এক সপ্তাহ আগে কারিব ভাই আমাকে একটি বই পড়তে দিয়েছেন। বইটির নাম বোয়িং: দ্য কমপ্লিট স্টোরি। ইতিহাসের বই। নির্দিষ্ট করে বললে বিমানচালনা বিষয়ক ইতিহাস। বইটি লিখেছেন অ্যালান পিলেটার। ২৫৮ পৃষ্ঠার। খুব বেশি পুরোনো নয় বইটি। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় হেইনেস পাবলিশিং থেকে। বইটি এখনো পড়া শেষ হয়নি। মাত্রই দুদিন হলো শুরু করেছি। কিন্তু মনে হলো পড়ে যে যে বিষয়ে মজা লেগেছে, তা ভুলে যাওয়ার আগেই তোমাদের জানিয়ে রাখি।
পৃথিবী বিখ্যাত বিমান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বোয়িং কীভাবে শুরু হলো এই কাহিনি অনেক মজার। উইলিয়াম এডওয়ার্ড বোয়িংয়ের (যাকে আমি এই লেখায় মিস্টার বোয়িং বলব) জন্ম ১৮৮৮ সালের ১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েডে। মা অস্ট্রিয়ান আর বাবা জার্মান। আট বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর মিস্টার বোয়িংয়ের মা তাঁকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। মিস্টার বোয়িং আমেরিকায় ফিরে আসেন ১৯০০ সালে। ১৯০৩ সালে তিনি বাবার মতোই কাঠের ব্যবসা শুরু করেন।
চিন্তা করতে কেমন লাগে, বোয়িং কোম্পানির মালিক গাছের গুঁড়ির গায়ে বিদেশি পানের পিক মুছতে মুছতে বলছেন, ‘আব্বে ওই জামাইল্লা, গুঁড়িডা আজকে টেরাকে তুইলা ফালা, পাট্টি আইব নিতে।’ কিন্তু এ রকম কিছু হয়নি। তাহলে আমরা জীবনেও ৭৪৭ জাম্বো জেটে উঠতে পারতাম না। পৃথিবীর লাখো মানুষ বিমানচালনা বিষয়ে যেভাবে উত্সাহী হয়, ঠিক সেভাবে মিস্টার বোয়িংকেও প্লেন পোকায় কামড়াল ২৯ বছর বয়সে।
সময়টা জানুয়ারি ১৯১০। মিস্টার বোয়িং লস অ্যাঞ্জেলেসে এলেন এয়ার শো দেখতে। দ্য ফাস্ট বিগ আমেরিকান এয়ার শো। তখন চলছে বাইপ্লেনের যুগ। দুই পাখাওয়ালা আর একদমই বেসিক ইঞ্জিনওয়ালা প্লেনগুলো দেখে মিস্টার বোয়িংয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেল। তুমি যদি প্লেন-পাগল হও তাহলে বুঝতে পারবে সেই অনুভূতি। আকাশে উড়ন্ত সেই পাখি তখনও বিস্ময় জাগিয়েছে, এখনো জাগাচ্ছে।
মিস্টার বোয়িং ভিড় ঠেলে এয়ার শোর এক পাইলটের কাছে গিয়ে আবদার করলেন তাঁকে যেন একবার একটু প্লেনে ওঠানো হয়। ফারম্যান বাইপ্লেনের পাইলট লুইস পলহ্যান ২৯ বছর বয়সী এই লোকের আবদার শুনে পাত্তা দিলেন না। অনেক মন খারাপ নিয়ে সিয়াটলে ফিরে গেলেন মিস্টার বোয়িং।
তিনি যদি সাধারণ কেউ হতেন তাহলে কদিন পর মন খারাপটা ভুলে যেতেন। কিন্তু লিজেন্ডরা মন খারাপ করা মানে পৃথিবী নতুন কিছু একটা পেতে যাচ্ছে। মিস্টার বোয়িং বিমানচালনাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। সিয়াটল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে মিস্টার বোয়িংয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো আরেক প্লেন-পাগলের। তিনি এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) থেকে বিমানচালনাবিদ্যা পাস করেছেন আর সদ্যই মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাঁর নাম কনরাড ওয়েস্টারভেল্ট। বিমান নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হলো।
১৯১৪ সালে টেরাহ মেরুনি নামের এক পাইলট একটা কাটিংস সিপ্লেন নিয়ে লেক ওয়াশিংটনে এলেন স্বাধীনতা দিবসের উত্সবে যোগ দিতে। প্লেন দেখে তো মিস্টার বোয়িংয়ের ১৯১০ সালের সেই পুরোনো দুঃখ আবার জেগে উঠল। তিনি ভয়ে ভয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, আপনার প্লেনে একটু উঠতে দেবেন?’ এই পাইলট ভালো ছিলেন। তিনি প্রথমে মিস্টার বোয়িংকে নিয়ে একবার উড়লেন। তারপর তাঁর বন্ধু মিস্টার ওয়েস্টারভেল্টকে নিয়েও উড়লেন। এই বোয়িং লোকটা কী অসাধারণ ছিল চিন্তা কর। এত ঝামেলা করে চার বছর অপেক্ষা করে জীবনে প্রথমবার প্লেনে ওঠার পরও তাঁর বন্ধু মিস্টার ওয়েস্টারভেল্টকে বললেন, ‘এটা কিছু হলো? এই প্লেন বেশি সুবিধার নয়। তুমি আর আমি মিলে এর চেয়ে ভালো প্লেন বানাতে পারব না?’ মিস্টার ওয়েস্টারভেল্ট বললেন, ‘অবশ্যই পারব।’ শুরু হলো দ্য গ্রেট বোয়িং অ্যাডভেঞ্চার। তাঁরা একটা প্লেন বানানো শুরু করলেন, যার নাম এই দুই বন্ধুর নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে রেখেছিলেন বিএন্ডডব্লিউ।
কিন্তু যথারীতি বাধা এল। ১৯১৫ সালে মিস্টার ওয়েস্টারভেল্টকে ইউএস নেভি বদলি করে দিল অন্য জায়গায়। মিস্টার বোয়িং কি তাতে থেমে গেলেন? না। ১৯১৬ সালের জুন মাসে বিএন্ডডব্লিউ বানানো শেষ হলো। মিস্টার বোয়িং একজন পাইলট খুঁজে বের করলেন, যিনি তাঁর হয়ে প্লেনটিকে পরীক্ষা করে দেবেন। পাইলটের নাম হার্ব মুনটার। ঠিক হলো ১৫ জুন, ১৯১৬, এই শুভ দিনে এই প্লেন পরীক্ষা করা হবে।
১৫ জুন, ১৯১৬। মিস্টার বোয়িং লেক ওয়াশিংটনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তো আছেনই। পাইলটের কোনো খবর নেই। বিরক্ত হয়ে তিনি ভাবলেন, নিজেই প্লেন চালাবেন। কারণ, ইতিমধ্যে তিনি ১৯১৫ সালে প্লেন চালানো শিখেছিলেন। পাইলট যখন লেকের পাড়ে এলেন। তিনি দেখলেন, মিস্টার বোয়িং প্লেন নিয়ে টেক অফের জন্য চলা শুরু করেছেন। বিএন্ডডব্লিউ আকাশে উড়ল এবং সফলভাবে নেমেও এল।
তারপর থেকে তার যাত্রা আর থামেনি। মিস্টার বোয়িংয়ের দ্বিতীয় প্রকল্প ছিল একটা সি-ফোর বিমান। সেটাও সফলভাবে শেষ হয়। ১৯১৭ সালে তিনি কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে দ্য বোয়িং কোম্পানি রাখেন আর মাসে ৯০ ডলার বেতনে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে পাস করা দুজন প্রকৌশলী নেন। ক্লেমন্ট এল ক্লেয়ার আর ফিলিপ জনসন নামের এই দুই প্রকৌশলীকে বলা হয় বোয়িং কোম্পানির পিলার, যাঁরা পরে বোয়িংয়ের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
প্লেনে উঠতে না পেরে ১৯১০ সালে মন খারাপ হয়েছিল যে ছেলেটির সে নিজেই তার বিমানের ডিজাইন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিমানচালনার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বোয়িং। প্রতিষ্ঠানটি এখন শুধু বিমানই বানায় না, বানায় রোটরক্রাফট, স্যাটেলাইট ও রকেট। এর সম্পদের পরিমান বর্তমানে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার, কর্মচারীর সংখ্যা ১৬২৭৩০ জন।
পরেরবার মন খারাপ হলে এ ঘটনা মনে করে নিজের পছন্দের কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পার।