যে গল্পের শেষ নেই - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

যে গল্পের শেষ নেই

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

প্রথম প্রকাশ: ১৯৫১ সাল

যদি প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্প কোনটি? অনেকেই হাত তুলে হয়তো একবাক্যে আরব্য রজনীর সেই সহস্র এক রজনীর গল্পের কথা বলবে। আর বিদগ্ধ পড়ুয়াদের কেউ কেউ হয়তো রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিসের কথাও বলে বসতে পারে। কিন্তু হিসাব বলছে, কারও উত্তরই সঠিক নয়। আসলে বিশ্বের সবচেয়ে গল্পের জন্মস্থান আরবেও নয়, রাশিয়াতেও নয়। বরং এর জন্ম আমাদের এই বাংলাদেশেই। আরও ভালো করে বললে, আমাদের গ্রাম-বাংলায় পানখেকো গল্পবুড়োদের মুখে মুখে জন্ম হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্পটির।

ওই যে গল্পবুড়োর কাছে ওই আষাঢ়ে গল্পটি শোনোনি, বিশাল একঝাঁক পাখি প্রতিদিনই মাঠে নেমে বারবার খেয়ে যেত ধান। তাতে কৃষকদের সাড়ে সর্বনাশ হতে আর বাকি ছিল না। হতচ্ছাড়া পাখিদের শায়েস্তা করতে একবার বুদ্ধি করে বিশাল এক জাল ফেলা হলো, মাঠে নেমে আসা পাখির ঝাঁকের ওপর। তাতে আটকা পড়ল পাখির দল। কিন্তু জালে একটি ফুটো ছিল সেটি কেউই খেয়াল করেনি। তাই এক এক করে পাজি পাখিগুলো বেরিয়ে যেতে লাগল ফুড়ুত, ফড়ুত করে। জালের ভেতর অগণিত পাখি থাকায় পাখির ফুড়ুত আর শেষ হয় না। একই সঙ্গে গল্পও চলতে থাকে অনন্তকাল ধরে।

অবশ্য প্রায় একই রকম এক গল্প চালু আছে আফ্রিকার রূপকথায়। সেটিও নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্প বলে দাবি আফ্রিকানদের। অর্থাৎ যে গল্পের কোনো শেষ নেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? গল্পবুড়োদের এ ফাঁকিবাজি আর চাপাবাজির ভিড়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় শুনিয়েছেন আরেক গল্প। সে গল্পেরও কোনো শেষ নেই। চলমান, মানে টু বি কন্টিনিউ। সে গল্প হচ্ছে মানুষের গল্প। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত আদিম মানুষের উত্থানের গল্প। মানুষের উঠে দাঁড়ানোর গল্প। সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠার গল্প। আরব্য রজনীর গল্পেরও একটা শেষ আছে। এক হাজার এক রাতের পর শেষ হয়েছিল সে গল্প। কিন্তু মানুষের গল্পের আসলে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যত দিন পৃথিবীতে মানুষ আছে, তত দিনই চলতে থাকবে এ গল্প।

আদিম সময় থেকে মানুষ আর তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব রাজনীতি আর বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর মোটা মোটা বই লেখা হয়েছে। রয়েছে অতি মূল্যবান রেফারেন্স বই কিংবা প্রমাণ সাইজের এনসাইক্লোপিডিয়া। কিন্তু এ বইটিতে সমপূর্ণ ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে শূন্য থেকে শুরু করে মানুষের উদ্ভব আর আজকের সমাজব্যবস্থা পর্যন্ত সব বৈশিষ্ট্যকে। ঝরঝরে ভাষায় একেবারে গল্পের মতো করে শুধুই মানুষের কথা বইটির প্রতি পাতায় পাতায় তুলে ধরা হয়েছে। সহজ আর সাবলীল ভাষায় প্রকাশিত সমাজ বিকাশের লিখিত দলিল। বহু বছরের আগের কথা হলেও এগুলো আজও সত্য।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার দিনের জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির ছিল আকাশ-পাতাল তফাত। তাই একসময় ভীষণ জনপ্রিয় এ বইটিতে সময়োপযোগী তথ্য বা বিজ্ঞান যোগ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তাই দীর্ঘ ৪০ বছর পর, মানে ১৯৯১ সালে বইটি নতুন তথ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে ঢেলে সাজিয়েছিলেন লেখক। তবে সেটিও প্রায় ২৪ বছর আগের কথা। সে সময়ের তুলনায় বিজ্ঞান এগিয়েছে আরও অনেকটা পথ। তাই এ সময়ের জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে বইটির খুব সামান্য হলেও কিছু অসংগতি রয়েছে, যা পড়ে পাঠক হোঁচট খেতেই পারে। যেমন: মৌলিক পদার্থের সংখ্যা এ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে ৯২টি। কারণ, নব্বইয়ের দশকের আগে ও কটিই জানা ছিল মানুষের। এ রকম আরও ছোটখাটো কিছু তথ্যগত ত্রুটি আছে বইটিতে।

এসব ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত না হয়ে উইকিপিডিয়া বা অন্য কোনো জ্ঞানকোষের সঙ্গে মিলিয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এটুকু বাদ দিলে জোরের সঙ্গেই বলা হয়, দেবীপ্রসাদ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’ আবেদন শেষ হয়নি এখনো। কারণ, বাংলা ভাষায় এ রকম সহজপাঠ্য বই খুব বেশি নেই বললেই চলে। তাই বইটি সবার জন্যই অবশ্যপাঠ্য। জনপ্রিয় বইটি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবে আশা করি।