বই পড়া

ফেব্রুয়ারি এলেই মনটা কেমন আনচান করে ওঠে। একে তো ঘোর বসন্ত, তার ওপর ভাষার মাস। আমার প্রিয় মাস। বইমেলার মাস। প্রকাশকদের ব্যস্ততা। আমারও ব্যস্ততা। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকি। এর মাঝে বই ছাড়া আলাদা কোনো লেখা লিখতে গেলে চাপটা আরও বাড়ে। তবু কিশোর আলোর অনুরোধ এড়াতে পারি না। এড়ানোর ইচ্ছেও নেই। কিন্তু কী লিখব? ভাবলাম, যেহেতু বইমেলার মাস, গল্পের বই পড়া নিয়েই কিছু বলা যাক। না, উপদেশের কচকচানি নয়। আমার ছোটবেলার একটা ছোট্ট ঘটনা।

আমাদের ওই সময়টায় বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে বই পড়ার রেওয়াজ ছিল। প্রায় সবার ঘরেই কিছু না কিছু বই থাকতই। কারও ঘরে তো আলমারি ভর্তি বই। যাদের আলমারি ভর্তি থাকত না, তাদের আলমারির অন্তত একটা তাক খালি করে তাতে রাখা হতো বই। বই তখন মধ্যবিত্তের আভিজাত্যের প্রকাশ।

আমরা তখন ফেনীতে থাকি। প্রাইমারিতে পড়ি। সম্ভবত ক্লাস ফোর কি ফাইভ। স্কুলটা অনেক বড়। যেহেতু প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউ, প্রতিবছরই একটা বিশেষ সময় শিক্ষকতার ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ছাত্ররা আসতেন, যাঁরা ভবিষ্যতে শিক্ষক হবেন। তাঁদের অনেকের কাছে অনেক গল্পের বই থাকত, ইচ্ছে করেই সঙ্গে নিয়ে আসতেন, আমাদের পড়তে দেওয়ার জন্য। তারপর পরীক্ষা নিতেন, ওই বইটা থেকে আমরা কি শিখলাম। এটাও তাঁদের ট্রেনিংয়ের একটা অংশ।

পিটিআইতে একটা মাঝারি আকারের লাইব্রেরি ছিল। টিফিন পিরিয়ডে সেখানে বসে গল্পের বই, পত্রপত্রিকা পড়া যেত। তবে লাইব্রেরিতে বসে পড়ার সময় তেমন পেতাম না। কারণ, আমাদের বাসাটা ছিল পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটার দূরত্বের মধ্যে। ঘণ্টা বাজলেই দৌড়ে বাসায় চলে যেতাম। ভাত খেয়ে ফিরে এসে আর লাইব্রেরিতে ঢোকার সময় থাকত না। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে যেত। তবে যে কয়েক মিনিট সময় পেতাম, লাইব্রেরিতে ঢুকে বিশাল টেবিলে ফেলে রাখা কিছু বই আর পত্রপত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। তবে বেশির ভাগ সময়ই হতাশ হতাম। কারণ, সেই সময়টায় বড়দের পত্রিকারই অভাব ছিল, বাচ্চাদের কথা ভাববে কে? আর ঢাকায় যা বেরোত, তার সংখ্যা ছিল খুবই কম, সুদূর ফেনীর একটা স্কুলে গিয়ে পৌঁছানো বেশ কঠিন ছিল। ‘সুদূর ফেনী’ বললাম, তার কারণ, তখনকার দিনে যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল খুব সীমিত, এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে তো ঢাকা থেকে ফেনী যাওয়া রীতিমতো একটা অভিযান। আমাদের পড়ার উপযোগী যা কিছু পত্রিকা বা বই আসত, তার প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ ভারতের কলকাতা থেকে।

