল খবর, দুজন দুধর্ষ সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে। তারা ছিনতাই করে টাকা জোগাড় করছিল। তাদের পরের পরিকল্পনা ছিল একটা বড় ধরনের বিপদ ঘটানো।
গুড্ডুবুড়াকে পুলিশের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়ার কথা উঠল।
গুড্ডুবুড়া বলল, প্রশ্নই আসে না। আমি সামান্য কাজ করেছি। দেশের জন্য আমি এতটুকুন করতে পারব না।
সবাই গুড্ডুবুড়ার কী যে প্রশংসা করতে লাগল।
অলংকরণ: তুলি