সুন্দরবনে শংখচূড়ের কবলে

বাংলাদেশে পাওয়া যায় একটি অদ্ভুত প্রাণী হচ্ছে শঙ্খচূড় সাপ। পৃথিবীর বিষধর সাপের মধ্যে এরাই লম্বায় সবচেয়ে বড় হয়। এরা ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা হয়ে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃতিতে ছড়িয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশে বড় শঙ্খচূড় ১৬ ফুটের চেয়ে বেশি লম্বা হয় না। অথচ থাইল্যান্ডে ১৮ ফুট লম্বা শঙ্খচূড়ও পাওয়া গেছে।

একে বিশাল আকৃতি, তার ওপর মারাত্মক পরিমাণ বিষ ধারণ করে। তার ওপর মুখ হাঁ করে বন্ধ করে তেড়ে আসা, ফণা তুলে মাটি থেকে চার-পাঁচ ফুট উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া শঙ্খচূড়কে দিয়েছে অতিপ্রাকৃত গুণ। তাই শঙ্খচূড়ের একটি নাম নিয়ে কেউ বেশি খুশি থাকতে পারেননি।

এদের প্রচলিত ইংরেজি নাম কিং কোবরা, যেটা বাংলায় রাজগোক্ষুর। দেখতে এরা কিছুটা গোক্ষুরদের মতো। ফণাও তোলে। তবে সে ফণা গোক্ষুরের ফণার মতো সুগঠিত বিস্তৃত না। অনেকটা লম্বাটে ধরনের। সাপ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এরা গোক্ষুরের কাছাকাছি হলেও প্রকৃত গোক্ষুর এরা না।

এদের বৈজ্ঞানিক নাম অফিওফ্যাগাস হান্না। অর্থাৎ সাপখেকো। ইংরেজিতে এদের চমৎকার একটি নাম আছে—হ্যামাড্রাফড; অবশ্য অল্প লোকই এই নামে তাদের চেনে।

বাংলায় কিন্তু শঙ্খচূড়কে গোক্ষুর বলে ভুল করেননি নামকরণকারিরা। ভারতের ওডিশায় এই সাপকে অহিরাজ বা সাপের রাজা বলে ডাকা হয়। এই অহিরাজ থেকে এরা বাংলায় হয়েছে আইরাজ। আর আমাদের সুন্দরবনে এদের স্থানীয় নাম পাতরাজ।

সেই ১৯৭৪ সাল থেকে সুন্দরবনে ঘোরাঘুরি করেও ১৯৯৭ সালের আগে আমার চোখে শঙ্খচূড় পড়েনি। কেন পড়েনি সেটা পরে বুঝতে পেরেছি। সাপ এমনি এমনি চোখে পড়বে না। আপনাকে জানতে হবে কোথায়, কোন অবস্থায়, কোন আবহাওয়ায় আপনি সাপ খুঁজবেন! সেই সঙ্গে চোখও কিছুটা ট্রেনিংপ্রাপ্ত হতে হয়। জঙ্গলের ধারে কোনো লতাটা হঠাৎ লাউডগা হয়ে উঠবে, ছোট খালের ভেতর শুধু মাথা পানির সমান্তরালে রেখে স্রোতের সঙ্গে দুলছে যে কালোপানা শিকড়টি, সেটাই যে একটি বড় কেউটে, সেটা বুঝতে হবে। ১৯৯৭ সালে পাখিবিদ ইনাম-আল-হক, বন্ধু মঈন আহমেদসহ আমরা গিয়েছিলাম পশ্চিম সুন্দরবনের আংটিহারা বন্দরে। এখানেই আমার একজন বন্ধু আছেন—নাম তাঁর দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল। পশ্চিম সুন্দরবন সম্পর্কে এমন জানাশোনা মানুষ কম আছেন। তিনি ভ্রমরখালী এলাকা থেকে একটি শঙ্খচূড় ধরেছিলেন। মাস দুয়েক পুষেছিলেন। তাঁর ভাতিজা আমাদের ম্রিয়মাণ বিবর্ণ সাপটি দেখিয়েছিলেন, পরদিনই সাপটি মারা যায়।

২০০০ সালে সোয়াম্প টাইগার  ছবিটির শুটিং চলছে। ছবিতে আমার কাজ ছিল বাঘ আসতে পারে এমন কিছু জায়গা নির্বাচন করে চিত্রগ্রাহক মাইক হার্ডের জন্য মাচা করে দেওয়া।

সেদিন জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ, সকাল ১০টার মতো বাজছে। মাইক, বোটচালক আলী হোসেন, মজিবরসহ আমরা কচিখালীর ভারানীতে চলছি স্পিডবোটে। বেশ মিঠেকড়া রোদ উঠেছে। হঠাৎ পানির দিকে তাকিয়ে দেখি একটি কেউটে সাপ ছোট খালের ধার দিয়ে চলেছে। মাইককে সেটা দেখালাম। কিন্তু মাইকের বাঘ ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহ নেই। ক্যামেরা তুললাম ছবি নেওয়ার জন্য। জলের মধ্যে চলমান সাপের ছবি ফোকাস করতে সমস্যা হচ্ছিল। যখন সত্যিই ফোকাস করল, সাপ ততক্ষণে ডাঙায় উঠতে শুরু করেছে।

লেন্স জুম করতেই চমকে উঠলাম। আরে, এই তো সেই শঙ্খচূড়। মাইককে বললাম, এটা কেউটে না, ওই দেখো শঙ্খচূড়। এখন পুরো শরীরের জলপাই রঙের ওপর হলুদ বলয়গুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মাইকও অবাক হয়ে তাকাল—বলল, ইশ্, আগে বুঝতে পারিনি, তাহলে ছবি তুলতাম। আমি ভেবেছিলাম কেউটে, সে তো অনেক দেখা যায়।

সেবার ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। সকালে বেশ কুয়াশাও ছিল। আমরা কয়েকজন জাপানিসহ জনা পনেরো মানুষ খুলনার রূপসা নদীতে খেয়া পারাপারের গুদারা নৌকায় চেপে সুন্দরবনের তাম্বুলবুনিয়া বন অফিসের দক্ষিণ দিকের খালটি ধরে এগোচ্ছিলাম। খালটির নামও তাম্বুলবুনিয়া খাল। খালের নামেই অফিসের নাম।

আমাদের কাছে খবর ছিল খালের দক্ষিণ পাড়ের জঙ্গলে মাঝেমধ্যে একটি বাঘ রোদ পোহাতে আসে।

জঙ্গলটি একসময় হেতালের ঘন ঝোপের জঙ্গল ছিল। বনবিভাগ লেবার দিয়ে হেতাল নির্মূল করে সেখানে নতুন সুন্দরীর বাগান করছে। বর্তমানে তাই এলাকাটা ফাঁকা। খালধারের ঘন ঝোপঝাড় না থাকলে মাঠের মতো এলাকাটা চমৎকার দেখা যেত।

জোয়ারের পানি পাড়ের সমান্তরালে উঠে এসেছে। আমরা চলছিলাম একেবারে পাড়ঘেঁষে। যেতে হচ্ছিল জোয়ারের উল্টো দিকে।

সুন্দরবনের নদী-খালগুলোয় জোয়ারে স্রোতের গতি বেশ তীব্র। সাধারণ নৌকায় উজান বেয়ে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব না। তার ওপর আমাদের গুদারা নৌকা, এতজন বড় নদীর চড়নদার—তাদের নিয়ে স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবু যেতে হবে।

সুন্দরবনের নদী-খালগুলোয় যেদিকে জোয়ার বয়, খালগুলোর তীরের কাছে জলের সংঘর্ষে উল্টো স্রোত বয়। নৌকার মাঝিরা, যাদের স্রোতের বিপরীতে যেতে হবে, তারা এই উল্টো স্রোতকে কাজে লাগায়। একে বলা হয় মাগনা জোয়ার। এই মাগনা জোয়ারে তীরঘেঁষে এগিয়ে চলেছি। খালপাড়ের কিছু গাছ, হেতাল, গেউয়া, হরগেজা, বনঝাউ, গোলপাতা নদীর দিকে এলানো। আমরা চলেছি এগুলোর তল দিয়ে। ছোট-বড় ডালপালার চড়-চাপটি খেতে খেতে।

মিঠেকড়া রোদ উঠেছে। জাপানিদের প্রত্যেকের হাতে ক্যামেরা আছে। ছবি তুলছে, ডালপালার চাপড় খেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমি খুব খরদৃষ্টিতে মাঠটা দেখে নিচ্ছি। বাঘ মহাশয়ের কোনো টিকি দেখা যায় কি না।

হঠাৎ আমার চোখে পড়ল আমাদের সামনে খালপাড়ে একটি হেতাল ঝোপ পানির দিকে ঝুঁকে আছে। আমাদের ওই ঝোপের তলা দিয়ে যেতে হবে। যেভাবে এগোচ্ছি তাতে ওই ঝোপের তলায় যেতে আমাদের দেড় মিনিটের মতো সময় লাগবে। ঝোপটি যেভাবে পানির দিকে হেলে আছে, তাতে আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। কী হতে পারে? কেন ঝোপটি এতটা হেলে আছে?

কোনো বানর কি ওখানে বসে আছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি না? নাহ্‌, বানর যে সতর্ক জীব, আমাদের আগেই সে দেখতে পেত। নাহ্‌।

হঠাৎ দেখতে পেলাম। বাপ রে! কাউকে কিছু না বলে লাফিয়ে নৌকার সামনে চলে এসে বইঠা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকা বেশি পানির দিকে ঠেলে দিলাম। চিৎকার করে মাঝিকে বললাম, নৌকা বাইরে নিয়ে যাও। যত তাড়াতাড়ি পারো।

আমার অবস্থা দেখে জাপানিরাও ভড়কে গেছে। ইন্টারপ্রেটার বারবার জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে?

বললাম, সবই দেখাব, আগে নৌকা সরাই। দেখতে দেখতে আমরা প্রায় এলানো ঝোপের তলায় চলে এসেছিলাম। আশ্চর্য দক্ষতায় মাঝি নৌকা পাড় থেকে দূরে সরিয়ে নিল।

নিরাপদ হয়ে জাপানিদের বললাম, এবার আপনাদের ক্যামেরা ঠিক করুন, এখনই দেখতে পাবেন। মাঝিকে বললাম, ওই ঝোপের থেকে সাত-আট ফুট দূর দিয়ে বেয়ে যেতে। ঝোপটি কাছে এলে সবাই একসঙ্গে ও ও ও বলে অবাক কিছু ছবি তুলতে লাগল।

সম্ভবত রোদ পোহাতে বিশাল শঙ্খচূড়টি হেতালের ঝোপের ওপর বিড়ে পাকিয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছিল। ভারী ওজনদার সাপ। হেতালের নমনীয় পাতার ওপর শরীরের ভর দিয়ে ঝোপটি নুইয়ে দিয়েছে সর্পরাজ। আমার যদি দেখতে আর আধা মিনিট দেরি হতো, তাহলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত।

আমাদের ওই ঝোপের তলা দিয়ে যেতে হতো। তাতে আমরা যদি কিছু নাও করতাম, সাপটি চমকে গিয়ে আমাদের নৌকায় পড়ত।