দোলটু মামার রহস্যভেদ

শীত জাঁকিয়ে বসেছে। দোলটু মামা গায়ের শালটা ভালোভাবে মুড়ে নিতে নিতে বললেন, ‘ঠান্ডা একটু বেশি লাগছে মনে হয়! সব জানালা বন্ধ আছে তো?’

‘তোমার মামা গরমও যেমন বেশি লাগে, ঠান্ডাও বেশি লাগে,’ বলল তাহজিব। স্কুল ছুটি। তাই এখন গল্পের বই পড়ে ও গল্প করে সময় কাটছে ওর।

‘বরফের দেশে গেলে যে তুমি কী করতে মামা,’ যোগ করল মায়শা।

‘তোরা বড্ড বেশি কথা বলিস,’ দোলটু মামা ধমকে উঠলেন। ‘আমি বরফের দেশে যাব কেন?’

‘সে যা-ই বলো মামা, ইউরোপ-আমেরিকার যেসব দেশে শীতের সময় বরফ পড়ে, সেসব দেশে ঠান্ডার ব্যাপারটাই আলাদা,’ মায়শা বলল। ‘ভেবে দেখো, বাইরে বরফ পড়ছে, আমরা ঘরের ভেতরে আগুনের পাশে বসে আছি। কেমন যেন একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার।’

‘আচ্ছা মায়শা আপু,’ তাহজিব প্রশ্ন করল। ‘যখন প্রচুর বরফ পড়ে, তখন রহস্যময় বিভিন্ন ঘটনাও ঘটে, তাই না?’

‘তা তো ঘটেই,’ মায়শা জবাব দিল। ‘আচ্ছা, বরফ নিয়েই একটা রহস্য গল্প বলি। দেখি তোমরা রহস্য ভেদ করতে পারো কি না।’

‘এটা কোনো ব্যাপার,’ দোলটু মামা বললেন। ‘বলো দেখি কী এমন রহস্য!’

‘লন্ডনের কোনো এক শহরতলির ঘটনা,’ মায়শা বলতে শুরু করল। ‘এক অধ্যাপক খুন হয়েছেন। রাতে তাঁরই এক বন্ধু খবরটা দিয়েছেন থানায়। তিনি আবার একজন চিকিৎসক। খবর পেয়ে পুলিশ এসেছে। আরও লোকজন জড়ো হয়েছে।’

‘আপনি কীভাবে জানলেন যে আপনার বন্ধু খুন হয়েছেন?’ এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রশ্ন করলেন চিকিৎসককে।

‘আমি সন্ধ্যার পর চেম্বার থেকে বাসায় ফিরছিলাম,’ চিকিৎসক বলতে শুরু করলেন। ‘এ কয় দিন যে রকম বরফ পড়ছে আর ঠান্ডা বাড়ছে, তাতে রাতে আর চেম্বার করছি না। আর আমার ফেরার পথেই ওর বাসা। একবার ভাবলাম, ঢুকে একটু কফি খেয়ে যাই। রাস্তার ওপর থেকেই দেখছিলাম যে ওর স্টাডি রুমে আলো জ্বলছে। লন ধরে এগিয়ে গেলাম। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল জমে থাকা বরফের কারণে। জানালার কাছে গিয়ে আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখতে চাইলাম কী করছে। বরফ জমে থাকায় ভেতরটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। হাতের গ্লাভস দিয়েই বরফ সরিয়ে দেখলাম যে পড়ার টেবিলের ওপর মুখথুবড়ে পড়ে আছে ও।’

‘তারপর কী করলেন?’

‘কী হয়েছে বুঝতে না পেরে, তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। স্টাডি রুমে শুধু টেবিল ল্যাম্পই জ্বলছিল। আমি ঘরের অন্য বাতি জ্বালালাম। দেখলাম, পিঠে ছুরি মারা হয়েছে। ছুরিটা নেই। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। তারপরই থানায় আপনাদের ফোন করলাম।’

‘ভালো করেছেন,’ বললেন পুলিশ কর্মকর্তা। ‘তবে আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। আপনাকে একটু বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।’

‘কেন? আমি খুন করলে কি আপনাদের খবর দিতাম?’ চিকিৎসক উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘আমরা কিন্তু একবারও বলিনি যে আপনি খুন করেছেন বা খুনের সঙ্গে জড়িত,’ পুলিশ কর্মকর্তা শান্তভাবে বললেন।

‘তাহলে সন্দেহ কেন? কেন জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে?’

‘কারণ, আপনি মিথ্যা কথা বলেছেন।’

‘রহস্যটা এখানেই যে পুলিশ অফিসার কীভাবে বুঝলেন, চিকিৎসক মিথ্যা বলেছেন,’ মায়শা গল্প শেষ করে বলল।

‘হেহ,’ বল্টু মামা একট তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন। ‘বাংলাদেশে বসে বিলেতের গল্প বললি। আর আমি তো এখানে কোনো রহস্যই পাচ্ছি না। পুলিশের সন্দেহ হয়েছে, ব্যস। অমনি বলে দিল যে চিকিৎসক মিথ্যা বলেছেন।’

‘আমার মনে হয়, আমি রহস্যটা ধরতে পেরেছি,’ তাহজিব বলল।

‘তা তো তুই পারবি,’ দোলটু মামা বললেন। ‘যেহেতু তোর বড় বোন বলেছে রহস্য, তাই তুইও বলছিস। নিজে পড়িস ক্লাস সেভেনে। তাই ইউনিভার্সিটিতে পড়া বড় বোনকে মনে করিস, সর্বজ্ঞানী।’

‘মোটেও তা নয়,’ তাহজিব প্রতিবাদ করল।

‘তাহলে বল দেখি, রহস্যটা কী?’

‘চিকিৎসক প্রথমেই বলেছেন যে রাস্তার ওপর থেকে স্টাডি রুমে আলো জ্বলতে দেখেছেন,’ তাহজিব বলতে লাগল। ‘তারপর আবার বলেছেন যে কাচের জানালার ওপর বরফের আস্তর থাকায় ভেতরটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। তার মানে কাছে এসেও যেখানে জানালার ভেতরটা ভালোভাবে দেখা যায় না, সেখানে রাস্তা থেকে ঘরের ভেতর বাতি জ্বলতে দেখলেন কীভাবে?’

‘ভেরি গুড,’ মায়শা বলল।

‘আরও আছে,’ তাহজিব হাত তুলে বলল। ‘চিকিসক পুলিশের কাছে বলেছেন যে স্টাডি রুমে শুধু টেবিল ল্যাম্পই জ্বলছিল। তার মানে বরফের আস্তর পড়া জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আলো যে জ্বলছে, সেটা বোঝা সম্ভব নয়।’

‘একদম পাক্কা গোয়েন্দার মতো ধরে ফেলেছিস,’ মায়শা বলল।

দোলটু মামা এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিলেন। এবার নিচু স্বরে বললেন, ‘এত কিছু চিন্তা করতে পারিনি। নাহ্‌। রহস্যভেদ কাজটা খুব সহজ নয়।’

অলংকরণ: মামুন হোসাইন