দিল্লি বহুদূর

সুলতানি আমলের রাজধানী দিল্লির চিত্র
সুলতানি আমলের রাজধানী দিল্লির চিত্র

সিংহাসনে বসেছেন নতুন এক রাজা। নাম তার গাজি মালিক। সদ্যই বসেছেন তিনি দিল্লির মসনদে। মনমেজাজ তাঁর ফুরফুরে। নিত্যনতুন ফরমান জারি করছেন। যেহেতু নতুন রাজা হয়েছেন, নামটাও তাঁর নতুন হওয়া চাই। তাই তিনি হুকুম দিলেন, উপাধিসহ তাঁর নতুন নাম হবে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক। রাজার ইচ্ছে বলে কথা। কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে যে রাজার আদেশ অমান্য করে? তাই সেই থেকেই চালু হয়ে গেল নতুন এই নাম। সে প্রায় ৭০০ বছর আগের কথা।

সেকালের রাজাদের মাথায় চাপত নানান রকমের খেয়ালখুশি। খেয়ালের বশেই অনেক রাজা করতেন যা খুশি তা-ই। এতে কার কী অসুবিধে হলো, তাতে তাঁদের ছিল থোড়াই পরোয়া। এই রাজারও শখ জাগল নতুন রাজধানী বানানোর। এ তো অন্য কারও নয়, রাজার শখ। তাই সভাসদ, পারিষদ, উজির-নাজির সবার এক ধ্যান। নতুন রাজধানী বানাতে হবে। হলোও তৈরি নতুন নতুন প্রাসাদ, কেল্লা এই সব। রাজার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন রাজধানীর নাম দেয়া হলো তুঘলকাবাদ। যে চারটি শহর নিয়ে দিল্লি গড়ে উঠেছিল, তার একটি ছিল এটি। বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতাও এ কথা লিখেছেন তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে। যদিও জাঁকজমকের কোনোই অভাব ছিল না, কিন্তু রাজার মৃত্যুর বছর দুয়েকের মধ্যেই শহরটা পরিত্যক্ত হলো। কেন টিকল না শহরটা, তা নিয়ে একটা কাহিনি এই ৭০০ বছর ধরে চালু আছে। তা হলো, নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার অভিশাপে শহরটা টেকেনি। তুঘলকাবাদ দুর্গ তৈরির সময় দিল্লির সব মজুরকে জোর করে কাজে লাগিয়েছিলেন রাজা। এই জবরদস্তি পছন্দ করেননি নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ওই শহর টিকবে না।

তো যা-ই হোক, ওই রাজার আমলে বাংলাদেশ ছিল ধনসম্পদে ভরা এক দেশ। সেকালে বাংলাদেশের সিলেট, সোনারগাঁ প্রভৃতি এলাকা ভ্রমণ করেছিলেন ইবনে বতুতা। যন্ত্রযান আবিষ্কৃত হওয়ার আগেকার পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে বেশি দেশ আর কেউই সফর করেননি। বাংলাদেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন: ‘সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি, যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম।’

দিল্লির রাজপথে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক
দিল্লির রাজপথে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক

হাজার হাজার বছর আগে থেকেই বাংলার কাপড়, চিনি, মুক্তা প্রভৃতি রপ্তানি হতো সারা দুনিয়ায়। তাই বাংলার ওপর নজর পড়ল গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের। তিনি ঠিক করলেন, বাংলা দখল করবেন। রাজার কথা খণ্ডাবে কে? তলোয়ারের ঝনঝনানিতে কেঁপে উঠল দিল্লি-তুঘলকাবাদ। হাতি, ঘোড়া, সৈন্যসামন্তের মস্ত বাহিনী নিয়ে স্বয়ং রাজা রওনা দিলেন বাংলার দিকে। চারদিকে সাজ সাজ রব উঠল। শেষ পর্যন্ত রাজা পৌঁছালেন বাংলায়। সোনারগাঁ-লক্ষণাবতী-গৌড়ের শাসকদের বশে আনলেন। এভাবেই কবজা করলেন তিনি বাংলাকে। অবশ্য খুব বেশিদিন দখলে রাখা যায়নি। বাংলায় কিছুকাল পরেই শুরু হয়েছিল স্বাধীন সুলতানদের রাজত্ব। তো, এই তুঘলক বংশের এক রাজার বাংলায় আগমন নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। তা হলো, বাংলায় এসে ইলিশ খেয়ে সেই রাজা এমন মজাই পেলেন যে ইলিশ ছাড়া অন্য কিছু খেতেই চাইলেন না এবং শেষ পর্যন্ত ইলিশ খেতে খেতে মরেই গেলেন।

বর্তমানে তুঘলকাবাদ ভগ্নস্তুপ হয়ে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে
বর্তমানে তুঘলকাবাদ ভগ্নস্তুপ হয়ে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে

যা-ই হোক, বাংলা দখল করে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের দিল্লি ফেরার সংবাদে আমোদ-উল্লাস আর তোরণ বানানোর ধুম পড়ে গেল। রাজধানীতে তখন অবস্থান করছিলেন রাজকুমার পরে মুহম্মদ অর্থাৎ পরবর্তীকালের দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক। এই রাজকুমার যখন দিল্লির সুলতান অর্থাৎ রাজা হয়েছিলেন তখন খামখেয়ালির বশে যেসব কাণ্ডকারখানা করেছিলেন, তাতে আজও কোনো খামখেয়ালিপূর্ণ কাজকারবার দেখলে লোকে বলে তুঘলকি কারবার।

তো, রাজধানীর নিকটবর্তী আফগানপুরে রাজার সম্মানে নতুন বানানো মহলে এসে রাজা দুপুরের খাবারের জন্য বসলেন। আর যেইনা অন্যরা বাইরে গেছেন, অমনি হুড়মুড় করে মহলের ছাদ ভেঙে পড়ল চার পাঁচজন সঙ্গীসহ রাজার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গেই সঙ্গীদের নিয়ে মারা গেলেন রাজা। এই ঘটনা এমন হঠাৎ করে ঘটেছিল, কেউ ভাবতেও পারেনি যে এমন ঘটনাও ঘটতে পারে। কিন্তু রাজার দিল্লি পৌঁছানো  যখন ছিল নিশ্চিত, তখনই নাকি নিজাম উদ্দিন আউলিয়া প্রথমে বলেছিলেন, ‘দিল্লি দূর আস্ত’ অর্থাৎ দিল্লি অনেক দূরে এবং পরে বলেছিলেন, ‘হুনুজ দিল্লি দূর আস্ত’—মানে দিল্লি এখনো অনেক দূরে। এর অর্থ হলো, সবাই যখন ভেবেছিল দিল্লিতে তো তিনি পৌঁছাবেনই, কিন্তু নিজাম উদ্দিন বুঝিয়েছিলেন, দিল্লি পৌঁছানো মোটেই সহজ নয়। এই কাহিনি থেকেই বাংলা ভাষায় ‘দিল্লি বহুদূর’ প্রবাদের প্রচলন হয়েছে। তবে যে কারণেই হোক বাংলা দখল করে ওই রাজার আর দিল্লি যাওয়া হয়নি।