ভালোবাসার জয়

স্টেজের উত্তর দিক থেকে ভিড় ঠেলে সামনে এগোচ্ছে মাহমুদ। একবার আড়চোখে দেখে নেয় চারপাশ। না, ভলান্টিয়ার থেকে প্যানেল মেম্বার—সবাই দর্শকের সঙ্গে হাততালিতে ব্যস্ত। তার এগিয়ে যাওয়াটা কেউ তেমনভাবে লক্ষ করছে না। বাঁ পকেটে নিজের অজান্তেই হাত রাখে সে। ধাতব স্পর্শে স্বস্তি না শঙ্কা, কোনটা যে সে খুঁজে পায়, সেটা ওর অভিব্যক্তিহীন মুখ দেখে সহজে বোঝা যায় না।

স্টেজে উঠলেন হাসান মাস্টার। শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের শিক্ষক। ছোটখাটো গড়নের মানুষটি এ শহরের সবার কাছে শ্রদ্ধার ব্যক্তি। পরিবার-পরিজন বলতে এখানে কেউ নেই তাঁর। শহরের প্রায় শেষ মাথায় একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন তিনি। দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছর শিক্ষকতা করার পর আজ স্বেচ্ছায় অবসর নিচ্ছেন। তাই ডিসেম্বরের শেষ বিকেলে আয়োজিত এ বিদায় অনুষ্ঠানে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছাড়াও হাজির হয়েছেন শহরের সাধারণ মানুষেরা।

পরিকল্পনামতো হাসান মাস্টার স্টেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেছে মাহমুদ। তার হাতে আইফোন সিক্স এস। ফোনের ক্যামেরা অন করে ক্রিম কালারের স্যুট পরা মাহমুদ যেভাবে স্টেজের সামনে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রদের ভিড়ে দাঁড়াল, তাতে সন্দেহের তেমন অবকাশ থাকে না। আর দশটা প্রাক্তন ছাত্রের মতোই মুগ্ধ অভিব্যক্তি তার চোখে-মুখে। কার সাধ্য তার আসল উদ্দেশ্য বুঝে ফেলে!

স্টেজের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন মাস্টার। পরনে গরদের পাঞ্জাবি, স্কুল থেকে দেওয়া লাল-সবুজ উত্তরীয় তাঁর কাঁধে জড়ানো।

দৃপ্তকণ্ঠে বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘বিদায়বেলায় আমি কতটা স্মৃতিকাতর, তা বললে দেশ বা দশের কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। এই স্কুলটাকে আমি কতটা ভালোবাসি, সেটা আমি যতই বলি কখনো বোঝানোও যাবে না। তবে আমি কী বলব আজ? বরং একটা গল্প বলা যাক।’

মনে মনে ‘টিপিক্যাল হাসান মাস্টার!’ বলে একটা বাঁকা হাসি হাসল মাহমুদ। বলতে বলতে নিজের অজান্তেই মাহমুদ চলে যায় ১১ বছর আগের এক দিনে। ক্লাস ফোর, সেকশন বি। বছরের প্রথম দিনের ক্লাসে রোল কল করছিলেন হাসান চৌধুরী। ‘ফোরটি টু, মাহমুদ মন্ডল’ বলে খানিকটা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। টাইটেল থেকেই কী ওর পারিবারিক পরিচয়টা বুঝে নিয়েছিলেন তিনি? কখনো জিজ্ঞেস করেননি অবশ্য। অন্য সব শিক্ষক যখন কী পড়তে হবে, কেন পড়ছ না-র গণ্ডিতে বাঁধা, তখন তিনি ক্লাসের শুরুতেই বললেন, ‘প্রথম দিন আর পড়ার বই খুলে কী লাভ? ওটা বাকি বছরের জন্য তোলা থাকুক। তবে আমি কী বলব আজ? বরং একটা গল্প বলা যাক।’ হ্যাঁ, অন্য সবার মতো ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিল মাহমুদও। কিন্তু সেই মুগ্ধতা কাটতে সময় লেগেছে খুব অল্প। বাড়ি ফেরার পথে যখন সরদার চাচাকে ক্লাসে গল্প বলা এই দারুণ শিক্ষকের কথা বলতে শুরু করেছিল দশ বছরের ছোট্ট মাহমুদ, তখনই সে জানতে পেরেছিল এক নির্মম সত্য। তারপর থেকেই শুরু হয় মাহমুদের অপেক্ষার পালা, নিজেকে তৈরি করার পালা।

হাসান চৌধুরীর কথায় ছেদ পড়ে মাহমুদের স্মৃতিচারণায়। তিনি বলে চলেছেন, ‘আমি এ শহরে এসেছি আজ থেকে সাতচল্লিশ বছর আগে। এ শহরে আমি জন্মাইনি। আমার শৈশব কেটেছে পদ্মাপাড়ের এক অন্য জায়গায়। তবু এখানে আমি কেন কাটালাম জীবনের সাতচল্লিশ বছর? গল্পটা হয়তো সে প্রশ্নেরই উত্তর দেবে আজ।’

চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে মাহমুদের। সাতচল্লিশ বছর আগের কোন গল্প শোনাবে হাসান মাস্টার?

‘প্রথম যখন এ শহরে আসি, তখন এত ভালো জামাকাপড় ছিল না আমার। একটা মাত্র শার্ট আর লুঙ্গি, আমার মাথায় তখন গুলির বাক্স, হাতে–পায়ে কাদামাটি। কাঁধে একটা রাইফেল আর ভীষণ সাহসী চার তরুণ ছিল আমার সঙ্গী। তাদের মধ্যে একজন শাহেদ—লাজুক চেহারার স্থানীয় এক যুবক—কবিতা পড়ছে, কবিতা লিখছে, আড্ডায় বসা মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ তার। শহরের শেষ মাথার ঘন জঙ্গল তখন আমাদের আস্তানা। আর এই যে তোমাদের স্কুলঘর—এটা তখন পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। আশপাশের ছয়টি শহরে এখান থেকে অপারেশন চালায় ওরা। আমরা চারজন এসেছিলাম গুলির বাক্স জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে শহরটা রেকি করতে।’

মাহমুদ সন্তর্পণে ঘড়ি দেখে নেয় একবার। কপাল ঘামছে তার, খানিকটা ভয় কি গ্রাস করছে তাকে? সে মনে করতে চেষ্টা করে ট্রেইনারের কথাগুলো, ‘ভয় ঘিরে ধরলে ভাববে এ মৃত্যু গর্বের...’

কিন্তু না, হাসান চৌধুরীর নাটুকে বক্তব্য তাকে আবার ভাবনা থেকে ফিরিয়ে আনে। লোকটার কথায় জোর আছে বলতে হয়। একমনে তিনি বলে চলেছেন, ‘ক্যাম্প থেকে নিজের বাসায় যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা আমাদের ওপর ছিল। তবু শাহেদ যখন বলল ওর বড় বোনের একটি মেয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ আগে,‌ কমান্ডার হিসেবে আমার নিষেধ করার কথা থাকলেও কেন যেন অনুমতি দিলাম আমি। এই একটি সিদ্ধান্ত ছাড়া জীবনের আর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার আফসোস নেই। সে রাতে ধরা পড়ে শাহেদ। রাজাকার মন্ডল পাকিস্তানি বাহিনীকে শাহেদের আগমনের খবর দেয়, তার বাড়ি চিনিয়ে দেয়। শাহেদসহ পরিবারের সবাইকে, আবারও বলি, এক মাসের একটা শিশুসহ সবাইকে মেরে ফেলে পাকিস্তানি হানাদাররা।’

‘রাজাকার মন্ডল’—শুনতে শুনতে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে মাহমুদের। নিজের দাদার নাম এতটা ঘৃণাভরে কাউকে বলতে শোনা...উফ! অবশ্য এ শহরে যত দিন ছিল, তত দিন লোকমুখে ‘মন্ডল’ নামটা কখনো সম্মানের সঙ্গে শুনেছে বলে মনে পড়ল না তার।

ওদিকে হাসান মাস্টার বলে চলেন, ‘এরপরের কাহিনি আমি বহুবার বলেছি। হাসান বাহিনীর বিজয়ের গল্প সবার জানা। ঠিক এক দিন পরই আমরা ফুল ফোর্স নিয়ে অ্যাটাক করেছিলাম পাক বাহিনীর ক্যাম্প। দীর্ঘ ছাব্বিশ ঘণ্টা যুদ্ধের পর এ শহরকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করার সেই গল্প আপনাদের সবারই জানা। আমার মনে পড়ে এ শহর দখলের পর বিজয়োল্লাস করিনি আমরা। শাহেদের মৃত্যু, এক মাস বয়সী শিশুটির মৃত্যু ঘিরে ধরেছিল আমাদের। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই আমরা ছুটে গিয়েছিলাম শাহেদের বাড়িতে, সেখানে তখনো পড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির লাশ। আমাদের পনেরো জনের দলটির উপস্থিতিতে দাফন করা হয় তাদের।’

মাহমুদ অস্থির হয়ে উঠছে ভেতরে–ভেতরে। আর কত বিজয়ের কাহিনি শোনাবে হাসান চৌধুরী? এই বিজয়ের গল্পগুলো শুনতে শুনতে যখন চোখ মুছেছে শহরবাসী, হয়েছে গর্বিত, তখন মাহমুদ ট্রেনিং নিয়েছে দূর পাহাড়ের এক ক্যাম্পে। শৈশব থেকে তাকে যে তাড়া করে বেড়িয়েছে একটিমাত্র গল্প। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান চৌধুরীর গুলিতে মারা যায় তার দাদা। তাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে সবার সামনে দাদাকে গুলি করেছিল এই হাসান চৌধুরী। তার স্পষ্ট মনে পড়ে এই শহরের অনেক মানুষই নিকৃষ্ট হিসেবে দেখত তার পরিবারকে। সচ্ছলতার মুখ ছোটবেলা থেকেই দেখেনি সে। বড় মামার কাছে যখন তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা, সেখানেও ছিল অভাবের তাড়না। ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আবির্ভাব ঘটেছিল কমান্ডারের। তার ট্রেইনার। কমান্ডার তাকে শুনিয়েছে শক্ত হওয়ার আশ্বাস, দিয়েছে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। অনর্থক বেঁচে থাকার চেয়ে সঠিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা যে কতটা জরুরি, সেটা ট্রেনিং থেকেই জেনেছে মাহমুদ। কমান্ডারের কথাগুলো মাথার মধ্যে বাজতে থাকে তার, ‘তুমি ভয় পাবা না। তোমার বাবা যেমন নিজ আদর্শ রক্ষায় নিজের প্রাণ দিলেন, সেটা তুমিও ধারণ করবা। মনে রাখবা তোমার কথা না, তোমার কাজ মানুষকে প্রভাবিত করবে। তোমার কাজ মানুষ মনে রাখবে। এখন অ্যাকশনের সময়। তুমি প্রস্তুত?’

আবার মাহমুদকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে হাসান চৌধুরী, ‘যে শহরের মাটিতে এত শহীদের রক্ত মিশে আছে, সেই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে যখন মানুষেরা হিংসার কথা, একে অন্যকে মেরে ফেলার কথা ভাবে, আমার ভীষণ ভয় হয়। আমাদের কবিতা পড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখের শাহেদ ছেলেটি, যে জীবনের অর্ধেক দেখার আগেই দেশের জন্য প্রাণ দিল, সে কি এমন শহর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না? আমি জানি আমার কর্তব্য পুরো দেশের প্রতি। কিন্তু জীবনে যতবার ভেবেছি আমি এ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাব, আমার মনে পড়ে যায় শাহেদের বোনের সদ্যোজাত মেয়েটির কথা। আমার বারবার মনে হয়েছে ওর মৃত্যুটা তো আমি অযথা হতে দিতে পারি না, তাই আপনাদের এই শহরে থেকে এখানকার মানুষের জন্যই আমি কিছু করতে চেয়েছি আজীবন।’

মাহমুদের মেরুদণ্ড বেয়ে নামছে একটা শীতল স্রোত। শহরের যে খালটিতে সে প্রথমবার নৌকা চালিয়েছিল, সে খালটির কথা মনে পড়ছে তার। চাচার ছোট মেয়েটির চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখে। পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, যা কিছু ভালো লাগার সব যেন একে একে ভিড় করছে তার মনে। মৃত্যু এগিয়ে এলে কি এমনটা হয়? এত সব রেখে মরে যাওয়াটা কি খুব জরুরি?

ওদিকে বলে চলেন হাসান মাস্টার, ‘আমি বলি, আপনারা ভয় পাবেন না। শাহেদ, শাহেদের পরিবারের মতো আপনাদের আপনজন, এ শহরবাসী, পুরো দেশে ত্রিশ লাখ মানুষ এ দেশ রক্ষায় নিজের প্রাণ দিলেন, সে আদর্শ আপনারা ধারণ করুন। অস্ত্র দিয়ে আমরা প্রতিহত করেছি পাকিস্তানিদের। এবার আপনাদের পালা ভালোবাসা দিয়ে, নিয়মের মধ্য দিয়ে হিংসা, সন্ত্রাস, উগ্রবাদ প্রতিহত করা। অন্যায়ের পাহাড়, মৃত্যুর মিছিল আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। আপনার এবং আপনার পাশের জনের ভাবনা যদি এক না হয় তা নিয়ে কথা বলুন, সহিংসতা কোনো সমাধান হতে পারে না।’

মাহমুদের মাথাটা এবার ঘুরে ওঠে। ঘড়িতে ৫টা বেজে ৩০ মিনিট। একটা বাটনে হাত রাখলেই উড়ে যাবে চারপাশ, মুগ্ধ চোখে বসে থাকা দর্শকসারিতে শুরু হবে মৃত্যুর মিছিল। মাহমুদের কমান্ডারের ভাষায়, ‘ভয় আর মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র নেই।’ কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যেন কোনো জাদুমন্ত্রবলে আটকে ফেলেছে মাহমুদকে। হঠাৎই তার মনে হচ্ছে মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকাই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।

মাহমুদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় একঝাঁক পাখি। করতালিতে মুখর হয়ে উঠছে পুরো মাঠ। হাসান মাস্টার বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কেননা ভালোবাসাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।’

করতালির শব্দ বাজছে, উদ্‌ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদ। তার মনে হয় উড়ে যাওয়া পাখিগুলো দূর থেকে বলে চলেছে, ‘ভালোবাসাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।’

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক