টাইম মেশিনে ভাষা ভ্রমণ

‘কথা বলিস না, উঠে পড়!’ ফিসফিস করে বলল সজলদা। তারপর উঠে বসল নিজের তৈরি টাইম মেশিনে।

শৌনক জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল, সত্যিই কি স্কুলের ল্যাবে বানানো এই কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রটিতে চড়ে বসলে অতীত-ভবিষ্যত্ দুদিকেই যাওয়া যাবে? আরও একটি প্রশ্ন ছিল, যাওয়া নাহয় গেল, আবার ফিরে আসা যাবে তো?

পাত্তাই দিল না সজলদা। তার চোখরাঙানিতে একটু চুপসে গিয়ে শৌনকও বসে পড়ল মখমল কাপড়ে ঢাকা আসনটায়। তারপর হেলমেটের মতো কী একটা মাথায় দিতেই যন্ত্রটার নানা যন্ত্রপাতি ধরে সজলদার টানাটানির শব্দ শুনতে পেল। সজলদার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এই খ্যাপাটে বিজ্ঞানী আজ একটা কিছু করেই ছাড়বে।

শুভ্র আর ফয়সাল দাঁড়িয়ে ছিল টাইম মেশিনের পাশেই। একটু আগেই শুভ্র বলছিল, ‘শৌনক, তোর ভাগ্য ভালো, সজলদা সফরসঙ্গী হিসেবে তোকেই বেছে নিল!’

মিনমিন করে শৌনক বলেছিল, ‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু কাল তো বাংলা সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা! সময়মতো ফিরে আসতে না পারলে...’

শুভ্রও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘বিদায় বন্ধু। আর যদি দেখা না হয়, তাহলে তোর নামে একটা শহীদ মিনার বানাব!’

‘শহীদ মিনার!’ চমকে উঠেছিল শৌনক।

‘হ্যাঁ, শহীদ মিনার। বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রাণ দিয়েছিস তুই, বন্ধু!’ কেঁপে উঠেছিল শুভ্রর কণ্ঠ।

শরীরে শীতল একটা রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল শৌনকের। এখন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত্ শৌনক দেখল, শুভ্র কোথাও নেই। সজলদার দিকে তাকিয়ে দেখল, নিমগ্ন মনে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করে চলেছে। একসময় খুট করে একটা শব্দ হলো, থেমে গেল ইঞ্জিন। আশপাশে তাকিয়ে অবাক হলো শৌনক। ঢাকা মহানগরের ইট-কাঠ-কংক্রিটের জগত্ থেকে বেরিয়ে এ কোথায় এল ওরা!

নির্জন চারদিক। একটি খরস্রোতা নদীর পাড়ে ওরা দুজন। বহুদূরে একটা পালতোলা নৌকা। নদীর তীরে কেউ নেই। ধু ধু চারিধার। এ কোথায় এলাম রে বাবা! ভাবে শৌনক।

সজলদা শৌনকের কানে কানে বলল, ‘১০০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি কোথাও এসেছি।’

শৌনক তো তো করে বলে, ‘বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। কাল বাংলা সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা!’

‘চুপ!’ সজলদার ধমকে চুপ মেরে যায় শৌনক। ঠিক তখনই কী থেকে কী হলো, নদীতে দেখা গেল বেশ কয়েকটি নৌকা, মাস্তুলসহ জাহাজ! এদিকেই আসছে। আর ওই বহু দূরে পালকিতে চড়েও আসছে মানুষ। ব্যাপার কী?

একটু পরেই ওদের টাইম মেশিনের পাশে এসে পড়ে সবাই। উত্সুক দৃষ্টিতে যন্ত্রটা দেখে। তারপর নিজেদের ভাষায় কী সব বলাবলি করে। কেউ কারও ভাষা বোঝে না! কিন্তু কোনো কোনো শব্দ পরিচিতও লাগে!

অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ভাষার বিস্তার হয়েছে নানাভাবে
অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ভাষার বিস্তার হয়েছে নানাভাবে

সজলদা এবার ভয় পায়। বলে, ‘কি রে, কিছু বুঝতে পারছিস?’

শৌনক বলে, ‘সবার চেহারাই তো আমাদের মতো। বাঙালি বলেই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কথা তো বুঝতে পারছি না!’

কেউ কারও কথা ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। শরীরের নানা ভঙ্গিমায় মানুষগুলো কথা বলেই চলেছে। ঠিক এ সময় একজন তার হাত দেখিয়ে বলল, হস্ত!

পাশে দাঁড়ানো একজন নিজের হাত দেখিয়ে বলল, ‘হত্থ!’

শৌনক মুহূর্তের মধ্যে বুঝে ফেলে ঘটনাটা। ও নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘হাত’!

ওরা সবাই বিড়বিড় করতে থাকে, হস্ত, হত্থ, হাত...

এবার সবার দৃষ্টি পড়ে সুন্দরী এক নারীর দিকে। তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। তার পাশে দাঁড়ানো পুরুষটি একটু উসখুস করে। তারপর মেয়েটিকে দেখিয়ে বলে, ‘বধূ!’

সবাই সায় দেয় তার কথায়। একজন বলে ওঠে, ‘বহু।’

শৌনক বলে, ‘বউ।’

প্রত্যেকেই বুঝতে পারে, কী নিয়ে কথা হচ্ছে।

শৌনক বুঝে নিয়েছে, কোনো এক অবিশ্বাস্য ঘটনার কারণে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে বসবাসকারী বাঙালিরা এখানে এসে জড়ো হয়েছে। এরা বিভিন্ন সময়ের বাংলায়ই কথা বলছে।

আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল শৌনকের। কিন্তু ওর হাত ধরে টান দিল সজলদা। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘অ্যাই, তোর না কাল পরীক্ষা? শিগগির ওঠ টাইম মেশিনে!’

শৌনককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তড়িঘড়ি ওরা টাইম মেশিনের পেটে। আবার স্টার্ট দিল সজলদা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে হাজির হলো স্কুলের ল্যাবে। শুভ্র আর ফয়সাল তখনো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ওদের দেখে তো ওরা অবাক!

‘আরে! তোরা কি কোথাও যেতে পারলি না?’ শুভ্র জিজ্ঞেস করে শৌনককে।

টাইম মেশিন থেকে নামতে নামতে শৌনক বলে, ‘যাইনি মানে? আমরা এক হাজার বছর আগে চলে গিয়েছিলাম!’

হতভম্ব শুভ্রর মুখে কথা সরে না।

২.

‘তোর এত জানার দরকার কী?’ চশমার ফাঁক দিয়ে অদ্বিতীয়া ম্যাডামের কড়া চাউনি দেখা যাচ্ছে।

‘এত কোথায়? আমি তো শুধু বাংলা ভাষা কোথা থেকে এল জানতে চাইছি।’

‘বাহ! এত দিন তো ওই অঙ্ক আর ইংরেজির জন্য জানপ্রাণ দিয়ে দিলি। এখন বাংলায় ফেরার ইচ্ছে হলো কেন?’

‘বাহ! আমার জানতে হবে না, হস্ত কী করে হাত হয়ে গেল?’

অদ্বিতীয়া ম্যাডাম এতক্ষণে একটু সদয় হন। বলেন, ‘ঠিক আছে, বলছি। কিন্তু এখন না। ক্লাসের পর।’

শৌনকের মন ভরে যায়। অদ্বিতীয়া ম্যাডামকে খুব পছন্দ করে ও। ক্লাসের পর ম্যাডাম ওকে সময় দেবেন—ভাবাই যায় না!

ঢং ঢং ঘণ্টা পড়তেই চারদিকে চিত্কার শুরু হয়ে যায়। হুড়মুড় করে ছেলেরা বেরিয়ে পড়ে। শৌনক শুধু বসে থাকে। অদ্বিতীয়া ম্যাডাম এই এলেন বলে! সত্যিই একটু পর অদ্বিতীয়া ম্যাডাম আসেন। তারপর বলেন, ‘তুই তো জানিস, ভাষা জীবন্ত জিনিস। আজ এক রকম তো কাল তা হয়ে যেতে পারে অন্য রকম।’

‘মানে?’

‘মানে আবার কী? তুই নিজেই তো বললি, হস্ত কী করে হাত হলো, তা জানতে চাস! ধর, সাধু ভাষায় কেউ বলল, হস্ত ধৌত করিতে চাই। তুই কি সেভাবে বলবি? তুই তো বলবি, হাত ধুতে চাই।’

‘ঠিক!’

চর্যাপদের একটি পাতা
চর্যাপদের একটি পাতা

‘১৯০৭ সালের আগে কেউ জানত না বাংলা ভাষার ইতিহাস। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন তখনো পাওয়া যায়নি। সে বছর মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কী একটা কাজে নেপালে গিয়েছিলেন। নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থশালায় হঠাত্ তিনি আবিষ্কার করেন চারটি পুঁথি। তার একটি হলো চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়। শাস্ত্রী মশায় নিজেই এই নামকরণ করেন। এই পুঁথিটাই রচিত হয়েছিল আদি বাংলা ভাষায়। এ নিয়ে ১৯১৬ সালে একটি বই বের করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।’

‘এটা যে বাংলা, তা জানা গেল কী করে? ভাষাটা কেমন ছিল?’ শৌনক জানতে চায়।

‘ছেচল্লিশটি পুরো আর একটি খণ্ডিত পদ ছিল ওই পুঁথিতে। আমরা এখন চর্যাপদ নামেই তা চিনি। উদাহরণ চাস? তবে শোন’—বলে একটা দম নেন অদ্বিতীয়া ম্যাডাম। তারপর আবৃত্তি করেন,

‘আলিএ কালিএ বাট রুন্ধেলা

তা দেখি কাহ্ন বিমন হইলা’

‘মানে?’

‘একরকম অনুবাদ হলো, আলিতে কালিতে পথ অবরুদ্ধ করল, তা দেখে কানুপদ বিমন হইল।’

‘হুম। আর কিছু বলা যাবে?’

‘যাবে না কেন? তুই কি ভেবেছিস আমি শুধু এটাই মুখস্থ করে এসেছি? শোন, “এতকাল হাঁউ অচ্ছিলেঁসু মোহে” মানে হলো, এতকাল আমি ছিলাম মোহে। লিখেছেন ভাদেপাদ।’

শৌনক একটু দমে যায়। এই বাংলা ভাষার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হুম, ‘এতকাল’ আর ‘মোহে’ শব্দ দুটো তবু বাংলার মতো লাগছে। সে না হয় হলো। এখন জানা দরকার, কোত্থেকে এল এই বাংলা ভাষা। ভাষা তো মানুষ বা প্রাণী নয় যে মায়ের পেট থেকে জন্মাবে!

শৌনকের মনের কথা যেন পড়তে পারেন অদ্বিতীয়া ম্যাডাম। একটু হেসে বলেন, ‘কোত্থেকে এল বাংলা ভাষা, সেটাই জানতে চাইছিস তো? তবে শোন। আমি কিন্তু পণ্ডিতদের মতো করে বোঝাতে পারব না। বহু বহু বছর আগে সংস্কৃত ভাষাটাই ছিল প্রবল প্রতাপশালী। শিক্ষিত মানুষের ভাষা। কিন্তু তাহলে সাধারণ মানুষ কোন ভাষায় কথা বলত? কীভাবে তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত? আসলে সাধারণ মানুষের প্রাণের তাগিদেই জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষার। তবে, সে-ও একটা বিশাল ভ্রমণের পর। এর আগেও কিছু ব্যাপার আছে, যা তোকে বুঝতে হবে।’

‘বুঝতে চাই।’

‘একটু যদি কঠিন লাগে, তাহলে প্রশ্ন করিস। আমার জানা থাকলে উত্তর দেব। এশিয়া আর ইউরোপের বেশ কিছু ভাষার ধ্বনিতে শব্দে গভীর মিল দেখে একদল বিজ্ঞানী এ বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করে দিলেন। দেখা গেল, এই ভাষাগুলো যেসব অঞ্চলে ছিল, তা দিয়ে একটা মানচিত্র বানালে সবচেয়ে পশ্চিমে থাকে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত উপমহাদেশ। ভাষাবিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এলেন যে এই মানচিত্রের সবগুলো ভাষাই একটা ভাষাবংশের সদস্য। বুঝতে পারছিস?’

‘হুঁ।’

‘এই ভাষাবংশটির নাম দেওয়া হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী। আর্যভাষা নামেও একে ডাকা হয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার একটি শাখা হচ্ছে ভারতীয় আর্যভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও এক হাজার বছর আগে। এই ভাষায় বেদ লেখা হয়। তাই এটাকে বৈদিক ভাষাও বলা হয়। বেদের শ্লোকগুলো ছিল পবিত্র। তাই বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেদের শ্লোকগুলো মুখস্থ করে রাখত। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেল। মানুষ যে মুখের ভাষা ব্যবহার করত, তা তো তত দিনে বদলে গেছে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে একসময় বেদের ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে উঠল। তখন ব্যাকরণবিদেরা নানা নিয়মকানুন বানিয়ে একটি পরিশীলিত শুদ্ধ মান ভাষা তৈরি করলেন। এটাই সংস্কৃত। বুঝেছিস?’

‘বুঝতে পারছি।’

‘কিন্তু এই সংস্কৃত ছিল লেখা আর পড়ার জন্য। এটা বলার ভাষা ছিল না। তার মানে, ভারত উপমহাদেশের মানুষ তখন কোনো না কোনো ভাষায় কথা বলত, তাই না? ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাই বিভিন্ন ধরনের বলার ভাষা ছিল। এগুলোকে বলা হয় প্রাকৃত।’

এবার শৌনক একটা প্রশ্ন না করে পারে না। ‘কিন্তু এত সব ঘটনা কখন ঘটে চলেছিল? ক’বছর আগে?’

অদ্বিতীয়া ম্যাডাম হেসে বললেন, ‘আরও আগেই তোর কাছ থেকে এই প্রশ্নটা আসবে বলে ভেবেছিলাম। শোন তবে! যিশুখ্রিষ্টের জন্মের আগেই ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তর পাওয়া যাচ্ছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সাল অবধি...’

শৌনক বলে, ‘বেদের ভাষা?’

‘একদম ঠিক। বৈদিক ভাষা। এরপর তা দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকলে সেটার নিয়মকানুন বানিয়ে তৈরি করা হয় সংস্কৃত ভাষা। এটাও ওই যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৮০০ থেকে ৪০০ বছর আগের সময়টা। এর পরের সময় হলো প্রাকৃতের। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ভাষাগুলো ছিল প্রচলিত। এটাকে আমরা মধ্যযুগীয় আর্যভাষা বলতে পারি। এই প্রাকৃতের শেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ। আর এই অপভ্রংশ থেকেই ভারত উপমহাদেশের আধুনিক আর্যভাষাগুলোর জন্ম হয়েছে।’

শৌনক একটু ধাঁধায় পড়ে, ‘কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম মাগধী ভাষা থেকে বাংলার জন্ম হয়েছে?’

অদ্বিতীয়া ম্যাডাম হেসে বললেন, ‘ওই মাগধীটাই তো অপভ্রংশ। মাগধী অপভ্রংশ থেকে জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষার। মাগধী অপভ্রংশ ছড়িয়েছিল তিন দিকে। পূর্ব, মধ্য আর পশ্চিম মাগধী অপভ্রংশ। বাংলা, অহমিয়া আর উড়িয়া ভাষা পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে এসেছে। অন্য দুই দিকে ছিল মৈথিলি, ভোজপুরিয়ার মতো ভাষা। এবার বুঝেছিস?’

ওপর-নিচ মাথা নাড়ল শৌনক। বলল, ‘যাক, এতক্ষণে বাংলা ভাষায় এসে পৌঁছুলাম।’

পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

অদ্বিতীয়া ম্যাডামের চোখের কোণে হাসি। বললেন, ‘বাংলায় এসে গেলি এত সহজে? তাহলে বাংলার ইতিহাসটা তোর জানার দরকার নেই?’

‘বাংলার আবার ইতিহাস কী? আমি তো জেনেই গেলাম, পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম।’

‘বাহ! খুব বললেন উনি!’ কান লাল হয়ে যায় অদ্বিতীয়া ম্যাডামের। ‘একটু আগেই বললি, হস্ত, হত্থ, হাতের ধাঁধার সমাধান চাস। আর এখন এটুকুতেই তোর সাধ মিটে গেল?’

ঢোঁক গিলে শৌনক বলল, ‘আরও আছে?’

‘বাহ! থাকবে না? বাংলাও আদিতে অন্য রকম ছিল না? সে কি আধুনিক হওয়ার আগে একটা মধ্যযুগ কাটিয়ে আসেনি?’

‘তাই নাকি? শুনতে চাই।’

‘যাক! শুনতে চান তিনি! কোন সময় আদি বাংলা ভাষা ছিল? ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ হলো আদি বাংলা ভাষার সময়কাল। ওই যে চর্যাপদের কথা বললাম, তা ওই সময়ের রচনা। এরপর বিশাল সময়ের একটা মধ্যযুগ। প্রায় ৬০০ বছর ছিল এই যুগটা। ১২০০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল তা। মধ্যযুগে ব্রজবুলি খুব জনপ্রিয় ছিল। পঞ্চদশ শতকের কবি বিদ্যাপতি বাংলা ভাষায় একটি কবিতাও লেখেননি। লিখেছেন বানানো ব্রজবুলি ভাষায়। হিন্দি, বাংলা আর প্রাকৃত মিলে এক মধুর ভাষা ছিল ব্রজবুলি। বিদ্যাপতি লিখেছিলেন, “এ সখী, হামার দুখের নাহি ওর” মানে “সখী, আমার দুঃখের শেষ নেই”। কিংবা ধর, “হাথক দরপন মাথক ফুল, নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল” মানে হলো “হাতে আয়না, মাথায় ফুল, চোখে কাজল, মুখে পান”। এগুলোকে বলে বৈষ্ণব পদাবলি। বাংলা ভাষা ব্রজবুলিকে আপন করে নিয়েছে। বিদ্যাপতিকে করেছে বাঙালির কবি। দেখেছিস, চর্যাপদের চেয়ে অনেক বেশি সহজে বোঝা যায় এই কথাগুলো? তবে এর মধ্যে ১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত তা ছিল ক্রান্তিকালের বাংলা ভাষা। ১৮০১ থেকে শুরু হয় আধুনিক বাংলা ভাষা। তাই বলে ভাবিস না, সে সময়ের বাংলা ভাষা আর আজকের বাংলা ভাষা একই রকম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ২০০ বছরে বাংলা ভাষাও বদলেছে অনেকখানি। একটু খেয়াল করে পুরোনো বাংলা আর আধুনিক বাংলা পড়লে বদলটা তোর চোখেই ধরা পড়বে।’

৩.

শৌনক আবার ল্যাবে এল। সেখানে সজলদা এখনো বসে আছে। সজলদাকে বিজ্ঞানী বলে কেউ স্বীকার করে না। একসময় পদার্থবিজ্ঞানের ডেমনেস্ট্রেটর ছিল। তারপর মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে অনেকেই মনে করে। তাই তার চাকরি চলে গেছে। কিন্তু শিক্ষকেরা স্নেহের বশে তাকে ল্যাবরেটরিতে আসতে দেন। শৌনক কথা বলে দেখেছে, অনেক বিষয়ে অগাধ জ্ঞান আছে সজলদার। এই টাইম মেশিনটাও সে বানিয়েছে নিজের মতো করে।

শৌনককে দেখে সজলদা নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে, ‘কি রে? আবার তুই এখানে?’

ফিসফিস করে শৌনক বলল, ‘সজলদা, আরেকবার একটু চলো না বিদ্যাসাগরের আমলে। একটু দেখে আসি বাংলা ভাষাটা তখন কেমন ছিল?’

সজলদা হাসে। বলে, ‘টাইম মেশিনটা আর চলছে না। ওয়ান টাইম ইউজ! মেরামত করার চেষ্টা করব। তবে, তার আগে তুই একটু বইপত্র পড়ে ফেললেই তো পারিস! হুমায়ূন আজাদের কত নদী সরোবর, গোলাম মুরশিদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ইত্যাদি কত বই আছে! বিদ্যাসাগরের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে বই।’

কথাটা শৌনকের মনে ধরে। আজই মাকে বলতে হবে, ‘মা, চলো তো একটু বইয়ের দোকানে যাই।’

অলংকরণ: তুলি