ধবলগিরি অভিযান

ঘটনার শুরু একটা বই থেকে—ছোট মোটা বোর্ডে বাঁধাই একটা বই— বোমংপরিবারের ইতিবৃত্ত—এই বইটা আমার বড় চাচ্চু কলকাতায় গিয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনেছিলেন। তারপর অন্য অনেক কিছুর মতোই বড়োচ্চু বইটার কথা ভুলে গিয়েছিলেন, অনেক দিন বৈঠকখানার শেলফেই পড়ে ছিল অবহেলায়। হঠাৎ কিছুদিন আগে ঈদের ছুটিতে বড়োচ্চু কী মনে করে আবার ওই বই পড়তে শুরু করেন এবং বইটা পড়া শেষ করেই বাবা ও আমাদের দুই বোনকে ডেকে ঘোষণা করলেন, তিনি ধবলগিরি যাবেন।

ধবলগিরি কী? বাবা, আমি—জারা—আর সারা—আমার ছোট বোন—মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।

বড়োচ্চু মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমরা তো দেশের কোনো কিছুর খোঁজখবর রাখো না, ধবলগিরি হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা পর্বতশ্রেণির নাম, এই যে এই বইটা, এতে সব ইনফরমেশন আছে, দয়া করে পড়ে নিয়ো,’ বলে  বোমংপরিবারেরইতিবৃত্ত বইটা বাড়িয়ে দিলেন আমাদের দিকে। ‘আগামী শুক্রবারেই রওনা হচ্ছি আমরা!’ বলে উঠে পড়লেন বড়োচ্চু।

বইটা প্রথমে হাতে নিলেন বাবা, পরে আমরা:  বোমংপরিবারেরইতিবৃত্ত, বের হয়েছিল ১৯২৩ সালে, তবে আমাদের হাতের বইটা ওই বইয়ের মূল কপি না, ফটোকপি, বইয়ের মতো করে বাঁধাই করা অবিকল। প্রথম পাতায় লেখক হিসেবে নাম আছে এক চাকমারাজের: সাং প্রো চাকমা। পৃষ্ঠাসংখ্যা সাকল্যে ৪০-এর মতো হবে। বই ঘেঁটে সাং প্রো সম্বন্ধে যা জানা যাচ্ছে, তা হলো ছেলেবেলায় তিনি মিশনারি স্কুল ও পরে ত্রিপুরা গিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে নিজের এলাকায় ফিরে এসে পাহাড়ের বিরাট এক এলাকাজুড়ে ঔপনিবেশিক আমলের প্ল্যানটেশন কায়দায় চাষাবাদের কাজ শুরু করেন। বইয়ের বেশির অংশজুড়ে আছে তাঁর পারিবারিক ইতিহাস, আর পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্ণনা। এই পর্বে—বইয়ের শেষ দিকের কিছু পৃষ্ঠায়—বড়োচ্চু আমাদের জন্য হাইলাইটার দিয়ে আগেই দাগিয়ে দিয়েছেন, অবশ্যপাঠ্য হিসেবে—তা পড়ে যা বুঝলাম, সংক্ষেপে যদি বলি: সাং প্রো তাঁর বইয়ে পার্বত্য এলাকার একটা বিশেষ পর্বতের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে এক প্রাকৃতিক গুহার বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনামতে, এটা সাধারণ কোনো গুহা নয়। তাঁর মতে, গোটা দুনিয়ায় এ রকম গুহা দ্বিতীয়টি আর নেই। এই গুহার সবকিছুর রং সাদা—সেটা চুনাপাথরের মতো কিছুর কারণে হয়েছে বলেও মনে করার কোনো কারণ নেই—ওখানে কোনো চুনাপাথরের খনিও নেই। সাং প্রোর মতে, ওটা এক আশ্চর্য গুহা, যে গুহার সবকিছুই সাদা, যেখানে চারপায়ে হাঁটে কিংবা ডানায় উড়ে বেড়ায় এ রকম যেকোনো পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ—সবই নাকি সাদা।

আমি বুঝি, এই পারিবারিক ইতিহাসের বই যখন লেখা হয়েছে, তখন আজকের মতো বিজ্ঞানের তত উন্নতি হয়নি। এ রকম অজস্্র আজগুবি জিনিসে তখন মানুষের বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার কথাও ততটা মনে হয়নি। তার ওপর আমাদের পশ্চাদপদ বঙ্গদেশের এই অতি দুর্গম অঞ্চলের কোন্ পাহাড়ে, অদ্ভুতুড়ে এক গুহার বর্ণনায় কারই বা কতটুকু কৌতূহল জাগবে! ফলে আজ পর্যন্ত ওই গুহা নিয়ে কারও কোনো আগ্রহ হয়নি। এখন একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের জীববিজ্ঞানী বড়োচ্চু।

বইটা পড়ার পর বড়োচ্চুর সঙ্গে আমরাও খানিকটা সায় দিলাম যে না, একবার অন্তত গিয়ে দেখা যেতে পারে, তারপর নাহয় দেখা যাবে সাং প্রোর দাবি কতখানি সত্য আর মিথ্যা!