ছাপার অক্ষরের প্রতি আমার ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। আমার মজা লাগা বা আনন্দ পাওয়ার মতো কিছু না হলেও হাতের কাছে যা পেতাম, তা-ই পড়তাম। স্কুলের সেই লাইব্রেরিতে কয়েক আলমারি বই ছিল। মধুলোভী মৌমাছির মতো সেই আলমারিগুলোর সামনে ঘুরে বেড়াতাম। কাচের ভেতর দিয়ে তাকে সাজানো বইগুলো দেখতাম। অনেক বইই ছিল ছোটদের উপযোগী, আমাদের পড়ার মতো, কিন্তু হাত লাগাতে পারতাম না। আলমারিতে তালা দেওয়া থাকত। ওসব বইয়ে হাত লাগানোর সুযোগ একদিনই পাওয়া যেত, সেটা শনিবার। সেদিন হাফ স্কুল। রোববার সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবারে শেষ ঘণ্টা পড়ার পর বইপড়ুয়া পাঠকের দল লাইব্রেরিতে ঢুকত, আমি তো অবশ্যই যেতাম। সেখানে ‘লাইব্রেরিয়ান স্যার’ থাকতেন, প্রত্যেক ছাত্রকে একটা করে বই দিতেন, বইটা পড়ে সোমবার সকালে এসে আবার জমা দিতে হতো। সময়মতো জমা দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হতো।

সারা সপ্তাহ লাইব্রেরিতে ঘুরে আলমারির ভেতর রাখা বইগুলো দেখতাম, আর মনে মনে বাছাই করতাম আসছে শনিবার আমি কোন বইটা নিতে চাই। একদিন একটা বই দেখে ধড়াস করে উঠল বুক। বইটা নতুন এসেছে। নাম ‘আফ্রিকার জঙ্গলে’। বুঝলাম, শিকার কাহিনি। কিংবা জন্তু-জানোয়ারে গল্প। সেকালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ছিল না, ডিসকভারি চ্যানেল ছিল না, আফ্রিকার কথা শুনলেই বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হতো। গল্পের বইতে তথ্য যা থাকত, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যেত না। আফ্রিকায় অ্যাডভেঞ্চারের ওসব গল্প পড়ে শুধু জানতাম, ওটা অন্ধকারের দেশ, যেখানে হিংস্র সিংহ, হায়েনা, জলহস্তী, গরিলা আর লম্বাগলা জিরফের মতো অদ্ভুত সব প্রাণী বাস করে। গভীর জঙ্গলে বাস করে নরখাদক মানুষ। এসব গল্প আমার ভীষণ ভালো লাগত। তাই নতুন বইটা দেখে উত্তেজনায় প্রায় কাঁপতে শুরু  করলাম। হাতে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। কিন্তু সেদিন মোটে সোমবার। পুরো সপ্তাহটা অপেক্ষা করতে হবে।

সময় আর কাটে না। একটা করে দিন যায়, আর মনে হয় বছর পেরোল। এমনি করে করে এল আমার সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত দিন, শনিবার। একটা করে ঘণ্টা পড়ে আর ভাবি, কখন শেষ ঘণ্টা বাজবে।

সময় তো থেমে থাকে না। তাই শেষ ঘণ্টাও বাজল। বইখাতা আগেই গুছিয়ে রেখেছি। থাবা মেরে তুলে নিয়ে টিচার বেরোনোর আগেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দৌড়ে চলে এলাম লাইব্রেরিতে। দূর! দরজা বন্ধ! লাইব্রেরিয়ান স্যার আসেননি! তবে কি তিনি আজ আসবেন না? বুকের মধ্যে দুরুদুরু শুরু হয়ে গেল। এক এক করে আসতে লাগল বইপড়ুয়া ছেলেমেয়ের দল। সবাই ভিড় করতে লাগলাম দরজার কাছে। তাকিয়ে রইলাম টিচারদের কমনরুমের দিকে।

অবশেষে আমার দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিয়ে দরজা দিয়ে বেরোলেন লাইব্রেরিয়ান স্যার। তারপর ভারিক্কি চালে হেলেদুলে পান খেতে খেতে বারান্দা ধরে এগিয়ে আসতে লাগলেন। কাছে এসে পিচিক করে বারান্দার নিচের ফুলবাগানের সবুজ ঘাসের ওপর একদলা পানের পিক ফেলে বললেন, ‘কী, এসে গেছিস তোরা।’ ধীরে-সুস্থে তালা খুললেন। সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।

লাইব্রেরিয়ান স্যারের বই দেওয়ার কায়দাটা বিচিত্র। শনিবার দিন সকালে, বিশাল লম্বা টেবিলে আগে থেকেই অনেক বই স্তূপ করে রাখেন। সেই টেবিল ঘিরে দাঁড়ায় ছেলেমেয়েরা। একটা করে বই হাতে তুলে নেন তিনি। জিজ্ঞেস করেন, ‘কে নিবি?’

