শিখর হিমাদ্রির হাতছানি

সবুজ পাহাড়ঘেরা নেপালের ছোট্ট ছোট্ট গ্রামের সারি। অধিকাংশ সময় পাহাড়ের চূড়াগুলো ঝকঝকে সাদা বরফে ঢাকা থাকে। বরফে মোড়া চূড়াগুলোর কাছ থেকে উঁকি দেয় মাউন্ট এভারেস্ট, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। নেপালের উত্তর-পূর্ব অংশের এমনই এক গ্রামে ১৯১৪ সালের মেতে চমরি গাইপালক খাংলা মিংমার ঘরে জন্ম হয় নামগিয়াল ওয়াংগি নামের এক ছেলের। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে নামগিয়াল ১১তম।

ছোটবেলা থেকেই বরফে মোড়া পাহাড়চূড়ার ফাঁক দিয়ে সাগরমাথার (নেপালিরা এ শৃঙ্গকে ডাকে সাগরমাথা বা আকাশের দেবী নামে) দিকে অবাক তাকিয়ে থাকতেন নামগিয়াল। তাঁকে যেন হাতছানি দিত চূড়াটা। রোমাঞ্চের নেশায় কৈশোরেই নামগিয়াল বাড়ি থেকে পালিয়ে যান কাঠমান্ডু। ছয় সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরে আবার পালালেন ছেলেটি। এবার দার্জিলিং। বাবা-মা রেগে নামগিয়ালকে পাঠিয়ে দেন থিয়াংবোচে গুম্ফায়। দুরন্ত ছেলেটা যাতে গুম্ফায় পাঠ নিয়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হতে পারে, এ ছিল লক্ষ্য।

কিন্তু সন্ন্যাসী হওয়ার কোনো ইচ্ছে দেখা গেল না ছেলেটির মধ্যে। গুম্ফা ছেড়ে নামগিয়াল পাকাপাকিভাবে দার্জিলিংয়ে তুং সুং শেরপা বস্তিতে থাকতে লাগলেন। ছেলেবেলায় যে সাগরমাথা তাঁকে হাতছানি দিত, ঠিক করলেন সেখানে তাঁকে যেতেই হবে। তাই নামগিয়াল শুরু করলেন মালবাহকের কাজ। ১৯৩৫ সালে এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ পর্বতারোহী এরিক শিপটন। মালবাহক আর শেরপা বাছাইপর্বে হঠাত্ ভিড়ের মধ্যে তাঁর নজর পড়ে এক হাসিখুশি মুখ। পাকা জহুরির মতো পলকে তিনি চিনে নেন নামগিয়ালকে, যাঁকে সবাই চেনে তেনজিং নোরগে নামে।

১৯৩৫ সালে শুরু হলো লাগাতার এভারেস্ট অভিযান। শুরুতে তেনজিং ছিলেন মালবাহক। কিন্তু প্রথম অভিযানেই নিজের জাত চেনালেন তিনি। মালবাহক থেকে ধীরে ধীরে পর্বতারোহী হয়ে গেলেন রাতারাতি। বছর কয়েক নানা দলের সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর পাহাড় অভিযান। কিন্তু বারবার চেষ্টাতেও কেন যেন তেনজিংয়ের ভাগ্য এভারেস্ট জয় মিলছিল না। একবার এভারেস্টের চূড়ার মাত্র ৭৭৮ ফুট দূর থেকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। ঘটনাটা ১৯৫২ সালের। সেবার সুইজারল্যান্ডের লম্বেয়ারের সঙ্গে অভিযানে ছিলেন নোরগে। চূড়ার একেবারে কাছে পৌঁছে হঠাত্ লম্বেয়ারের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাই এভারেস্ট জয়ের চেয়ে লম্বেয়ারকে ক্যামেপ ফিরিয়ে আনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তেনজিং। এ বিফলতা দমাতে পারেনি তাকে! পরের বছরই নতুন এক দল এল এভারেস্ট জয়ের আশায়। তিনিও যোগ দিলেন সেই দলে। এবার            তাঁর সপ্তমবারের মতো এভারেস্ট জয়ের প্রয়াস! এ দলে এডমন্ড পার্সিভাল হিলারি নামের এক অভিযাত্রীও ছিলেন। তিনি আগেও একবার এভারেস্ট ওঠার অভিযানে ব্যর্থ হন।