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, চাচ্চু আসলে কী করতে চাইছেন, এটা শ্রেফ কোনো ভ্রমণ না অন্য কিছু? বড়োচ্চু স্মিত হেসে জানালেন, সাং প্রো এত বছর পর বেঁচে আছে বলে তিনি মনে করেন না। তাঁর বইটা লেখা হয়েছে ১৯২৩ সালে, আর এটা হলো ২০১৫ সাল। এত বছর ওই লোক বেঁচে আছেন এটা তিনি আশাও করেন না। সেই বিবেচনায় তিনি আমাদের বলার আগেই নিজে কিছু খোঁজখবর করেছেন এবং তাঁর পুরোনো বন্ধুবান্ধব মারফত তিনি যা জেনেছেন তা হলো সাং প্রো মারা গেছেন অনেক আগেই, কিন্তু তাঁর এক ছেলে এখনো বেঁচে আছেন, তাঁর নাম কেউজান প্রো এবং তিনি এখনো ছোট একটা এলাকা নিয়ে বাবার চাষাবাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তামাক, ফলফলারির পাশাপাশি তাঁর অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। পাহাড়িদের জীবনমান উন্নয়নে এনজিওগোছের কিছু প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন। তাঁর সঙ্গে বড়োচ্চুর হয়ে স্থানীয় এক বাঙালি যোগাযোগও করেছিলেন, বড়োচ্চু ওই সাদা গুহা সম্পর্কে কিছু প্রশ্নও রেখেছিলেন তাঁর কাছে—তাঁরা বাবার বইয়ে বর্ণিত ওই রকম কোনো গুহা আদতেই আছে কি না!

উত্তর এসেছে ‘হ্যাঁ’-সূচক। তাঁর জানামতে, ওই গুহা এখনো অস্তিত্বমান, যদিও তিনি নিজে—কেউজান প্রো—কখনো স্বচক্ষে গিয়ে ওই গুহা দেখার চেষ্টা করেননি। স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের মতে, ওই এলাকা অভিশপ্ত বা ভুতুড়ে, এর আশপাশে তাদের যাওয়া একদম নিষেধ—অর্থাৎ পাহাড়িদের কাছে ওই এলাকা নিষিদ্ধ এক অঞ্চল।

ধবলগিরি যাওয়ার ব্যবস্থা ততটা দুর্গম নয়। প্রথমে বান্দরবান শহর, তারপর সেখান থেকে জিপে করে যেতে হবে মোজক নামে এক জায়গায়, এটা কেউজান প্রোর খামার এলাকা। এখানে তাঁর একটা পাহাড়ি বাংলো আছে, আর ওই বাংলো থেকে ধবলগিরির দূরত্ব মাত্র ১২ মাইলের মতো। আর কেউজান প্রো বিনীতভাবেই জানিয়েছেন, বড়োচ্চুর মতো একজন বিখ্যাত জীববিজ্ঞানীকে—ড. শমশের খান—তিনি অতিথি হিসেবে পেলে ধন্যই মনে করবেন।

এখন সাদামাটাভাবে বললে এই ধবলগিরি অভিযাত্রাকে খুব সোজা-সরল এক ভ্রমণ অভিযাত্রা বলেই মনে হচ্ছে, তাই না? নিছক এক বনভোজনও বলা যায়। তবে আমি সাবধান করে বলছি, এটা একটা সময় পর্যন্ত এ রকম মনে হতে পারে। তারপর কিন্তু আর না...তোমরা আমার কথা পরিষ্কারভাবে শুনেছ আশা করি।

সব আয়োজন করে গুছিয়ে উঠে মোজক রওনা হতে হতে আমাদের মাস খানেক সময় লেগে গেল। এতে অবশ্য আমাদের কোনো সমস্যা হলো না। আমার আর সারার—দুজনেরই স্কুল বন্ধ আর বিমানবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া আমার বাবার হাতেও অফুরন্ত অবসর। তাই যখনই যাওয়া হোক, আমাদের কারও কোনো তাড়াহুড়োর ব্যাপার নেই। আর এমনও তো নয় যে প্রায় ৯২ বছর ধরেই অস্তিত্বমান ওই গুহা হঠাৎ করে আমাদের কয়েক দিনের বিলম্বে, কোনো রকম ঘোষণা না দিয়ে বিনা নোটিশে অদৃশ্য হয়ে যাবে!

