বোকা ছেলে

ছোট খালু বললেন, ‘তুই কি আমার সঙ্গে যাবি? ভেবে দেখ।’

বড় খালু মারা গেছেন সন্ধ্যা সাতটার দিকে। আত্মীয়স্বজন সবাই ভিড় করছে হাসপাতালে। সিদ্ধান্ত হয়েছে বড় খালুর কবর হবে রংপুরে। গ্রামের বাড়ি পায়রাবন্দে।

একটি মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। বড় খালুর লাশ যাবে অ্যাম্বুলেন্সে। আমি ছোট খালুকে বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি আপনার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সেই যাব।’

মাইক্রোতে গাদাগাদি ভিড়। তার চেয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই ভালো। গ্রিন লাইফ হাসপাতাল থেকে আমাদের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়ল রাত ১১টায়।

আমরা গাড়িতে মোট পাঁচজন। আমি, ছোট খালু, আর পাশের বাসার আমজাদ কাকা ও দুজন ড্রাইভার।

আমজাদ কাকা ড্রাইভারের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা কি ভাগাভাগি করে গাড়ি চালাবা?’

‘জে না।’

‘তাহলে দুজন যে?’

ড্রাইভার পাল্টা প্রশ্ন করেন। ‘আপনারা তো তিনজন। একজন থাকলেই তো হতো?’

আমজাদ কাকা ভড়কে যান। ‘না না, একা একা লাশের সঙ্গে যাওয়া ঠিক না।’

আমাদের অ্যাম্বুলেন্স মিরপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটছে। হঠাৎ ধাম করে একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল অ্যাম্বুলেন্স। বড় খালুর লাশ যেন লাফিয়ে উঠল। ছোট খালু সেদিকে তাকিয়ে চমকে গেলেন। আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ছোট খালু। তাঁর এমন চেহারা দেখে আমি তাঁর পাশ ঘেঁষে বসার চেষ্টা করি। কিন্তু ঝাঁকির জন্য ছোট খালুর পাশ থেকে আমি বারবার দূরে সরে যাচ্ছি। আমজাদ কাকা বললেন, ‘ড্রাইভার সাহেব আস্তে চালান।’ অ্যাম্বুলেন্স চড়ার পর আমজাদ কাকা ড্রাইভারকে তুমি সম্বোধন করেছিলেন। এখন আপনিতে চলে এলেন।

অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে শোয়ানো লাশ। আমি আর ছোট খালু এক পাশে। আরেক পাশে আমজাদ কাকা। কাকা জানতে চাইছেন, ‘রংপুর পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে?’

ছোট খালু বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। এখনো তো টাঙ্গাইল পৌঁছাইনি। ড্রাইভার বললেন, ‘সামনে টাঙ্গাইল। ২০ মিনিট পরই বঙ্গবন্ধু সেতু।’

ধাম করে গাড়িটা থামিয়ে দিলেন ড্রাইভার। ছোট খালু বললেন, ‘কী হলো ড্রাইভার সাহেব?’

‘কিছু হয় নাই। রাস্তা দিয়া যেন কী একটা পার হইতেছে, দেহেন।’

আমরা তিনজনেই সামনের দিকে তাকালাম। সাদা কাপড়ে মোড়া কী যেন একটা পার হচ্ছে।

ড্রাইভার বললেন, ‘স্যার, আমি হাতজোড় করে কইতাছি। আমাকে মাফ করেন। অন্য একটা গাড়ি ভাড়া কইরা যান। আমাকে এক লাখ টাকা দিলেও আমি রংপুর যামু না।’

‘কী আশ্চর্য! এই রাতে আমরা গাড়ি পাব কোথায়?’

‘ভিতরেও ভয়। বাইরেও ভয়। ভয়ে আমি আপনাগো লাশের দিকে তাকাইতে পারতিছি না। কিন্তু এর আগে তো কত লাশ বহন করলাম। এমন কইরা তো কলিজা কাঁপে নাই।’

আমজাদ কাকা হঠাৎ লাফিয়ে নামেন গাড়ি থেকে। ড্রাইভারের পা জড়িয়ে ধরে। ‘ড্রাইভারসাব, আমি আপনার পায়ে ধরছি। আমাদের এমন বিপদে ফেলবেন না। তা ছাড়া?’

‘তা ছাড়া কী?’

আমজাদ কাকা বললেন, ‘আপনিই বা খালি গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবেন। ও তো আবার আপনার গাড়ির সামনে আসতে পারে।’ এ কথা শুনে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গত বছর স্কুল ছুটির পর নানুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। মামাতো ভাই রঞ্জুর সঙ্গে নানুর উঠোনে ঘুরে বেড়িয়েছি। কী জোছনা ছিল সেদিন। আজও তেমন জোছনা হলে ভালো হতো। কেন যে এত অন্ধকার! লাশের দিকে যাতে না তাকাতে হয়, তাই আমি বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকছি।

ছোট খালু আমার হাত চেপে বললেন, ‘ভয় পেলে চলবে না।’ তার কণ্ঠ কাঁপছে। আমার সাহস দেওয়ার মানুষ দুজন। আমজাদ কাকা ও ছোট খালু। কিন্তু তাঁদের চেহারা ভয়ে কেমন শুকিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ব্রিজে ওঠার পরই কে যেন বলল, ‘এই, গাড়ি থামা।’

গাড়ি থেমে গেল ব্রিজের ওপর।

হঠাৎ পটপট শব্দ। দেখি কাফনের কাপড় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন আমজাদ কাকা ও ছোট খালু। ভয়ে আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। কাফনের ভেতর থেকে উঠে বসলেন বড় খালু। হায় আল্লাহ এ যে বড় খালু না। অন্য কেউ...!

তিনি বললেন, ‘প্লিজ, ভয় পাবেন না। ড্রাইভার সাহেব আসুন, পেছনের দরজাটা খুলুন। ভালোই হলো। ব্রিজটা দেখে যাই।’

ড্রাইভার কোনো রকমে দরজা খুললেন। তিনি লাফিয়ে নামলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো, রনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু বাতাস খাই।’

আমি পাথরের মূর্তির মতো তাঁর পেছনে পেছনে যাই। কিছুদূর হাঁটতেই দেখি, আমাদের অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে আমাদের রেখেই।

লোকটা হো হো করে হেসে ওঠে সেদিকে তাকিয়ে। অসুবিধা নেই। আমরা ওদের সিরাজগঞ্জ গিয়ে ধরব।

লোকটা তার ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতটা চেপে ধরেছে। ‘ভয় পাসনে রনি। জীবনে এ রকম দুয়েকটা ঘটনার সাক্ষী থাকা ভালো।’

‘আমার বড় খালু?’ এই প্রথমবার আমার মুখ দিয়ে কথা ফুটল।

‘সে এখন কুমিল্লা পৌঁছে গেছে। মুরাদনগরে। আমাদের বাড়িতে।’

‘তার মানে?’

‘হেবি ইন্টারেস্টিং। লাশ অদল-বদল হয়ে গেছে। তুই যখন অ্যাম্বুলেন্সে উঠলি। তখন আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স খেয়াল করেছিস। পাশাপাশি দুটো অ্যাম্বুলেন্স ছিল। আমার জায়গায় তোর খালুকে তুলে দিয়েছে। আর তার জায়গায় আমাকে রেখে গেছে।’

আমি তাঁর হাত থেকে আমার হাত ছাড়াতে চাই, কিন্তু কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। আস্তে আস্তে অন্ধকার একটু কমছে। আকাশে দু-একটি তারা উঠেছে।

‘তুই কি তারা চিনিস রনি?’

‘না। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাসায় যাব।’

‘তোদের বাসা কোথায়?’

‘কলাবাগান।’

‘ও আচ্ছা। আমি কুমিল্লা যাওয়ার সময় তোকে নামিয়ে দিয়ে যাব। আমাকে তো আর পায়রাবন্দে গেলে চলবে না। তোর বড় খালুর লাশ চলে আসবে এই পথে। ঘণ্টা দুই লাগবে। ওরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে।’

দুই ঘণ্টা। আমার এক মিনিটও সহ্য হচ্ছে না। এই লাশের সঙ্গে দুই ঘণ্টা থাকতে হবে।

‘রনি ওদের অ্যাম্বুলেন্সটা সিরাজগঞ্জ অ্যারিস্টোক্যাটে পৌঁছেই খারাপ হয়ে গেছে। ভালো হলো। তোর বড় খালু পৌঁছালেই আমরা দুই লাশ গাড়ি বদল করে নেব।’

‘আল্লাহ আমাকে সাহস দাও। আল্লাহ আমাকে সাহস দাও।’ আমি মনে মনে এ কথা বারবার বলছি। বলতে বলতে ভুলও হচ্ছে। সাহসের জায়গায় কয়েকবার বললাম, ‘আল্লাহ আমাকে হাসস দাও। আমাকে হাসস দাও।’

হঠাৎ লোকটা হাত উঁচু করল। একটা অ্যাম্বুলেন্স থামল আমাদের সামনে। ‘ভাই, দয়া করে আমাদের একটু অ্যারিস্টোক্যাট রেস্টুরেন্টে নামিয়ে দেবেন।’ তিনি ফিস ফিস করে আমার কানে কানে বলবেন, ‘এটাতেই তোর খালু আছে।’ আমরা লাশের পাশে গিয়ে বসলাম।

বেশ দ্রুত আমরা পৌঁছে গেলাম অ্যারিস্টোক্যাটে। বড় খালুর লাশ শূন্যে ভেসে উঠল। শাঁই শাঁই করে উড়ে গেল আমাদের আগের অ্যাম্বুলেন্সে। আর হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাশের লোকটা নেই।

আধা ঘণ্টা পর বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। আমাদের অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার সব ঘটনা বলার চেষ্টা করছেন তাদের। কিন্তু তারা তার কথা কিছুই বিশ্বাস করছে না। আমজাদ কাকা, ছোট খালু সবাই ভয়ে কাঠ। আরেকটা লাশের গাড়ি উল্টোদিকের রাস্তা ধরেছে। কুমিল্লা যাবে। আমাদের গাড়িটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটা লোক এসে বলল, ‘আপনারা ভয় পাইছেন। ড্রাইভারসাবও ভয়ে কাঠ। এক কাজ করুন। রেস্টুরেন্টের ভিতরে গিয়া বসুন। ফজরের সময় জোছনা হইব। ফকফকা হইয়া যাইব। তখন রওনা দেন। আর ভয় লাগব না।’

আমরা পাঁচজন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। হঠাৎ আমার চক্ষু চড়ক গাছ। হায়, আল্লাহ। এ যে বড় খালু। তিনি আমার পাশে এসে বসেন। ছোট খালুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি শুধু এক কাপ চা খাব। অ্যাম্বুলেন্সের এসিতে একদম ঠান্ডা হয়ে গেছি।’

বড় খালু আমার কাঁধে হাত রাখেন। আমার মনে হলো, আমার কাঁধে হাজার মণ বরফ ঢেলে দিলেন তিনি।

বললেন, ‘এত রাতে তোর লাশের গাড়িতে আসার কী দরকার ছিল। তুই তো মাইক্রোতেই আসতে পারতি। বোকা ছেলে।’

অলংকরণ: জুনায়েদ