ব্যাংক এল কোথা থেকে

শিবরামের সেই গল্পটা মনে আছে? সেই যে ব্যাংক নিয়ে ভয়ের কথা লিখেছিলেন। একবার তিনি ব্যাংকে ৫৬ টাকা জমা দিতে হিসাব খুলে আবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই টাকা তুলে নিয়ে এসেছিলেন। গল্পের শুরুটা ছিল এ রকম, ‘যখন আমি কোনো ব্যাংকের ভেতর পা বাড়াই, আমার মাথা ঘুরে যায়। ব্যাংকের কর্মচারীদের দেখলে মাথা ঘোরে, চাপরাসিদের তকতকে তকমার চাকচিক্য মাথা ঘোরায়, স্তূপাকার নোট আর টাকার দৃশ্যে মাথা ঘুরতে থাকে। নানা খোপে-খোপে বিভক্ত কত রকমের যে কাউন্টার—দেখলেই মাথা না ঘুরে পারে না। যতই ঘুরেফিরে দেখি, মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যা-কিছু দেখি ততই আরও মাথা ঘুরিয়ে দেয় আমার।’  

টাকা জমা আর তোলা নিয়ে শিবরামের আরেকটি গল্প তো আরও মজার। সেই যে এক কৃপণ ব্যক্তি টাকা রেখে টাকা তুলতেন না। তুললেই তো খরচ। তিনি টাকা তুলতে যেতেন, তারপর ভুল স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন চেক। কিছুতেই সই মিলত না, টাকাও তোলা হতো না তাঁর। বিদেশি আরেক গল্পে এক লোক ব্যাংকে টাকা রাখতে গিয়েছিলেন। টাকা জমা দিয়েই দেখলেন আরেকজন তাঁর জমা রাখা অর্থের সমপরিমাণই তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। লোকটি দ্রুত তাঁর টাকাটা তুলে নিয়ে সেই যে ব্যাংক ছাড়লেন, আর ফিরে আসেননি।

আমরা কথা বলছি আসলে ব্যাংক নিয়ে। আমরা পথ চলতে রাস্তার দুই পাশে ব্যাংকের অনেক শাখা দেখি। বিশেষ করে শহর এলাকায় তো চোখে পড়বেই। আজকাল ছোটরাও ব্যাংকের সেবা নিচ্ছে। চালু হয়েছে স্কুল ব্যাংকিং। এখন তো ব্যাংকে না গিয়েও ব্যাংকিং করা যায়। মুঠোফোন ও ইন্টারনেট আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে শুরু হয়েছিল ব্যাংক?

বিশ্বে ব্যাংক ব্যবসা শুরু হয়েছিল যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও আগে, গ্রিসের উপাসনালয়ে। নিরাপত্তার কারণেই উপাসনালয়গুলো ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। কিন্তু আমরা এখন যেভাবে ব্যাংকে লেনদেন করি, তা কিছুটা শুরু হয়েছিল ইতালিতে। ব্যাংকিং পদ্ধতির উন্মেষ ঘটে মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর শুরুতে। ইতালির উত্তরাঞ্চলের ধনী শহর, বিশেষ করে ফ্লোরেন্স, ভেনিস ও জেনোয়ায় ব্যাংকিং প্রথা শুরু হয়। সেখানে ইহুদি মহাজনেরা বাজারে বেঞ্চে বসে অর্থের লেনদেন শুরু করতেন। এই বেঞ্চ বা ব্যাংকো শব্দ থেকেই ব্যাংক শব্দের উত্পত্তি। তবে সেই ব্যাংক ব্যবসা কিন্তু এখনকার মতো ছিল না। তারা স্বর্ণ, রৌপ্য, অন্যান্য অলংকার, মূল্যবান জিনিসপত্র ও অর্থ নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ করত। অনেক সময় তারা টাকাপয়সা ধারও দিত। বেঞ্চের উপরিভাগ সবুজ টেবিলক্লথ দিয়ে ঢাকা থাকত। এই রং মানেই সেটি একটি ব্যাংক। কারণ, তখন তো আর আজকের মতো সাইনবোর্ডের ব্যবহার ছিল না।

ধারণা করা হয়, চতুর্দশ শতকে ইতালির ব্যাংকিং জগতে ফ্লোরেন্সের বর্দি এবং পেরুজি পরিবার ছিল ব্যাংক ব্যবসার সবচেয়ে বড় নাম। তাঁরা ব্যাংক ব্যবসা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে প্রথম যে ব্যাংক সবচেয়ে নাম করেছিল, সেটি ছিল ইতালির মেডিসি ব্যাংক। ১৩৯৭ সালে জোভান্নি মেডিসি এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করেন। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাংক, যা এখনো টিকে আছে, তার নাম মন্টে ডেই পাসচি ডি সিয়েনা। ইতালির সিয়েনায় ১৪৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি এখনো চালু।

ইতালিতে রেনেসাঁর সময়কালে ব্যাংকিং ব্যবস্থার চিত্র। ১৫৪০ সালে ‘মানি অ্যান্ড দ্য বিউটি’ শিরোনামের এই তৈলচিত্রটি এঁকেছিলেন মারিনাস ভ্যান রেমার্সওয়ালে
ইতালিতে রেনেসাঁর সময়কালে ব্যাংকিং ব্যবস্থার চিত্র। ১৫৪০ সালে ‘মানি অ্যান্ড দ্য বিউটি’ শিরোনামের এই তৈলচিত্রটি এঁকেছিলেন মারিনাস ভ্যান রেমার্সওয়ালে

আমাদের এখানে ব্যাংক এল কবে? প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ব্যবসায়ীদের পরস্পরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তথ্য রয়েছে। জানা যায়, এ সময়ে ধনীরা অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত সম্পদ পিতলের কলসিতে বা পাতিলে পুরে মাটিতে পুঁতে রাখত এবং পাত্রের গায়ে এ-সংক্রান্ত হিসাবও লিখে রাখত। এ ছাড়া সে সময়ে ঋণ নেওয়া ও সুদের বিষয় সম্বন্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা ছিল।

বাঙালিদের ব্যাংক ব্যবসা শেখান মূলত সোনার ব্যবসায়ী বা সুবর্ণ বণিকেরা। এই বণিকেরাই ছিল সবচেয়ে ঐশ্বর্য ও প্রভাবশালী। তবে সমাজের উচ্চবর্ণরা তাদের মেনে না নেওয়ায় মধ্যযুগের পর ব্যাংক ব্যবসায় অবাঙালিদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বলা হয়, বাংলার শাসক বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯) যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহের জন্য সুবর্ণ বণিকদের কাছে টাকা ধার চেয়েও পাননি। এরপর ক্ষুব্ধ বল্লাল সেন সমাজকাঠামোকে এই ব্যবসায়ীদের সমাজের নিচু পদমর্যাদা দেন। এ সময় থেকে তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকেও বঞ্চিত হয়। একপর্যায়ে তারা ব্যাংক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হারায়। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাংক ব্যবসার জন্য সবার আগে যাঁর নামটি নিতে হবে তিনি হলেন হিরানন্দ সাহু। তিনি পাটনায় এসেছিলেন ১৬৫২ সালে। তিনিই সেখানে ব্যাংক ব্যবসা শুরু করে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ঋণ দিয়েছিলেন। এই হিরানন্দ সাহুর পৌত্র ফতেহ চাঁদই ১৭২২ সালে জগত্ শেঠ উপাধি লাভ করেন। এই পরিবার ছিল এখানে ব্যাংক ব্যবসার অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হটিয়ে ষড়যন্ত্র করে যাঁরা ইংরেজদের এনেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এই জগত্ শেঠ।

তবে শেষ পর্যন্ত জগত্ শেঠদের হাতেও কিন্তু ব্যাংক ব্যবসা টিকে থাকেনি। ব্যবসাটি চলে চায় ইংরেজদের দখলে। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের কারণে পৃথিবীর সর্বত্রই ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের প্রসার বাড়তে শুরু করেছিল। বাঙালিরাও এরপর নতুন করে ব্যাংক ব্যবসা শিখতে শুরু করে। ভারতের প্রথম ব্যাংকের নাম হিন্দুস্থান ব্যাংক, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৭০ সালে। ৬২ বছর চলার পর ব্যাংকটি উঠে যায়। এরপর বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই অবিভক্ত বাংলায় বাঙালিদের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি ব্যাংক গড়ে ওঠে। তবে দক্ষতার সঙ্গে এখানে ব্যাংক ব্যবসা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে। নতুন উদ্যোক্তারা এ সময় এগিয়ে আসেন ব্যাংক প্রতিষ্ঠায়। তত্কালীন পাকিস্তানে আংশিক মালিকানায় প্রথম বাঙালিদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ব্যাংক ছিল ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এরপর আরও কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পায়। সেসব ব্যাংকে পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদেরও মালিকানা ছিল। তবে স্বাধীনতার পর এর মালিকানা চলে আসে বাংলাদেশের হাতে। ১৯৭২ সালের শুরুতে বাংলাদেশ সরকার বিদেশি ব্যাংক বাদে সব ব্যাংক জাতীয়করণ করে। তৈরি হয় সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। এরপর ১৯৭৬ সাল থেকে সরকার রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পথ থেকে সরে আসতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সাল থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা। আর এখন বেসরকারি ব্যাংকেরই আধিপত্য অর্থনীতিজুড়ে। দেশে এখন সব মিলিয়ে রয়েছে ৫৬টি ব্যাংক।