প্রথম এভারেস্ট জয় অভিযানের ৩৪ বছর আগে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ১৯১৯ সালের ২০ জুলাই জন্মেছিলেন হিলারি। পেশায় মধু ব্যবসায়ী এই কিউই ভদ্রলোক অভিযানের সময় দুর্ঘটনায় বরফের খাদে পড়ে যান। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি ও দ্রুত প্রচেষ্টায় মৃত্যুর মুখ থেকে হিলারিকে ফিরিয়ে আনেন তেনজিং। সেদিন থেকেই তেনজিংয়ের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হিলারি। এরপর হিলারি আর তেনজিং একই দড়িতে এভারেস্ট বিজয়ের সহযোগী হিসেবে নতুন উদ্যমে অভিযান শুরু করলেন।

এভারেস্ট অভিযানের বেস ক্যাম্প তৈরি হয় খুম্বু হিমবাহের নিচে। এখান থেকেই শুরু পরবর্তী ক্যাম্প তৈরির কাজ। প্রায় এক হাজার পাউন্ডের মালপত্র নিয়ে মালবাহকেরা ধীরে ধীরে এভারেস্টের দিকে এগোতে থাকেন। মে মাসে নেপাল অংশের ২৫ হাজার ৯০০ ফুট ওপর তৈরি হয় সামিট ক্যামপ। ২৬ হাজার ফুট থেকে শুরু এভারেস্টের ‘ডেথ জোন’। এখান থেকেই এভারেস্ট জয়ের মূল অভিযান চলে। ওই দিনের আগ পর্যন্ত আবহাওয়া মোটামুটি ভালোই ছিল। কিন্তু সামিট ক্যামপ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া গেল বিগড়ে। শুরু হলো তুষারঝড়। ঝামেলায় পড়লেন অভিযাত্রীরা।

২৬ মে আবহাওয়া একটু ভালোর দিকে আসতেই অভিযানের ডেপুটি লিডার ইভান, তাঁর সঙ্গী বরিলিয়ানকে নিয়ে অন্তিম যাত্রা শুরু করলেন চূড়ায় পা রাখতে। ধরে নেওয়া হলো এবার জয় নিশ্চিত। এভারেস্ট মানুষের পায়ের নিচে মাথা নোয়াবেই! কিন্তু ভাগ্যদেবতা বোধ হয় অলক্ষ্যে মুখ টিপে হেসেছিলেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার গোলমাল করায় চূড়ার মাত্র ৩০০ ফুট নিচ থেকে ফিরে এলেন ইভান। এবার পাঠানো হলো তেনজিং আর হিলারিকে। কিন্তু চরম বাজে আবহাওয়ায় দু-তিন দিন সামিট ক্যামেপই বন্দী রইলেন দুজন।

১৯৫৩ সালের ২৮ মে দলটি অভিযানের ২৭ হাজার ৮০০ ফুট উঁচুতে ৮ নম্বর শিবির ফেলল। কিন্তু আবহাওয়া আবার খারাপ হয়ে উঠল। শুরু হলো প্রচণ্ড বাতাস, অসহ্য শীত ও তুষারপাত। গোটা এলাকা নিমেষেই বরফের কুচিতে ভরে গেল।  এ বিরূপ প্রকৃতি, প্রচণ্ড শীত, বাতাস ও তুষারপাতে অতিষ্ঠ অভিযাত্রী দল ঘুমাতেও পারল না। তবে অভিযান বন্ধ করলেন না তাঁরা। অভিযাত্রীরা পরসপরের কোমরে দড়ি বেঁধে খুব সাবধানে ও ধীরে ধীরে ভয়ংকর পথে এগোতে লাগলেন। সামান্য পা পিছলে গেলেই অবধারিত মৃত্যু; মুহূর্তে গিলে নেবে শত শত ফুট নিচের বরফের খাদ! কিন্তু অদম্য অভিযাত্রীদের থোড়াই কেয়ার ফুঁসে ওঠা এ প্রকৃতিকে। কৌশল ও ধৈর্যের বলে অভিযানের শেষ ঘাঁটি হিসেবে অভিযাত্রী দল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও উঁচুতে পৌঁছে ৯ নম্বর শিবির ফেলল। এখন এভারেস্টশৃঙ্গের দূরত্ব মাত্র ৮৮০ ফুট। এটুকু পেরোতে পারলেই উদিত হবে বিজয়ের সূর্য।

এভারেস্ট অভিযানে বিশেষ মুহূর্তে এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে
এভারেস্ট অভিযানে বিশেষ মুহূর্তে এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে

৯ নম্বর শিবির থেকে এবার শুরু হলো এভারেস্ট বিজয়ের শেষ ও চূড়ান্ত অভিযান। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে সুন্দর ঝকমকে সকাল। শুরু হবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গের দিকে শতাব্দীর চূড়ান্ত অভিযান। এ অভিযানের যাত্রী মাত্র দুজন, এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে। দুজনেরই পিঠে বাঁধা হলো অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মুখে গ্যাস মাস্ক। কারণ, এভারেস্টের এত উঁচুতে বাতাস এতই হালকা যে তাতে অক্সিজেনের পরিমাণ এতটাই কম যে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াও অসম্ভব। এদিকে আবহাওয়ার বিপদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক বিপদ। ফুরিয়ে এসেছে অক্সিজেনের মজুত। অক্সিজেন শেষ হলে এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না; দম আটকে মরতে হবে সবাইকে।

অভিযাত্রী দল মুখোমুখি হলো চরম অনিশ্চয়তার। অক্সিজেন থাকতে থাকতেই অভিযান শেষ করে নিরাপদে নিচে নেমে আসার চ্যালেঞ্জ জড়িয়ে ধরল তাঁদের। হিলারি আর তেনজিং এগোতে শুরু করলেন চূড়ার দিকে। চূড়ার আগে বরফের একটা ঢাল চোখ রাঙিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দলের অনেকেই দাবি করলেন, এ ঢাল অতিক্রম করা অসম্ভব। কিন্তু দুঃসাহসী হিলারি-তেনজিং পিছু হটলেন না। মুখে অক্সিজেনের নতুন বোতল এঁটে দুজনে উঠতে শুরু করলেন চূড়ার দিকে। আইস অ্যাক্স দিয়ে পথের নতুন ধাপ তৈরি করতে করতে উঠে যাচ্ছিলেন হিলারি, সেই পথ অনুসরণ করতে করতে আগে বাড়ছিলেন তেনজিং। কিন্তু ঘণ্টা খানেক উঠতেই আবার বাধল বিপত্তি। ২৯ হাজার ফুট উচ্চতায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০ ফুট লম্বা এক পাথুরে দেয়াল। অতিকায় এ দেয়ালের ডানে একটা বরফের চাঙ পড়েছিল কোনো একসময়, তারপরেই পর্বত ঝাড়া ১০ হাজার ফুট নিচে নেমে খ্যাংসুং হিমবাহে পরিণত হয়েছে। চূড়ায় উঠতে হলে এটার ওপর দিয়েই উঠতে হবে। কিন্তু বরফের এ চাঙ কি ভর নিতে পারবে দুজনের? জানার একটাই উপায়, উঠতে হবে! বরফে ক্রেমপন (জুতার তলায় লাগানো কাঁটার ফ্রেমবিশেষ) ঠেসে ধরে ফাঁকফোকর খুঁজে কোনোরকমে ফাটলের চূড়ার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন দুজনে। ডান দিকে তুষার গম্বুজের মতো একটা জায়গা দেখতে পেলেন দুজনে। তার ওপর দিয়ে যাত্রা চলতেই থাকল। পাকা এক ঘণ্টা এভাবে ওঠার পরে তাঁরা অবশেষে পা রাখলেন খাঁজের এক্কেবারে মাথায়, যেটা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া।

১৯৫৩ সালের ২৯ মে, সময়টা তখন বেলা সাড়ে ১১টা। ধবধবে সাদা বরফের ওপর ইতিহাসের পদচিহ্ন আঁকলেন এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে! অর্জন করলেন পৃথিবীর উচ্চতম স্থানে পা ফেলা প্রথম গর্বিত মানুষের সম্মান। শেষ পর্যন্ত দাম্ভিক হিমালয় ঠিকই মাথা নোয়াল দুঃসাহসী মানুষের খুদে পায়ের নিচে!

এভারেস্টে বাংলাদেশ

হিলারি আর তেনজিংয়ের এভারেস্ট জয়ে দীর্ঘ ৫৭ বছর পর পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ার পা রাখেন একজন বাংলাদেশি। তিনি মুসা ইব্রাহীম। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৫ মিনিটে এভারেস্টে ওঠেন। দ্বিতীয় বিজয়ী হলেন এম এ মুহিত। তিনি ২২ মে ২০১১ সালে এভারেস্টে পা রাখেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার। ২০১২ সালের ১৯ মে সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি এভারেস্ট জয় করেন। ২০১২-এর ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন ভোর ৬টা ৪১ মিনিটে এভারেস্ট জয় করেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সী এভারেস্ট বিজয়ী। বাংলাদেশের পঞ্চম এভারেস্ট বিজয়ীর নাম সজল খালেদ। তিনি ২০১৩ সালের ২০ মে সকাল সাড়ে আটটার দিকে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। তবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের পর তিনি নেমে আসতে পারেননি সমতলে। এভারেস্ট জয় করে নামার পথে ৮ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় তিনি মারা যান।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগ ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে