বাংলার আদি মানুষের খোঁজে

ধরি, আমরা একটি ক্লাসরুমে বসেছি। বিশ-পঁচিশজন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। ভালো করে তাকাই সবার দিকে। দেখতে প্রত্যেকেই যেন একটু আলাদা আলাদা। কেউ একটু বেশি লম্বা, কেউ মাঝারি, কেউবা সামান্য বেঁটে। কারও গায়ের রং ফরসা, কেউ শ্যামবর্ণ, কেউ বা কালো। কারও নাক খাড়া, কারও অতটা নয়। মাথার চুল কারও সোজা, কারও অল্প বা বেশি কোঁকড়ানো।

এখন যদি আফ্রিকার কোনো স্কুলে যাই এমন বিচিত্র রূপ দেখব না। লম্বায় ওরা সবাই উনিশ-বিশ। গড়ন লম্বাটে আর বেশ শক্ত-সামর্থ্য। গায়ের রং কালো, চুল বেশ কোঁকড়ানো। নাক-ঠোঁট মোটা। এদের আলাদা করেই চেনা যায়। আফ্রিকা থেকে এবার যেতে পারি চীন, জাপান বা কোরিয়ায়। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর গড়ন মাঝারি। হলদেটে গায়ের রং। গোলগাল মুখ। ছোট ছোট চোখ। মাথার চুল সোজা। আলাদা নয় বলে এদেরও এক দৃষ্টিতে চেনা যায়। আবার যদি ইংল্যান্ডের স্কুলে যাই, সব ছাত্রছাত্রীই ইংরেজ। বেশির ভাগের গায়ের রং ফরসা। আকারে লম্বা বা মাঝারি-লম্বা। খাড়া নাক। পাতলা ঠোঁট। কালো, লালচে বা সোনালি চুল। তেমন কোঁকড়া নয়। বেশির ভাগই সোজা। এদেরও চিনতে অসুবিধা হয় না। যাদের চট করে চেনা যায় তারা একটি নির্দিষ্ট রক্তধারার মানুষ। যেমন আফ্রিকার মানুষদের বলা হয় ‘নিগ্রোয়েড’ রক্তধারার। চীন, জাপান, কোরিয়ানরা ‘মঙ্গোলয়েড’ রক্তধারার। আর ‘ককেশীয়’ রক্তধারার হচ্ছে ইংল্যান্ড। এককথায় ইউরোপের মানুষ।

তাহলেই এ বাংলার মানুষ আমরা কোন পরিবারে পড়লাম? এই যে গায়ের রঙে, আকারে, চুলে আমাদের এত ভিন্নতা তাতে করে কোনো পরিবারের সঙ্গে মিলবে না। এ কারণে আমাদের বলা হয় সংকর জাতের মানুষ। কারণ, যুগ যুগ ধরে আমাদের মধ্যে নানা রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, এই বাংলার আদি মানুষ কে বা কারা? কীভাবেই বা যুগে যুগে এত জাতির রক্ত মিশেছে আমাদের পূর্বপুরুষের গায়ে? এর উত্তর জানতে পারাটা খুব সহজ নয়। কারণ, সুদূর প্রাচীনকালের কথা জানার মতো বইপত্র আমাদের কাছে নেই। লেখাও হয়নি।

অবশেষে একটি সুযোগ এসে যায়। আর্যজাতি ভারতে আসার অনেক পরে তাদের ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়। এই গ্রন্থকে বলে বেদ। বেদের প্রথম বইটিকে বলে ঋগ্‌বেদ। এখানেই একটি সূত্র পাওয়া যায়। যে সূত্র ধরে খোঁজ পাওয়া যায় বাংলার আদি মানুষের। সে কাহিনি ভারি মজার।

সাদা আর কালো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা
সাদা আর কালো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা

এই মজার কথা বলার আগে একটু আর্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার। আর্যদের আদিবাস ছিল উত্তর ইরানে। একেবারে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। প্রথমে ওরা কৃষিজীবী মানুষ ছিল। তখন তো আর আধুনিক চাষবাস ছিল না। তাই একটি বড় সংকট ছিল কৃষিজীবী মানুষের। জনসংখ্যা বাড়ত। তাই খাদ্যের চাহিদাও বাড়ত। কিন্তু কমে যেত কৃষিজমি। তাই টিকে থাকার জন্য নতুন জমির সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হতো। এমনিতে কেউ তো আর জমি ছেড়ে দেবে না। তাই জোর করে দখল করতে হতো। এভাবে আর্যরা যুদ্ধবাজ জাতি হয়ে যায়। এদের একটি অংশ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপে চলে যায়। আর অন্য অংশ প্রথমে দক্ষিণে মূল ইরানে চলে আসে। পরে উর্বর ভূমির সন্ধানে ২০০০ খ্িরষ্টপূর্বাব্দের দিকে উত্তর ভারতে আসে।

নিজেদের লেখা বেদ গ্রন্েথ তারা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছে। অন্যের দেশ দখল করেছে—এ নিয়ে পরে যদি কথা ওঠে, তাই নিজেদের বাঁচানোর জন্য গল্প ফেঁদেছে। এমনিতে আর্যরা নিজেদের খুব উঁচু জাতের মনে করত। তারা দেখতে ছিল সুন্দর। আগুনের পূজা করত তারা। সে যুগে অগ্নি উপাসকদের সেরা জাতের মনে করা হতো। এই নাক উঁচু আর্যরা লিখেছে, ভারত অপবিত্র দেশ। এখানে বর্বর মানুষেরা বাস করে। আর্যরা অমন দেশে থাকতে পারে না। তবে তাদের একটি সুবিধা ছিল। বিদেঘ নামে একজন মুনি বা পুরোহিত ছিলেন। তাঁর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। বিদেঘের মুখ দিয়ে আগুন বের হতো। তিনি হেঁটে যেতেন আর মুখের আগুনে চারপাশ পুড়িয়ে খাঁটি করা হতো। আর সেই পবিত্র মাটিতে বসত করেছিল আর্যরা। আর্যরা জেনেছিল ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উর্বর মাটি বাংলার। তাই উত্তর ভারত থেকে দ্রুত বাংলায় যাওয়ার কথা। কিন্তু বাংলায় এসেছে তারা এরও প্রায় এক হাজার বছর পরে। যখন ভারতের মৌর্য রাজবংশের সম্রাট মহামতি অশোক উত্তর বাংলা দখল করেছিলেন সেই সুযোগ নিয়ে। এ নিয়েও গল্প তৈরি করেছে। বলেছে বাংলার মানুষ অতিশয় বর্বর। খুব অপবিত্র মাটি এটি। এখানকার মানুষেরা পাখির মতো কিচিরমিচির করে কথা বলে। এ সময় হয়তো আর্যরা ভুলেই গিয়েছিল তাদের ক্ষমতাধর পুরোহিত বিদেঘের কথা। প্রশ্ন থেকে যায়, এতই যদি অপবিত্র হয়, তাহলে সুযোগ বুঝে মৌর্য যুগে বাংলায় প্রবেশ করল কেন!

ফরসা, কালো, লম্বা, মোটা নয়, সবাই মিলে জীবন উপভোগ করাটাই আনন্দের
ফরসা, কালো, লম্বা, মোটা নয়, সবাই মিলে জীবন উপভোগ করাটাই আনন্দের

এখান থেকেই আসল রহস্য বের করতে পেরেছেন ইতিহাসবিদ আর নৃতত্ত্ববিদেরা। আর্য আগমনের অনেক আগে থেকেই বাংলায় আদি মানুষের অস্তিত্ব ছিল। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় এদের বলা হয় অস্ট্রিক বা অস্ট্রলয়েড গোত্রের। সহজ ভাষায় বললে বলা যায় কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি গোত্রের মানুষ। আমাদের বাংলাদেশে এখনো সাঁওতালেরা রয়েছে। ভারতে আসার পর আর্যরা ঠিকই বাংলায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলার এই লড়াকু মানুষেরা প্রতিরোধ তৈরি করেছে। আর এই অহংকারী আর্যরা বারবার পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে। নিজেদের বইতে অমন পরাজয়ের কথা তো আর লেখা যায় না! তাই অমন কাহিনি তৈরি করেছিল।

অবশ্য মানতেই হবে এমন কাহিনি লিখেছে বলেই আমরা বাংলার আদি মানুষকে খোঁজার একটি পথ পেয়ে যাই। এই অস্ট্রিক গোত্রের মানুষের মধ্য দিয়েই বাংলার আদি মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছে। এরপর হাজার বছর ধরে নানা জাতির মিলনমেলা ঘটেছে বাংলায়। বাংলা দখল করতে এসেছে অনেক বিদেশি শক্তি। বিভিন্ন দেশ থেকে কেউ এসেছে বাণিজ্য করতে, কেউ ধর্ম প্রচার করতে, কেউ চাকরি করতে। স্থানীয় অনেক মানুষের সঙ্গে এদের বিয়েশাদির সম্পর্ক হয়েছে। এভাবে নানা রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। আর এই দীর্ঘ মিশ্রণের মধ্য দিয়েই সংকর জাতির গর্বিত বাঙালি নিজের পরিচয় স্পষ্ট করেছে।

ছবি: এহসান-উদ-দৌলা