ভূত পার্কে ভূতোদয়

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

খবরের কাগজে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটা দেখেই চমকে উঠল নাবিন।

জরুরি ভিত্তিতে কিছু ভূত নিয়োগ দেওয়া হবে। বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। নানা বয়সী ভূত দরকার। যাঁরা ভূত হতে ইচ্ছুক, শিগগির যোগাযোগ করুন। বেতন আলোচনা সাপেক্ষে।

বিজ্ঞপ্তির নিচেই ঠিকানা দেওয়া। আরে! এটা তো ওর স্কুলের কাছেই। দেখবে নাকি একবার গিয়ে?

২.

বাড়িটার সামনে এসে ঘাবড়ে গেল নাবিন। এই বাড়ি! বাড়িটা প্রতিদিনই দেখে ও। একবার স্কুলে আসার পথে, আরেকবার স্কুল থেকে যাওয়ার পথে। একদিন বাড়িটার ভেতরে ঢুকতেও চেয়েছিল। আকাশ ওকে সাবধান করে দিয়েছিল, খবরদার, জানিস ওটা কিসের বাড়ি?

কিসের?

ভূতের বাড়ি। ওই বাড়িতে ভূত থাকে।

আমি ভূত দেখব।

ভূত দেখা যায় না।

তাহলে কেমন করে বুঝলি ওটা ভূতের বাড়ি?

সবাই তো সেটাই বলে।

ও আচ্ছা।

এরপর কেন যে বাড়িটার ভেতরে ঢোকা হয়নি জানে না ও। কিন্তু আজ! বাড়ির সামনে গিজগিজ করছে। কারা ওরা? ভাবতে লাগল নাবিন। মানুষ-ভূত নাকি ভূত-মানুষ?

বাড়ির ভেতর ঢুকল ও। একটা টোকেন নিল। টোকেন নম্বর ছিয়াশি। খানিক পরেই ওর ডাক পড়ল। এই প্রথম বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে গা ছমছম করল ওর। যদিও বাড়িটা আর অন্য বাড়ির মতো খুব সাধারণ। তবে হ্যাঁ, ছাদ অনেক উঁচু। আর পুরোনো বাড়ি। নতুন বাড়িতে তো আর ভূতেরা থাকে না।

৩.

তুমি ভূতের গল্প পড়ো?

লোকটার মুখের দিকে তাকাল নাবিন। ক্লিন শেভ। ব্যাক ব্রাশ করা চুল। গলায় টাই। গায়ে কোট। এই গরমে কেউ কোট-টাই পরে? অবাক হলো নাবিন। ভূতেরা পরতে পারে।

নাবিন জবাব দিল, জি না স্যার। ভূত আমার ভালো লাগে না।

তাহলে ভূত হতে চাও কেন?

আমার ভয় দেখাতে ভালো লাগে।

ভয় পেতে ভালো লাগে না?

না।

ভূতের মতো চলাফেরা করতে পারবে? আমাদের ভূত পার্কে কিন্তু ভূতের মতো চলাফেরা করতে হবে।

পারব স্যার।

উঁহু। পারবে বলে মনে হয় না।

কেন স্যার?

কবন্ধ ভূতের নাম শুনেছ? তোমাকে আমরা কবন্ধ ভূত বানাতে চাই।

তাহলে কি আমার ভুতুড়ে চাকরিটা হয়ে গেছে?

ভুতুড়ে চাকরি নয়, ভূত হওয়ার চাকরি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তা ছাড়া তোমার বয়সী কেউ আসেনি। আমাদের তো নানা বয়সী ভূত দরকার। তোমার সাহস আছে। তা কবন্ধ ভূত চেনো?

না স্যার।

তাহলে কীভাবে পারবে! ভূতের যত বই আছে কিনে নিয়ে পড়ে ফেলো। সাত দিন পর চাকরিতে জয়েন করবে।

কিন্তু আমার স্কুল!

প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ডিউটি। তা-ও বিকেলে। তোমার স্কুল ছুটির পরই। সপ্তাহে এক দিন শুধু চার ঘণ্টা। মানে সন্ধ্যার পর আরও দুই ঘণ্টা। বাসায় রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার।

বলেই নাবিনের হাতে একটা কুচকুচে কালো খাম ধরিয়ে দিয়ে লোকটি বললেন, এই নাও তোমার জয়েনিং লেটার। জয়েন করার ইচ্ছে থাকলে সাত দিন পর এসো। আর আসার আগে অবশ্যই ভূতের বই পড়ে আসবে। বিশেষ করে কবন্ধ ভূত সম্পর্কে।

৪.

সাতটা মানুষ-ভূত হিসেবে চাকরি পেল ভূত পার্কে।

সাতটা ভূত।

ভূত পার্কটাও নাবিনদের বাসার কাছে। বাসা থেকে গুনে গুনে ঠিক চার মিনিটের হাঁটাপথ।

যারা ভূত দেখতে চায়, তারাই ভূত পার্কে যায়। ভূতের মতো ঘোরাঘুরি করে মানুষ। নানা আকারের মানুষ। সবাই ভয় দেখাতে চায়। আর ভয় দেখার জন্যই ভূত পার্কে বেড়াতে আসা মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন জমজমাট থাকে ভূত পার্ক। পার্কে ঢোকার আগে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পার্কের সাতটা ভূত সম্পর্কে। কিন্তু একদিন...

আটটা ভূতের দেখা মিলল পার্কে। একটা ভূত কোত্থেকে এল?

পার্কের মাইকে ঘোষণা হলো, পার্কে একটা নতুন ভূত এসেছে। সে ভূতের ব্যাপারে পার্ক কতৃ‌র্পক্ষ অবগত নহে। সবাই নিজ উদ্যোগে সামলে থাকবেন। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য পার্ক কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।

বাবা-মায়েরাই শিশুদের ভূত পার্কে নিয়ে আসেন, যাতে ভূত দেখে কেউ ভয় না পায়। ভূত পার্কে আসা অনেক শিশু ভূত দেখে ভয় পেত। সঙ্গে সঙ্গে মুখোশ খুলে ওদের দেখিয়ে দেওয়া হয় যে আসলে ওরা ভূত নয়। মানুষ। কেবল ভূত সেজেছে। ভূতের ভয় কাটানোর জন্যই এই ভূত পার্ক।

কিন্তু এখন?

৫.

বাকি ছয়টা ভূতকে ভালোমতোই চেনে নাবিন। কিন্তু আরেকটা ভূত কে?

ভূতের মুখোশ খুলে পার্কে ঘুরে বেড়াতে লাগল নাবিন। পার্কটা খাঁ খাঁ করছে। আরেকটা ভূতের খবর আর ঘোষণা শুনেই খালি হয়ে গেল পার্ক। ঘুরতে ঘুরতে একটা সেগুনগাছের কাছে এল নাবিন। বিকেলের আলো ফুরিয়ে এসেছে সেই কখন। সন্ধে হব হব করছে। আজ ওর সন্ধের পরও দুই ঘণ্টা বেশি ডিউটি দেওয়ার কথা। কিন্তু সেগুনগাছে ঠেস দিতেই কিছু একটা ঠেকল ওর পিঠে। চমকে পেছনে ফিরল ও। আরে! কী ওটা?

চমকে নাবিন বলল, কে তুমি?

ভূত।

ভূত! সত্যিকারের ভূত?

ভূত কখনো মিথ্যে হয় নাকি?

নাহ্‌! ভূত মিথ্যা। সত্যি ভূত বলতে কিছু নেই।

না। ভূত সত্যি। মিথ্যে ভূত বলতে কিছু নেই।

আমি বিশ্বাস করি না।

প্রমাণ চাও?

দেখাও।

হঠাৎ চোখের সামনে কুয়াশার মতো সাদা একটা ভূত দেখল নাবিন। অবাক হয়ে দেখল, ভূতটা হাঁটছে কিন্তু পা পড়ছে না মাটিতে। ভূতটা উড়ছে, একা একা। ভূতটা হাসছে, কিন্তু ওর হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ভূতটা কাঁদছে, কিন্তু ওর চোখের জল গড়াচ্ছে না। ভূতটা নাচছে। আর নাচতে নাচতে মিলিয়ে গেল বাতাসে। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল নাবিন। ভূতটার দেখা নেই। কোথায় গেল?

নাবিন ডাকতে লাগল, ও ভূত, কোথায় গেলে?

ভূত বলল, এই তো আমি।

তোমায় দেখছি না কেন?

কারণ, আমি ভূত। ভূতের দেখা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দুনিয়ার সবাই ভূতের দেখা পায় না। তুমি পেয়েছ। তুমি বড়ই সৌভাগ্যবান।

এবার একটা বুদ্ধি করল নাবিন। চেঁচিয়ে বলল, আমি তোমায় একটু ধরে দেখতে চাই।

হঠাৎ হাতে কিছু একটা টের পেল নাবিন। হুঁ। ভূতের ছোঁয়া পেল ও। গা ছমছম করে উঠল ওর। ওদিকে তখন সন্ধে নেমে গেছে। চারপাশ বেশ অন্ধকার। ওর হাত ধরা মাত্রই ভূতটাকে জাপটে ধরল নাবিন। ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল ভূতটা। মনে হচ্ছে যেন পেঁজা তুলোর মানুষ ধরে রেখেছে ও। ভূতটাকে ধরেই চেঁচিয়ে উঠল—ভূত ভূত। ভূত ধরেছি, ভূত।

হঠাৎ গরম নিশ্বাস পড়ল ওর ঘাড়ে। মনে হলো যেন শার্টের ভেতর দিয়ে চামড়া পুড়ে গেছে এতই গরম। এবার সত্যি সত্যি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে ও। মনে হচ্ছে অদৃশ্য দুটো হাত জাপটে ধরা ভূতটাকে ছাড়াতে চাইছে ওর কবল থেকে। একসময় আর ধরে রাখতে পারল না নাবিন। জাপটে ধরা ভূতটা ছুটে বেরিয়ে গেল। দুটো ভূতের ছুটে যাওয়া টের পেল ও।

৬.

পরদিন। ভূত পার্কে ছয়টা ভূত। একটা ভূত নেই। নেই কেন? কে জানে কেন নেই? অনেক রকম খোঁজাখুঁজি করা হলো। কিন্তু খোঁজ মিলল না। তবে কি ওটা সত্যিকারের ভূত ছিল? হতে পারে। গত সন্ধ্যার কথা ও বলেছিল, কিন্তু কেউ বিশ্বাসই করতে চাইল না। সেটা নিয়ে অবশ্য নাবিনের মাথাব্যথা নেই। ওর দুঃখ কেবল একটাই—হাতের নাগালে পেয়েও একটা ভূত ছুটে গেল! আরেকটা ভূত না ধরা পর্যন্ত ওর এই দুঃখ যাবে না।