ওরে ভোঁদড় ফিরে চা

ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা!’—ছোটবেলায় এই ছড়াটা পড়োনি, এমন কেউ কি আছ? কিন্তু এই অদ্ভুত প্রাণী ভোঁদড় আবার কী? যদি তোমরা দেখতে চাও তো জেলেপাড়াগুলোয় চলে যাও। জেলেরা ভোঁদড়কে ব্যবহার করে মাছ ধরেন। নড়াইল জেলার ধোন্দা-রতডাঙা ঘাটে বা ঘোড়াখালীর খালে গেলে জেলেদের বেশ কিছু নৌকায় তোমরা এ প্রাণীটাকে দেখতে পারো। বেজির মতো দেখতে হলেও এই প্রাণীটা সাঁতারে খুব পটু। নদীর স্রোতেও এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে। ডুব দিয়ে অনেক দূর যেতে পারে। জলের নিচ থেকে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে খায়। এ জন্য মাছরা ভোঁদড় দেখলে দৌড়ে পালায়। তাই নদীতে মাছদের তাড়িয়ে জালের কাছে আনতে জেলেরা ভোঁদড়দের কাজে লাগান। জেলেদের নৌকায় একটা খাঁচায় ভোঁদড়দের পোষা হয়। পোষমানা ভোঁদড়রাও জানে তার মনিব কী চায়? তাই ভোঁদড়রা মাছদের নিয়ে খেলা করে, দু-চারটা মুখের কাছে এলে গিলে ফেলে। মাছদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে এদের খুব ভালো লাগে।

ভোঁদড়দের গা থেকে বিশেষ একধরনের গন্ধ আসে, যা দিয়ে এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তুমি যদি মই বা মলন দিয়ে ফেলে রাখা খড়ের গন্ধ বোঝো, তাহলে ভোঁদড়ের গন্ধটাও বুঝবে। গন্ধটা অনেকটা তেমনই লাগবে। কাঁচা মাছ খায় বলে এদের গা থেকে একটা আঁশটে গন্ধও আসে। এরা দলেবলে থাকতে পছন্দ করে। ভোঁদড়দের দলকে বলে হোল্ট বা কোচ। পুরুষ ভোঁদড়দের তেজ বেশি, দাবড়ে মাছ শিকার করে। এ জন্য বোধ হয় পুরুষ ভোঁদড়দের বলে ‘ডগ’, স্ত্রী ভোঁদড়কে বলে ‘বিচ’। আর ভোঁদড়ের বাচ্চাকে বলে ‘পাপ’। ভোঁদড়ের মা, বাবা আর এদের বড় ভাইবোনেরা বাচ্চাদের দেখেশুনে রাখে। মা মাছ শিকার করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়। এ জন্য মা ভোঁদড়কে রোজ একটু বেশি মাছ ধরতে হয়। না হলে দিনে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা এরা নদী বা সাগরে কাটালেই সারা দিনের আহারের জোগাড় হয়ে যায়। সাধারণত এরা নদী বা জলাশয়ের কিনারায় বসবাস করে। খুব প্রয়োজন না হলে এরা জলে নামে না। কেবল খাদ্যের সন্ধানে এরা জলে সাঁতার দেয়, ডুব দেয় ও মাছ শিকার করে। ছোট মাছ তো এরা শিকার করেই, তা ছাড়া কাঁকড়া বা খোলসযুক্ত মাছেরও খোলস ছাড়িয়ে এরা খেতে পারে। মজার বিষয় হলো, তুমি-আমি কোনো খাবার খাওয়ার পর যেমন মুখ ধুই, ভোঁদড়রাও প্রতিবার খাওয়ার পর জল দিয়ে মুখ ধোয়। শুধু জলের নিচে সাঁতার কেটে এরা মাছ ধরে তা নয়, কখনো কখনো নদীর তলার মাটির ওপরে বিশ্রাম নেওয়া মাছদেরও এরা ধরে আনে। খাদ্যের সন্ধানে এরা জলের ৩৩০ ফুট গভীর পর্যন্ত ডুব দিতে পারে, নদীর ভোঁদড়রা ৬০ ফুট পর্যন্ত ডুব দিতে পারে। ভোঁদড়রা পানির নিচে আট মিনিট পর্যন্ত শ্বাস বন্ধ করে থাকতে পারে।

একসঙ্গে মিলেমিশে কাঁকড়া ভাগ করে খাচ্ছে দুই ভোঁদড়
একসঙ্গে মিলেমিশে কাঁকড়া ভাগ করে খাচ্ছে দুই ভোঁদড়

বাচ্চারা জন্মের পর এক মাস বয়স হলেই আলাদা হতে পারে। তবু তারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে। দুই মাস বয়স হলেই নিজেরা সাঁতার কেটে শিকার করে। তারপরও তারা একসঙ্গে থাকতে পছন্দ করে। সাধারণত এক বছর বয়সে বাচ্চারা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। একটা ভোঁদড় প্রায় ১৬ বছর বাঁচে। ভোঁদড়দের গায়ের পশম কত ঘন, তা কী তুমি জানতে চাও? ভীষণ ঘন। যদি গুনতে পারো তো বলি। গায়ের প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গায় প্রায় ১০ লাখ পশম থাকে। ভোঁদড়দের মতো এত পুরু পশম আর কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর নেই। বিশ্বে এ জন্য ভোঁদড়দের পশমের দাম সবচেয়ে বেশি। মজার ব্যাপার হলো, ভোঁদড়রা পানির নিচে থাকলেও এদের গা কখনো ভেজে না। এদের দেহ একধরনের পানি কুপরিবাহী পশমে আবৃত থাকায় এরা পানির নিচে থাকলেও শুষ্ক ও উষ্ণ থাকে। এমনকি ঠান্ডা জলের নিচেও এরা গরম থাকে। ভোঁদড়দের ইঁদুরের মতো গোঁফ আছে।

নদী ও সাগরে ভোঁদড় থাকে। সাগরের ভোঁদড়দের লম্বা লেজ থাকে। সাগরের ভোঁদড়রা অনেক বড় হয়। একটা সাগরের ভোঁদড়ের ওজন ৪৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু নদীর ভোঁদড়রা ছোট। নদীর ভোঁদড়রা তাদের জীবনের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ সময় ডাঙায় কাটায়। অ্যান্টার্কটিকা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর সব দেশেই ভোঁদড় আছে। এরা খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। ভোঁদড়দের জলের কিছু খেলা শেখালে এরা তা শিখতে পারে এবং সেই খেল দেখিয়ে আনন্দ দিতে পারে। সব ভোঁদড়েরই পায়ে ধারালো নখ থাকে। তাই এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গেলে বা পুষতে গেলে সাবধান!

ছবি: ইন্টারনেট