ঘোরাঘুরি. . .

তোমাদের অনেকের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ঘোরাঘুরির জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর হয়! বন্ধুরা মিলে বা পরিবারের সদস্যরা মিলে বেরিয়ে পড়তে পারো সুন্দর এই দেশটাকে দেখার জন্য। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় পড়োনি—থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগত্টাকে। ঘোরাঘুরির জন্য তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হলো। আর কয়েকজন বন্ধু মিলে হলে তো কথাই নেই। কিন্তু বাসা থেকে অনুমতি নিতে ভুলো না যেন! চলো, আজ তোমাদের বলি আমার দেখা দেশের সুন্দর কয়েকটি জায়গার কথা—

কান্তজিউ মন্দির

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে ১২ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা শুরু হয়। যেখানে বিদেশি দূতাবাসগুলোও স্টল বা প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে নিজ নিজ দেশে প্রকাশিত বইয়ের প্রদর্শনী করে থাকে। ২০১৭ সালে এই মেলায় বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নটি ছিল কান্তজিউ মন্দিরের আদলে নির্মিত। উত্তরবঙ্গের জেলা দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কান্তজিউ মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঢেঁপা নদী। কান্তজিউ মন্দিরকে অনেকেই কান্তনগর মন্দির বা নবরত্ন মন্দিরও বলে থাকে। নবরত্ন মন্দির বলার কারণ হলো মন্দিরটির ৯টি চূড়া বা শিখর ছিল। কিন্তু তা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে যায়।

১৫ হাজারের মতো টেরাকোটা টালি আর সুনিপুণ কারুকাজগুলো মন্দিরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। এখানে প্রতিনিয়ত ভিড় লেগেই থাকে দর্শনার্থীদের। রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানকার পোড়ামাটির ফলকে। এ ছাড়া কান্তজিউ মন্দিরের পাশেই শিবমন্দির ও কান্তজিউ রাসবেদি রয়েছে। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে দিনাজপুর পৌঁছে সহজেই যেতে পারবে কান্তজিউ মন্দির দেখতে। 

ষাটগম্বুজ মসজিদ

মসজিদের শহর বাগেরহাটের পুরোনো নাম ছিল খলিফাতাবাদ। তুর্কি সেনাপতি খান-ই-জাহান শহরটি গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মধ্যে একটি এটি। বাগেরহাট শহরটিকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ১৯৮৩ সালে। ইউনেসকো এ সম্মান প্রদান করে। এই শহরের অন্যতম একটি আকর্ষণ হলো ষাটগম্বুজ মসজিদ।

বিশাল এ মসজিদের সৌন্দর্য বর্ণনা দিয়ে প্রকাশ করা সহজ নয়। তবে এর নাম ষাটগম্বুজ মসজিদ হলেও গম্বুজ সংখ্যা ৬০টি নয়, বরং তা ৭৭টি। যার মধ্যে ৭০টির উপরিভাগ গোলাকার। আর বাকি ৭টি গম্বুজ দেখতে অনেকটা চৌচালা ঘরের চালের মতো। আবার মিনারে গম্বুজ রয়েছে আরও ৪টি। এ হিসাবে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১টি। তবু এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। মসজিদের নামকরণ নিয়েও বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত রয়েছে। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ৭টি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের ৭ গম্বুজ এবং তা থেকে ষাটগম্বুজ হয়েছে। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, গম্বুজগুলো ৬০টি প্রস্তর নির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই নাম ষাটগম্বুজ হয়েছে।

বাগেরহাটে ৯ গম্বুজ মসজিদ, ৬ গম্বুজ মসজিদ, সিংগরা মসজিদ, খানজাহানের সমাধির মতো আরও অনেকগুলো নিদর্শন রয়েছে। তাই আর দেরি কী! খুলনা হয়ে সহজেই হাজির হতে পারো বাগেরহাট জেলায়।

নাপিত্তাছড়া ট্রেইলস: কুপিকাটাকুম, মিঠাছড়ি এবং বান্দরকুম ঝরনা

প্রথমবার নাপিত্তাছড়ার কথা শুনে অনেকেই ভাবতে পারো যে এটি ঝরনার নাম। কিন্তু আসলে তা নয়। নাপিত্তাছড়া একটি ঝিরিপথ, যেটি দিয়ে যাওয়ার পথে কুপিকাটাকুম, মিঠাছড়ি, বান্দরকুম বা বান্দরিছড়া ঝরনাগুলো পাওয়া যায়। নাপিত্তাছড়ার অবস্থান চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। বাসে বা গাড়িতে নদুয়ারহাটে নেমে হেঁটে যেতে হয় ঝরনা দেখতে।

ঝিরিপথ দিয়ে যাওয়ার পথের প্রথম ঝরনাটি হলো কুপিকাটাকুম। এটির সামনের অংশের গভীরতা বেশি, পানিও ঠান্ডা থাকে সাধারণত। ভয়ংকর গর্জনে যেভাবে পানি পড়ে তাতে ভয় পেয়েও যেতে পারো। এরপর আধা ঘণ্টা হাঁটলে পেয়ে যাবে মিঠাছড়ি ঝরনাটি। এটিতে পৌঁছাতে ছোট একটি পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। এ সময় সতর্ক থাকা ভালো। যদি সঙ্গে গাইড নেওয়া যায়, তবে আরও বেশি ভালো হয়। মিঠাছড়ির পানি ওপর থেকে পড়ার সময় দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে।

সর্বশেষ ঝরনাটি হলো বান্দরকুম। এটির উচ্চতা অন্যগুলোর তুলনায় বেশি। এ কারণে বেশ ওপর থেকে পানি পড়া দেখতে ভালো।

শালবন বিহার

কুমিল্লা জেলার ময়নামতি শালবন বিহারের কথা নিশ্চয় তোমরা বইয়ে পড়েছ অনেকেই। কুমিল্লার কোটবাড়ীর কাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এর অবস্থান। ঢাকা থেকে সহজেই বাসে বা ট্রেনে যাওয়া যায় কুমিল্লা।

শালবন বিহারটির আশপাশে একসময় শাল-গজারির বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ করা হয়েছিল শালবন বিহার। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এটি নির্মাণ করেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিহারটির নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়। বিহারটি আসলে চৌকাকৃতির। বিহারটি দেখার পর প্রথম প্রশ্নটি তোমার মনে আসতে পারে যে শত শত বছর আগে নির্মিত এই বিহার কীভাবে এত নিখুঁত ও সুন্দরভাবে তৈরি করেছিলেন তাঁরা?

১৫৫টি কক্ষসংবলিত এই বিহারের প্রতিটি কক্ষে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। সেখানে দেব-দেবীর মূর্তি, প্রদীপ রাখা হতো। কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন এবং বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন। এসব নিদর্শন নিজে চোখে দেখতে হলে ঘুরে আসতে হবে শালবন বিহার।

শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ও লালন শাহ মাজার

শিলাইদহ কুঠিবাড়ির অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে কুমারখালী উপজেলায়। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ সালে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে এ অঞ্চলে আসেন। এখানকার পুরো ভবনটি এখন জাদুঘর হিসেবে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরের ১৬টি কক্ষে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ধরনের ছবি রয়েছে। রয়েছে তাঁর শিল্পকর্ম এবং ব্যবহার্য বিভিন্ন আসবাব। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোটের আদলে নির্মিত একটি বজরা আছে কুঠিবাড়ির দিঘিতে। এই বজরাতেই বসে বসে তিনি করেছেন বিখ্যাত কিছু রচনা। 

একই জেলার ছেঁউড়িয়ায় রয়েছে লালন শাহের মাজার বা আখড়া। কুঠিবাড়ি থেকে এই আখড়ার দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি নয়। এই আখড়াতেই লালন তাঁর শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে লালন শাহের যোগাযোগ ছিল। তিনি ছিলেন বিরাহিমপুর পরগনার ঠাকুর পরিবারের জমিদারির প্রজা। ছেঁউড়িয়ায় প্রতিবছর মার্চের ১১-১৩ তারিখ আর অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখ (তিরোধান দিবস) লালন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সারারাত চলে গানের আসর। আখড়া যেন প্রাণ ফিরে পায়। পুরো আখড়াবাড়িকে সাজানো হয় বিভিন্ন সাজে। মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন রকমের জিনিস। কুষ্টিয়া শহর থেকে সহজে যাওয়া যায় লালনের আখড়ায়।

শেরপুরের গারো পাহাড়

ঘন বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার অংশবিশেষ। যার কিছু অংশ ভারতের আসাম ও বাংলাদেশের নালিতাবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত। একে ঘিরেই জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের উদ্যোগে এখানে তৈরি হয়েছে ‘গজনী অবকাশ কেন্দ্র’ ও ‘মধুটিলা ইকোপার্ক’সহ বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র। ঢাকা থেকে বাসে শেরপুরে পৌঁছে রিকশা বা অটোতে পৌঁছানো যায় গারো পাহাড়। তবে রিকশায় গেলে আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশি উপভোগ করা যায়। শেরপুরের ৩৫ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে রয়েছে গারো পাহাড়ের অবস্থান। এসব টিলায় শত শত বছর ধরে বাস করছে নৃগোষ্ঠীর নানা সম্প্রদায়ের মানুষ।

উল্লেখিত স্পট দুটিতে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ারসহ বিভিন্ন রকমের বিনোদনের ব্যবস্থা। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ভিড় করে এখানে। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে দেখে আসতে পারো শেরপুরের গারো পাহাড়ের সেই সৌন্দর্য।  

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় কমবেশি ঘুরে দেখার মতো সুন্দর জায়গা রয়েছে। আর সেসব জায়গা সম্পর্কে লিখে শেষ করা সহজ নয়। তাই আর দেরি না করে চলো বেরিয়ে পড়ি আজই, সুন্দর এই দেশটাকে না দেখে বাসায় বসে থাকা কি ঠিক হবে!