মোটামুটি আমাদের অনুমিত কিংবা পরিকল্পিত সময়েই আমরা বান্দরবান পৌঁছালাম, আর দেখলাম কেউজান প্রো নিজেই বড়োচ্চুকে অভ্যর্থনা করার জন্য হাজির হয়েছেন, খুবই হাসিখুশি চেহারার বন্ধুবৎসল এক লোক। আমাদের পেয়ে যেন ভদ্রলোক অসম্ভব কিছু পেয়ে গেছেন, খুব খুশি। তার কারণ তিনি ব্যাখ্যাও করলেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় কদাচ ঢাকা থেকে কিংবা দেশের বাইরে থেকে এক-দুজন লোক তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করে। ফলে কোনো নতুন অতিথি এলে তাঁর আসলে আনন্দের সীমা থাকে না।

পরদিন বেশ বেলাবেলিই আমরা মোজক থেকে ধবলগিরির পথে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ি জঙ্গুলে পথ, কিন্তু কিছুদূর আসার পরই বুঝলাম মাত্র ১২ মাইল পথ হলে কী হবে, সামনে পথের যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা অতীব দুর্গমই হবে। জিপে চেপে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তার মানে পুরো পথ হেঁটেই এগোতে হবে। আর তারপর—যা জানলাম—ধবলগিরির সাদা গুহার দেখা মিলবে বেশ কয়েক হাজার ফুট উচ্চতায় ওঠার পর, মাঝে আমাদের দীর্ঘ সাপের মতো পেঁচিয়ে ওঠা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এককভাবে মাথা তোলা খুব উঁচু পাহাড়-পর্বত নেই। বেশির ভাগই প্রায় একই উচ্চতার ছোট ছোট টিলা কিংবা পাহাড়, সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলতে একসময় বলা হতো কেউক্রাডংকে, পরে তাজিংডং, জ-ত্লং আর এখন মদক তং।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউজান প্রো আমাদের অভিযাত্রার সঙ্গী হতে পারলেন না, তাঁর রুমায় কী একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, ফলে তিনি বারবার দুঃখ প্রকাশ করে বান্দরবানেই থেকে গেলেন। তবে আমাদের অভিযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে স্থানীয় এক পাহাড়িকে পথপ্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে দিলেন— এর নাম তেনসি, এক চাকমা তরুণ। তবে যাত্রার খানিক পরেই আলাপচারিতায় জানা গেল তেনসি ধবলগিরির সাদা গুহা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে যাবে না। কারণ, স্থানীয় অন্য সবার মতোই, সেও ধবলগিরির অপদেবতাদের ভয়ে ভীত। তবে ধবলগিরির সাদা গুহার কাছাকাছি একটা জায়গা পর্যন্ত সে আমাদের সঙ্গে যাবে, যেখান থেকে ওই গুহায় পৌঁছাতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হবে না।

বড়োচ্চুই আমাদের মধ্যে পর্বতারোহণের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্ত্ততি নিয়ে এসেছেন। ট্রেকিং উপযোগী জ্যাকেট, পিঠে হ্যাভারস্যাক আর মাথায় বেশ কায়দা করে মুসা ইব্রাহীমের নর্থ অ্যালপাইন মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের লোগোওয়ালা একটা টুপিও পরেছেন। আর আমরা সবাই যেহেতু শখের পর্বতারোহী, তাই শুধু জিনস আর টপস, সারা শুধু বড়োচ্চুর অনুসরণে সামনের দিকে কার্নিশওয়ালা একটা টুপি পরেছে, মূলত পোকামাকড়ের ভয়ে। প্রথম কয়েক মাইল বেশ ফুরফুরে ভাবেই উঠে এলাম আমরা। তারপরই আস্তে আস্তে নানা বৈরিতার মুখোমুখি হতে শুরু করলাম: এর আগে পর্যন্ত আমরা ছোট ছোট কিছু শাখা-প্রশাখা ছড়ানো গাছপালার তলা দিয়ে সামনে এগোচ্ছিলাম, একটা পর্যায়ে এসে হঠাৎ খেয়াল করলাম, ছোট ছোট গাছপালার পরিবর্তে চারপাশে শুধু আকাশছোঁয়া বাঁশ। বাঁশের ঝাড় আর আবহাওয়াও কেমন পাল্টে গেছে—আঠালো, কেমন চটচটে একটা গরম। খানিকটা ভ্যাপসা ভাবও আছে। আর বাড়তি উপদ্রব হিসেবে জুটেছে ইয়া ইয়া পেল্লাই সাইজের একেকটা কালো-কুৎসিত মশা, দিনদুপুরেই যেন ঝাঁপিয়ে এসে কামড়াচ্ছে ওরা, কিন্তু তার চেয়ে বড় আরেক ভয়ের কারণ হলো সাপ। তেনসি জানিয়েছে, পুরো বনেই নাকি নানা ধরনের সাপ আছে, এর বেশির ভাগই বিষাক্ত, আর আমরা প্রায়ই দেখছি আমাদের সাড়া পেয়ে আশপাশে সড়সড় শব্দ তুলে কী যেন সরে যাচ্ছে। কিন্তু অচিরেই সাপের আতঙ্কের সঙ্গে যোগ হলো নতুন আরেক আতঙ্ক, জোঁক। বড়োচ্চু যদিও আমাদের দুই বোনকে নির্ভয় দেওয়ার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করলেন: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সব জঙ্গলেই এক-আধটু এ রকম জোঁক থাকে, তাতে পাত্তা না দিলেই হলো। কিন্তু বড়োচ্চু অভয় দিলে কী হবে, জোঁকগুলো এমনই ভয়ংকর, তুমি কী কাপড় পরে আছো, তাতে কিছুই এসে-যায় না। কীভাবে যেন ওরা ঠিক তোমার শরীরের কোনো না কোনো জায়গায় দিব্যি চামড়ার সঙ্গে লেপ্টে গিয়ে রক্ত চুষে নিতে শুরু করবে। জোঁকের কারণেই এরপর দেখা গেল আমাদের মাঝে মাঝেই থামতে হচ্ছে নিয়ম করে। ছোট ছোট কুৎসিত ঘিনঘিনে এই প্রাণীটিকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলার পরই আবার পথচলা শুরু করা যাচ্ছে।

চোখের জন্য দারুণ আরামদায়ক বুনোফুলের যেন মেলা বসেছে পুরো জঙ্গলে, ছোট ছোট কাঁটা ঝোপের মতো আগাছার জঙ্গলে রংধনুর সব রং মেখে ফুটে আছে বাহারি সব ফুল, সঙ্গে কখনো তীব্র ঝাঁজাল কিংবা দারুণ সুমিষ্ট সুবাসও নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় দেখা মিলছে ছড়ানো ঝাড়ের মতো সবুজ ফার্ন আর অজানা লতাগুল্মের। কিছু পিঙ্গল বর্ণের লতানো ঝোপও নজরে আসছে।

হাজার তিনেক ফুট উঠে আসার পর যেন নতুন আরেক দুনিয়ায় প্রবেশ করলাম আমরা। এখানে বাঁশঝাড় তুলনামূলকভাবে কম, তার তুলনায় খর্বকায় বেতঝোপে যেন পুরো এলাকা ছাওয়া, আর স্থানে স্থানে সবুজের একঘেয়েমি কাটাতেই যেন ফুটে আছে লাল আর কমলা রঙের সব মাশরুম আর বেগুনির কাছাকাছি রঙের আরেক ধরনের উদ্ভিদ, অনেকটা হলুদ চারার মতো দেখতে। পায়ের তলার পথও যেন হঠাৎ করে পাল্টে গেছে। মনে হচ্ছে মখমল বিছানো কোনো পথে হাঁটছি আমরা। মাটির প্রতিটি ইঞ্চি, গাছের গুঁড়ি, ওই তীব্র সবুজ রঙের মসে আকীর্ণ হয়ে আছে, যাকে বলে। চোখে পড়ল দারুণ ঝলমলে রঙের কিছু আশ্চর্য অর্কিডও। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ওপরে উঠে আসার পর টের পেলাম আবহাওয়াও যেন অনেকখানি সহনীয় হয়ে উঠেছে, শীতল। প্যাচপেচে গরম কমে গেছে, দরদরিয়ে ঘামাও যেন বন্ধ হয়েছে।

আরও কিছুক্ষণ পথ চলার পর একটা জায়গায় এসে আমাদের থামাল তেনসি। তার ভাষায়, এই জায়গার নাম মিরুং এবং এরপর সে আর সামনে যাবে না। পরিষ্কার বাংলায় সে বলল—এমনিতে অন্য পাহাড়িরা বাংলা বলে একটু বাধো বাধো ঢংয়ে—তেনসি তেমন না, তিন বছর আগে তার কলেজ শেষ করেছে, কেউজানের তামাক ফার্মে কাজ করছে সে বছর দুয়েক ধরে, কাজেই সে মোটামুটি শিক্ষিত পাহাড়িই—কিন্তু লেখাপড়া করলেও তেনসি প্রচলিত অন্ধবিশ্বাসকে বিসর্জন দিতে পারেনি। মিরুংয়ে পৌঁছে মাটিতে হাতের লাঠি পঁুতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। তার শরীরী ভাষা বলছে, তাকে মেরে ফেললেও আর এক পা সামনে এগোবে না সে, মুখ-চোখ এমনই দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।

বড়োচ্চুর হাতের আল্টিমিটার বলছে, আমরা প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুটেরও ওপরে আছি। এখনো বাঁশ, বেত আর বুনো আগাছার অফুরান জঙ্গল চারপাশে। তবে বড় গাছপালা এখন খুব কম, যা-ও দু-একটা সামনে পড়ছে তা নিচের গাছগাছালির চেয়ে আরও খর্বকায়, আরও রুঠো ধরনের। তেনসি ওপরের দিকে পর্বতের গায়ে একটা খাঁজের মতো দেখাল হাত তুলে, শ পাঁচেক ফুট ওপরে। তার ভাষ্য, ওখানে গেলেই আমরা গুহার দেখা পাব। আর সে আরও জানাল, আমাদের জন্য সে এখানেই অপেক্ষায় থাকবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত, তার মধ্যে আমরা না ফিরলে সে ফিরে যাবে। কিন্তু তার বলার ধরনেই মনে হলো, আমরা যে ফিরব এ বিষয়ে সে যথেষ্টই সন্দিহান।

আমরা খুব সকাল সকালই রওনা দিয়েছিলাম যে কারণে এখন ঘড়িতে দেখি বেলা ১১টার মতো বাজে, তাতে মোটামুটি যে হিসাব পাওয়া গেল; তাতে দেখা যাচ্ছে ১২ মাইলের মতো পথ পেরোতে আমাদের সময় লেগেছে ঘণ্টা ছয়েকের মতো—ট্রেকিংয়ের বিচারে যা জঙ্গুলে পথে ভালোই অগ্রগতি হিসেবে ধরা যায়।

তেনসির কথামতো আমাদের জন্য কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সে। ওই সময়ের মধ্যে যদি আমরা ফিরে না আসি, তাহলে সে ধরে নেবে আমরা আর ফিরব না। কিন্তু যে কথাটা সে মুখে বলেনি, ওই সময়ের মধ্যে আমাদের না ফেরার অর্থ হলো ওর কাছে যে আমরা অপদেবতার খপ্পরে পড়ে গেছি, বেঁচে আর ফিরতে পারব না। কাজেই সেও কোনো বিপদে পড়ার আগেই দ্রুত সমতলে ফিরতে চায়; এ ছাড়া আরেকটা কারণে সে বেশি সময় অপেক্ষা করতে রাজি নয়। রাতে জঙ্গলে একলা আটকা পড়া খুবই বিপজ্জনক, সন্ধ্যার পর পাহাড়ি পথে অন্ধকারে পথ চলা যেমন বিপদসঙ্কুল, তেমনি পথ হারানোর ভয়ের সঙ্গে আছে আরও জানা-অজানা নানা বিপদের ঝঁুকি।

ফেরার পথে, আমি হিসাব করে যা বুঝলাম—আমাদের চার-সাড়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। যেহেতু আমরা নিচের দিকে নামব, কাজেই সেদিক থেকে গুহা ঘুরে দেখার জন্য আমরা তিনটা পর্যন্ত সময় পাব। অর্থাৎ চার ঘণ্টা সময় আমাদের হাতে থাকছে—যদি না, পথ হারিয়ে আমাদের এই মশা-জোঁকে বোঝাই জঙ্গলে রাত কাটানোর মতো দুর্গতিতে না পড়তে হয়—বেলাবেলিই গুহা পরিদর্শন শেষে আমরা আশা করি বাংলোতে ফিরতে পারব। তবে এই হিসাব পুরোই আমার, এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলাপ হলো না। তবে আমার ধারণা, অন্যদের মতেও চার ঘণ্টা সময় গুহা দেখার জন্য যথেষ্টই বিবেচিত হবে।

আমরা আরও কিছুক্ষণ পাহাড় বেয়ে ওঠার কসরত শেষ করে ওপরের খাঁজটাতে পৌঁছালাম। আমাদের সামনেই কয়েক হাতের মধ্যেই সেই গুহা—খাড়া পাহাড়ের ঢালে সংকীর্ণ একটা ফাটলের মতো, যেন পাথরের গায়ে অতিদানবীয় কেউ একটা কোপ বসিয়ে দিয়েছে এই গুহা তৈরির জন্য। গুহার সামনে শেওলার মতো মসের কার্পেট আরও ঘন, আরও গভীর, আর জঙ্গলের অন্য স্থানে জন্মানো মসের মতো এর রং গাঢ় সবুজ নয়, কেমন সাদাটে ময়লা একটা রং। আর একেবারে শুকনো, ঝুরঝুরে, ধুলোর মতো। আমাদের পায়ের চাপে যেন আরও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে এই প্রাকৃতিক মখমল, অনেকটা শুকনো কয়লার ঢিবিতে হাঁটার মতো। ঠিক তখনই সাদা একটা কিছুর নড়াচড়া চোখে পড়ল আমাদের, বিশাল এক অজগর হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়ে আমাদের সামনে দিয়েই আরেক দিকে চলে গেল। এটার গায়ের রংও একই রকম, ফ্যাকাশে সাদা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সারা প্রায় আরেকটু হলেই ওটার ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সারা এত কাছে চলে যাওয়ার পরও সাপটার মধ্যে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া হলো না, একটুও ফুঁসে উঠল না, কোনো রকম আক্রমণ তো দূরের কথা! উল্টো মনে হলো ওর সমস্ত মনোযোগ, শক্তি—সবকিছু ব্যয় হচ্ছে ওর ওই ভারী শরীরটাকেই টেনে নেওয়ার কাজে। অজগরটার এই হাল কেন সেটা জানলাম আরও পরে। গুহায় ঢোকার পর বাবা আর বড়োচ্চু মশাল জ্বেলে নিয়েছেন। ফলে একবার নজর বুলিয়েই বলে দেওয়া যাচ্ছে চাকমা রাজা সাং প্রো মিছে বলেননি বা বানিয়েও কিছু বলেননি। গুহার মুখটাকে ঠিক পুরো সাদা বলা যাবে না; ঠিক যেন সাদা না, বরং রংটাকে বলতে হবে ফ্যাকাশে ধরনের ধূসর বা ছাইরঙের কাছাকাছি; কিন্তু আমরা যত ভেতরে ঢুকছি, খেয়াল করছি এই অনুজ্জ্বল ছাইরংও ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। খানিক দূর পর্যন্ত শুধু ঘষা কাচের মতো একটা সাদাটে রং, এরপর কিছুটা নিষ্প্রভ সাদা, তারপরই শুরু হলো একেবারে বরফের মতো ধু ধু সাদার, এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। এই সময় শুধু একটা ব্যাপারই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল: সামনের সবকিছু সাদা, এক ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না সাদার রাজ্যে। আমি কিছু না বুঝেই সাদা রঙের ধন্দের কারণে অতিসাদা এক ঝোপের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, পড়ার আগে পর্যন্তও বুঝিনি এটা কোনো ঝোপ। সারা এই সময়েই আরেকটু হলেই বেশ বড়সড় এক সাপের ওপর পা দিয়ে ফেলেছিল। সাদা মেঝের ওপর সাদা একটা সাপ, লাঠির মতো শুয়ে আছে, ও বোঝেইনি! সাপটা সামান্য পাকিয়ে উঠে একটা ফণা তুলল, হিসহিসে একটা শব্দ উঠল গুহার ভেতর। সারা আর আমি একেবারে পাথরের মতো জমে গেলাম, রুদ্ধশ্বাস দুই মুহূর্ত। তারপরই সাপটা নিঃশব্দে ফণা নামিয়ে নিয়ে গুহার ভেতরের দিকের সাদার অসীমে হারিয়ে গেল।

আমি যে ঝোপটার ওপর পড়েছিলাম তা নজর করে দেখতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। পাশে বেশ কিছু বুনো ফুল আর অর্কিডের ঝাড়ও আছে, কিন্তু সব ধবধবে সাদা। শুধু তা-ই নয়, আশপাশে জন্মানো সব উদ্ভিদ, ঝোপঝাড়—যা-ই বলি না কেন, সবকিছুর একটাই রং, সাদা; গাছের পাতা, কাণ্ড—কোনোটারই সাদা ছাড়া অন্য কোনো রং নেই। শুধু আকৃতি দেখে বুঝে নিতে হবে কোনটা কী। কিছু সাদা মাছির ওড়াউড়িও চোখে পড়ল, কয়েকটা সাদা বাদুর ডানা ঝাপটে উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। মশালের আলোয় তাদের বিশালাকৃতির একেকটা প্রজাপতির মতো দেখাল। আসলে, নিজের চোখে না দেখলে এই দম বন্ধ করা অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারটাকে বর্ণনা করে কিছুতেই বোঝানো যাবে না।

বড়োচ্চু প্রায় বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন, বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না তাঁর কিছুতেই। প্রকৃতিতে এমনও ব্যাপার আছে! বড়োচ্চু এ সময় আবিষ্কার করলেন গুহার সাদা রংটা মিহি গুঁড়োর মতো আমাদের হাতে লেগে যাচ্ছে। মেঝে থেকে সাদা একটা পোকা হাতে তুলে নিয়ে খানিকক্ষণ দেখলেন তিনি, তারপর উবু হয়ে বসে মেঝেতে হাত ছড়িয়ে তালু দিয়ে দাগ কাটলেন একটা লম্বালম্বি, তারপর হাত তুলে আমাদের দেখালেন তাঁর হাতের পুরো তালু সাদা। আমিও একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে মাটি থেকে কিছু গুঁড়ো তুললাম। সত্যিই তো! এ তো আটা কিংবা ময়দার গুঁড়োর মতো, আরও একটু যেন মিহি!

‘এটা পলির মতো একটা কিছু,’ বললেন বড়োচ্চু। ‘কিসের পলি, এটা তো কোনো নদী না, ভাইজান?’ মন্তব্য করলেন বাবা।

‘আরে, ওটাই তো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে,’ জবাব দিলেন বড়োচ্চু। মুখের কাছে নিয়ে সাদা গুঁড়ো শুঁকে দেখলেন। ‘আমার মনে হচ্ছে এটা কোনো ধাতু,’ তার পরের সিদ্ধান্ত হলো: ‘আমাদের উচিত হবে এখান থেকে একটা কোনো পাথর কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বাইরের আলোতে দেখা। তাহলে জিনিসটা ভালো করে দেখা যাবে।’

বড়োচ্চু তাঁর হ্যাভারশ্যাক থেকে হাতুড়ি বের করে গুহার গা থেকে খানিকটা বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে সজোরে বাড়ি লাগালেন, কিন্তু কেমন একটা ঝাঁকুনি খাওয়ার মতো শব্দ হলো, মনে হলো হাতুড়িটা দারুণ শক্ত কিছুর সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ঝনঝনিয়ে কেঁপে উঠল: ‘ওরে বাপরে!’ নিজের অজান্তেই বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে এল বড়োচ্চুর মুখ থেকে। ‘এ তো সাংঘাতিক শক্ত।’

এই সময় মেঝে থেকে বেশ বড়সড় একটা পাথরখণ্ড তুলল সারা, আড়ে-দিঘে ফুট খানেক তো হবেই, কিন্তু ওর ধরার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, পাথরখণ্ডটা যত বড় দেখাচ্ছে, ওজনে তার চেয়েও হালকা।

বড়োচ্চু সারার হাত থেকে পাথরখণ্ডটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আশ্চর্য, কোনো ধাতু এত হালকা কীভাবে হয়, কিন্তু কী ভয়ংকর শক্তও!’

আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, পাথরটার রং। পাথরের সাদা রং আস্তে আস্তে যেন পাল্টে যাচ্ছে, মশালের আলোয় সাদা রং বদলে গিয়ে ক্রমেই লাল রং ধারণ করছে—উজ্জ্বল, টকটকে লাল, ভেতর থেকে গাঢ় রঙের একটা দ্যুতিও বিকিরিত হচ্ছে। এটা যে আজব কোনো ধাতু এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না আমাদের কারোই। বড়োচ্চুর মুখ-চোখ সাদা হয়ে গেছে, হড়বড় করে কী সব বলছেন: ‘ওরিকালকুম...না, না...মিথরিল...’ এসব অদ্ভুত নাম আমি জীবনে কোনো দিন শুনিনি।

এরপরই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। বড়োচ্চুর হাতে ধরা পাথরটা থেকে হঠাৎ ধোঁয়া বের হতে শুরু করল। তাঁর মুখ-চোখ দেখে মনে হলো যেন গরম কোনো কিছু ধরে আছেন। তবে, আমাদের সবার প্রাথমিক ধারণা হলো: মশালের আলোর উত্তাপেই কোনো একটা গন্ডগোল ঘটে থাকবে। কারণ, আমরা যখন ঢুকি তখন গুহার ভেতরটা বেশ ঠান্ডাই ছিল। কিন্তু এখন কেমন একটা তাতানো গরম টের পাচ্ছি।

বাবা বড়োচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজান, তুমি এমন কঁুকড়ে আছো কেন, কী ব্যাপার?’

বড়োচ্চু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না, চোখ বড় বড় করে বাবাকে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর বললেন, ‘তোর কী হয়েছে? তুই নিজেকে দেখেছিস!’

বড়োচ্চুর কথায় আমরা সবাই বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, এ কী! বাবার পুরো মুখ চকপাউডারের মতো সাদা দেখাচ্ছে।

আমরা কিছু বলার আগেই বড়োচ্চু আঁতকে ওঠার গলায় বললেন, ‘সর্বনাশ! এই ধাতুর গুঁড়ো তো আমাদের অক্সিডাইজড করে ফেলছে। দেখ সবার চেহারা, শরীরে, সাদা প্রলেপ পড়ে গেছে। আমরা আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সবার শরীরে ওই ধাতুর আবরণ পড়ে যাবে।’

বড়োচ্চুর কথাই ঠিক। আমি আমার খোলা হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি, চকের গুঁড়োর মতো মিহি এক আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে আমার আসল চামড়ার রং—কী ভয়ংকর! ‘জারা আপু, চলো তাড়াতাড়ি বাইর হই এইখান থিকা,’ পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল সারা।

ওদিকে বড়োচ্চুর হাতের পাথরখণ্ড রীতিমতো জ্বলজ্বল করছে এখন। যেন কোনো আগুনের টুকরো। তীব্র দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছে। ‘নাহ্‌! আর রাখা যাচ্ছে না!’ বলে হাত থেকে উত্তপ্ত পাথরখণ্ডটা মাটিতে ছুড়ে ফেললেন বড়োচ্চু, ওটা এখন প্রায় অগ্নিকুণ্ডের মতো আলো ছড়াচ্ছে। এ সময় আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম: গুহার ভেতরটাও—দুই পাশের দেয়াল—কেমন যেন লালাভ একটা রং পেয়েছে, আগের সাদা আর নেই। শরীরেও অদৃশ্য এক উত্তাপ টের পাচ্ছি। কিন্তু বড়োচ্চু একটা কোনো নমুনা না নিয়ে গুহা থেকে কিছুতেই বের হতে চাইছে না। বাবা প্রায় জোর করে তাঁকে টেনে বাইরে বের করে আনলেন। আর ঠিক তখনই—গুহামুখের ভেতরের দিক থেকে একটা ভারী, ভোঁতা একটা শব্দ কানে এল আমাদের, তারপরই দেখলাম ভেতর থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া—বড়োচ্চুর মতে, আমরা মখমলের মতো মসের কার্পেট মাড়িয়ে যখন গুহার ভেতরে ঢুকছিলাম, তখনই শুকনো পাতার মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল মসগুলো পায়ের নিচে পড়ে। তার মানে গুহার বাইরেটা যেখানে সূর্যের আলো পড়ে, সেখানটা তো তেতেই ছিল, ভেতরের অফুরান ধাতুর গুঁড়ো পরে আমাদের মশালের আলোর সংস্পর্শে এসে পুরোই উত্তপ্ত হতে শুরু করে গুহাটা। বিশেষ করে ওই পাথরখণ্ডের উদাহরণ টানলেন তিনি, ‘ওটা যেভাবে গনগনে আগুনে পাথরে পরিণত হলো আমাদের চোখের সামনে, ওটা জাস্ট ম্যাচের কাঠির কাজ করেছে। ওটা আমি ছুড়ে ফেলার পর—’ বড়োচ্চু আর শেষ করলেন না। গুহার ভেতর থেকে তখন থেকে থেকে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মুখের কাছে ভলকে ভলকে উঠছে আগুনের পাকানো শিখা।

আর দেরি না করে প্রাণ বাঁচাতে আমরা সবাই ছুটলাম নিচের দিকে।

খানিক নিচে নেমে আসার পর ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম: আগুন এখন আরও দাউ দাউ করে জ্বলছে। গুহার আশপাশ পুরো ছেয়ে গেছে আগুনে। দ্রিম দ্রিম করে বিস্ফোরণের আওয়াজ এখনো আসছে গুহার ভেতর থেকে নিয়মিত বিরতিতে।

তেনসির নিচের যে জায়গায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা ছিল, সেখানে তার টিকিটিও নেই। আগেই ভেগেছে, নাকি গুহার আগুন দেখে ভয়ে পেয়ে দৌড় লাগিয়েছে, খোদা মালুম! যা হোক তেনসিকে ছাড়াই আমাদের বাংলোয় ফিরতে হলো।

তবে এই সফরের কথা আমি কোনো দিন ভুলব না। হুড়োহুড়ি করে নামার পথে কিছুক্ষণ পরই আমরা টের পেলাম, গুহার সাদা গুঁড়োর প্রলেপ আমাদের চামড়ায় আস্তে আস্তে অস্বস্তিকর এক চুলকানি তৈরি করছে এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে হাতে, মুখে—অর্থাৎ শরীরের যেসব অংশে ওই ধাতুর প্রলেপ পড়েছে, সেসব জায়গায় গুঁড়ি গুঁড়ি ফোসকা উঠে ভরে গেল। ফলে সমতলে ফিরে এলেও আমাদের সুস্থ হয়ে ফিরতে ফিরতে পুরো এক মাস কেটে গেল। ওই সময়টুকু আমরা বাধ্য হয়েই কেউজান প্রোর আতিথ্য নিতে বাধ্য হলাম।

বড়োচ্চুর মতে, ওই গুহায় আরও কিছু সময় থাকলে আমাদের অবস্থা হতো ওই বাদুর বা সাপের মতোই, পুরো ত্বক ঢাকা পড়ে যেত ওই ধাতুর প্রলেপের নিচে, তারপর শেষ প্রতিক্রিয়া হয়তো হতো ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু।

ফেরার আগে আগুনের পর ধবলগিরির অবস্থা কী হয়েছে দেখার জন্য গিয়ে আমরা আবিষ্কার করলাম: গুহাটা পুরোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তার জায়গায় শুধু ক্ষতের মতো খাড়া পর্বতের একটা পাথুরে ঢাল দাঁড়িয়ে আছে। বড়োচ্চুর ওই ওরিকালকুম না কী ধাতু, তার খনি ওখানে থেকে থাকলেও অগ্নিকাণ্ডের পর সবটাই পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে, কিংবা কিছু অবশিষ্ট থাকলেও তার অস্তিত্ব এখন আর বোঝার কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতে কখনো যদি কোনো বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, তাহলে যদি ওই ওরিকালকুমের ভান্ডার আবার উন্মোচিত করে নিজেকে।

[এখানে ব্যবহৃত ওরিকালকুম নামের যে ধাতুর কথা এসেছে, তার ধারণা পেয়েছি গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘ক্রাইতিয়াস’ রচনায় বর্ণনা করা আটলান্টিস নগরীর ধারণা থেকে। আরেক ধাতু মিথরিলের উল্লেখ আছে জে আর আর টলকিনের ফ্যান্টাসি জগতে, তাঁর রচিত মিডল-আর্থে: লেখক]

অলংকরণ: আসিফুর রহমান