আকর্ষণীয় বই হলে বহু কণ্ঠে জবাব আসে, ‘আমি নিমু, স্যার।’

মুখ তুলে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন, কে আগে বলেছে। আন্দাজে বুঝে নিয়ে হাতের ইশারা করেন, ‘আয়।’

স্যারের ভুল হলে আসলে যে প্রথম বলেছিল সে ক্ষোভে ফেটে পড়ে, ‘আমি আগে নিমু বলছিলাম, স্যার।’

নির্বিকার ভঙ্গিতে স্যার বলেন, ‘পরের সপ্তায় নিস।’ তারপর যাকে তিনি বইটা দেবেন স্থির করেছেন, তার হাতে বই দিয়ে একটা রেজিস্টারে বইয়ের নাম আর যে নিচ্ছে তার নাম লিখে পাশে সই করিয়ে নেন। তারপর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘সোমবারে ফেরত দিবি। নইলে চাইর আনা ফাইন। মনে আছে তো?’

সবাইকে একই কথা বলেন, প্রতিবারেই বই নেওয়ার সময়।

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছি আমি। আগেই দেখে নিয়েছি বইয়ের স্তূপের মধ্যে  আফ্রিকারজঙ্গলে বইটা আছে কি না। ধরেই নিয়েছি, ওটা নেওয়ার জন্য সারা স্কুল অস্থির হয়ে আছে। প্রচণ্ড শঙ্কিত হয়ে ভাবছি, এতজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পারব তো? স্যারের করুণা আমার ওপর পড়বে তো? নাকি ভুল করে অন্যকে দিয়ে দেবেন?

এক এক করে বই দেওয়া হচ্ছে, আর কাঙ্ক্ষিত বইটি পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। আমার বইটি যেন আর আসেই না। তাকিয়ে আছি।  দস্যুবাহরাম-এর নিচে রয়েছে আমার বইটি।

আলগোছে  দস্যুবাহরাম তুলে নিয়ে বললেন তিনি, ‘কে...?’ নিবি বলার আর সময় পেলেন না। তার আগেই ফেটে পড়ল যেন সমস্ত ঘর। ‘আমি নিমু, স্যার।’

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন স্যার। বুঝতে পারলেন না কে আগে বলেছে। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আগে কইছস?’

‘আমি, স্যার,’ সবাই যার যার বুকে থাবা মেরে জবাব দিল।

মুখ তুলে সবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন তিনি, কে আগে বলেছে। আন্দাজেও কিছু বুঝতে পারলেন না। হাতের ইশারায় একজনকে ডাকলেন, ‘আয়।’

হাসিমুখে এগিয়ে গেল ভাগ্যবান ছেলেটি।

বাকি সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি আগে বলছিলাম, স্যার।’

নির্বিকার ভঙ্গিতে স্যার বললেন, ‘পরের সপ্তায় নিস।’ তারপর যাকে তিনি বইটা দেবেন স্থির করেছেন, তার হাতে বই দিয়ে একটা রেজিস্টারে বইয়ের নাম আর ছেলেটার নাম লিখে পাশে সই করিয়ে নেন। তারপর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে সেই একই কথা, ‘সোমবারে ফেরত দিবি। নইলে চাইর আনা ফাইন। মনে আছে তো?’

রেজিস্টারে সই করে গর্বিত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল  দস্যুবাহরাম পাওয়া ছেলেটি, যেন বিশ্ব জয় করেছে।

নিজের মুখটা দেখতে না পেলেও আমি জানি আমার মুখ কালো হয়ে গেছে। কারণ  দস্যুবাহরাম-এরই যদি এত চাহিদা হয়,  আফ্রিকারজঙ্গলের কী হবে, বুঝে গেছি। আমার বিশ্বাস, ঘরের প্রত্যেক ছেলেমেয়ের নজর এখন ওই বইটার দিকে। কাজেই ওটা হাতে পেতে মাসের পর মাসও অপেক্ষা করতে হতে পারে আমাকে। মনে মনে দমে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

দস্যু বাহরাম দেওয়ার পর একটু অপেক্ষা করলেন স্যার। উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে থুহ্‌ করে পানের ছিবড়ে ফেলে এলেন। তারপর চেয়ারে বসে একটা বইয়ের দিকে হাত বাড়ালেন, অন্য স্তূপের আরেকটা বই,আফ্রিকার জঙ্গলে নয়। সহ্য করতে পারলাম না। বললাম, ‘এখন ওই বইটা দেওয়ার কথা।’

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন স্যার। তারপর বললেন, ‘ও, হ্যাঁ, ভুল হয়ে গেছে।’ বইটা তুলে নিলেন। উল্টেপাল্টে দেখলেন। বিশেষ পছন্দ হলো বলে মনে হলো না তাঁর। তারপর সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে এনে দৃষ্টি স্থির হলো আমার ওপর, ‘কে নিবি?’

বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম, এত জোরে, যেন সবার ওপর দিয়ে আমার গলা ছাপিয়ে যায়। ‘আমি নিমু, স্যার!’ অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আর একটি কণ্ঠও বইটি নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল না। টুঁ শব্দও করল না কেউ। বরং দু-চারজন এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাতে লাগল, যেন আমি একটা ছাগল। বোকার মতো একটা পচা বই নিয়েছি।

‘এত জোরে চেঁচালি কেন?’ স্যার জিজ্ঞেস করলেন।

‘কেউ যেন আমার আগে নিতে না পারে,’ জবাব দিলাম।

মুচকি হাসলে স্যার। ‘কই, কেউ তো চাইলই না। ঠিক আছে, আয়।’

স্যারের কাছ থেকে বইটি নিলাম। হাতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। সারা সপ্তাহের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না—বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমন দুর্দান্ত একটা বই পেয়ে গেছি। টেবিলের কাছে থেকে সরে গিয়ে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকালাম। কারও নজর নেই আমার দিকে। ওদের নজর টেবিলের বইয়ের দিকে।

সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম, গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি কী পরিমাণ আগ্রহ পাঠকের। শিকারের গল্প, কিংবা জন্তু-জানোয়ারের প্রতি কিছু মানুষের অসামান্য আকর্ষণ আছে বটে, তবে তার সংখ্যা খুবই কম। সেটা এই ছেষট্টি বছর বয়েসেও বুঝতে পারছি—পৃথিবীসেরা কিছু শিকারের গল্প আর জন্তু-জানোয়ারের ওপর লেখা বই নিজে অনুবাদ করে।

শিকারের গল্পের পাঠক কম, পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণিকুলকে জানার আগ্রহ কম, তাতে অবশ্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই। সবারই সব বিষয় ভালো লাগবে—এমন কোনো কথা নেই। বরং আমি খুশি হব, শান্তি পাব, যদি দেখি এ দেশের বিপুলসংখ্যক বইবিমুখ মানুষ বইমুখো হয়, সেটা যে বইই হোক। শুধু পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে থাকলে পরীক্ষায় ভালো ফল হয়তো করা যাবে, মগজ বিকশিত হবে না। বইয়ের মতো ভালো বন্ধু পৃথিবীতে আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। যতই মোবাইলে গেম খেলে আর চ্যাটিং করে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করা হোক, লাভ হবে না। বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। আশার কথা, ইদানীং কেউ কেউ ই-বুকের সাহাযে্য মোবাইলপ্রেমিকদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। দেখা যাক, তাঁরা কতখানি সফল হন।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী