অন্য রকম অ্যাডভেঞ্চার

এক.

অতিকায় হস্তী লোপ পেয়েছে, কিন্তু টিকটিকির মতো টিকে রয়েছে অতিকায় জ্যাম! ফিকে হয়ে গেছে ঢাকাবাসীর মুখের হাসি। লিকলিকে হয়ে গেছে সুখ-শান্তির স্বাস্থ্য। শিকেয় উঠে গেছে সাধ-আহ্লাদ। এমন অবস্থায় দুই বন্ধু তাদের মৃতপ্রায় আত্মা বাঁচাতে ঠিক করল অ্যাডভেঞ্চারে বেরোবে!

পৃথিবী এগিয়ে গেছে, তবে জ্যামের মুঠো থেকে বেরোতে পারেনি। এখন মুরগির ডিম থেকে শুরু করে বরবটি-শিম উত্পাদিত হয় ফ্যাক্টরিতেও! ঘোড়া ডিম পাড়লে কেমন হতো, তা নিয়ে হয়েছে বিস্তর গবেষণা; তাই অর্ডার দিয়ে তৈরি সম্ভব বিভিন্ন সাইজের ঘোড়ার ডিমও! যা-ই হোক, একটি প্রাইভেট মহাকাশযান ভাড়া করে দুই বন্ধু ছুটল অন্য রকম অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে।

মহাশূন্যের আলো-আঁধারির মাঝে এক নির্জন অচেনা গ্রহ দেখে তারা সেখানে ল্যান্ড করার সিদ্ধান্ত নিল। বেগানা গ্রহে দুই বন্ধু নামতে যাবে, ঠিক তখনই ঘটল বিপত্তি! অতর্কিতে তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখল যুদ্ধবিমানের মতো কিছু বস্তু! দুরবিনে চোখ লাগিয়ে রাফি হাঁ। বিমানগুলোর ভেতরে কিলবিল করছে ভীষণ কুিসত প্রাণী! মিশমিশে কালো মুখ, টকটকে লাল চোখ! ইসবগুলের ভুসির মতো বিজলে মাখানো দেহ! দেহভর্তি শুঁড়গুলো সুড়সুড় করে নড়ছে! অক্টোপাসের আট পা; কিন্তু এই প্রাণীদের ক্ষেত্রে ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে! ষোলো-সতেরোটা শুঁড়রূপী পা কিলবিল করছে!

রাফি-শাফি তাদের স্পেসশিপ নিয়ে পালানোয় ব্যস্ত। বিকটদর্শন এলিয়েনগুলো বোমা মারছে তাদের হাওয়াই শিপ লক্ষ্য করে! দেখতে দেখতে শয়ে শয়ে বিমানসদৃশ বস্তু তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল! শিপ লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ! গল্প নয়, শাফির স্পেসশিপ চালানো দেখে মনে হচ্ছে সিনেমার কোনো নায়ক সব বাধা তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছে! বোমাদের পাশ কাটিয়ে, এলিয়েনদের ঘাস খাইয়ে-ঘোল খাইয়ে এগিয়ে চলেছে! ধারাভাষ্যের ভাষায় বললে বলতে হয়, ‘মহাকাশ কামড়ে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে স্পেসশিপ! একদম ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো তার গতি!’

অন্যদিকে রাফি ভয়ে অস্থির! দুজন বন্ধুর মধ্যে একজন বেশি সাহসী হলে অন্যজন হয় ভিতুর ডিম—এটাই জগতের নিয়ম! রাফির ধারণা, দানব এলিয়েনগুলোর হাতে ধরা পড়লে চ্যাংদোলা করে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করবে! শাফির সাহস ভীষণ; রাফির এমন আশঙ্কার জবাবে বলল, ‘আরে ধ্যাত্! এগুলো ভেড়া টাইপের এলিয়েন। তা না হলে ভেড়ার মতো দল বেঁধে চলত না; সিংহের মতো একলা চলত! এদের দৌড় কিলবিল করা পর্যন্তই।’

শেষরক্ষা হলো না! এক বোমা আঘাত হানল রাফি-শাফির স্পেসশিপে।

দুই.

শাফির জ্ঞান ফিরেছে। তাদের শোয়ানো হয়েছে হাসপাতালের বেডের মতো বিছানায়। কদাকার এলিয়েনগুলো উত্সুক দৃষ্টিসহ কিলবিল করছে! শাফির মাথার ওপর ড্রিল মেশিনের সুচ; বিকট শব্দে ঘুরতে ঘুরতে কপালের দিকে নেমে আসতে শুরু করল! একেই বলে পোড়া কপাল! একটু পর রাফিরও জ্ঞান ফিরল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে সে; চোখমুখে আতঙ্ক। রাফির জ্ঞান ফিরল যেন আবার অজ্ঞান হওয়ার জন্যই! ড্রিল মেশিনের সুচ ঘরঘর শব্দে কপাল ফুটো করতে নেমে আসছে দেখে তার অজ্ঞান হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু বেচারা অজ্ঞান হওয়ার আগেই ড্রিলের সুচ মাথা ফুটো করে ঢুকে গেল!

শাফি ও রাফি এখন এলিয়েনদের সব কথা বুঝতে পারছে। ড্রিল মেশিন দিয়ে অস্ত্রোপচার করে তাদের মাথায় এলিয়েনদের ভাষা বোঝার জন্য একটি ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টার চিপ ইনস্টল করা হয়েছে!

এলিয়েনগুলো বড় ভালো। শীতার্ত এলিয়েনদের শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচিতে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানোর জন্যই তারা তখন রাফি ও শাফির দিকে ছুটে যাচ্ছিল; অথচ রাফি-শাফি ভুল বুঝে পালাতে উদ্যত হলো। যান্ত্রিক মনমানসিকতার এসব এলিয়েন চিন্তা করে দেখল, কেউ পালালে লজিক অনুযায়ী তাকে ধরতে হয়! তাই তারা দুই বন্ধুকে ধরতে উদ্যত হলো। ছোড়া বোমাগুলো আসলে কিছু ধ্বংস করে না; শুধু মহাকাশযানের ভেতরের সমস্ত জীবন্ত বস্তুকে অজ্ঞান করে দেয়!

এক এলিয়েন বলল, ‘আমাদের দেখে তোমরা পালিয়েছ, বিষয়টি আমাদের মিলিমেন্টে লেগেছে।’

শাফি অবাক হয়ে বলল, ‘মিলিমেন্ট মানে কী?’

‘তোমাদের মস্তিষ্কের ডেটাবেইস পড়ে জেনেছি, তোমরা ব্যবহার করো ‘সেন্টিমেন্ট’ শব্দটি। কোনো কোনো ঘটনা তোমাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে! তেমনি অনূভূতিকে আরও সূক্ষ্মভাবে বোঝাতে সেন্টির জায়গায় মিলি ব্যবহার করেছি। তাই সেন্টিমেন্ট হয়েছে মিলিমেন্ট!’

শাফি হাসবে না কাঁদবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে, এই এলিয়েনগুলোর সঙ্গে যন্ত্রের খুব একটা পার্থক্য নেই। লজিক অনুযায়ী চিন্তা করে এরা মানুষের মতো এলোপাতাড়ি চিন্তা করে না।

রাফি বলল, ‘আমার এমন জ্বরজ্বর লাগছে কেন?’

এক এলিয়েন বলল, ‘ভাইরাল ফিভার হলে অ্যান্টিভাইরাস তো আছেই। আর যদি ভয়ে জ্বর চলে এসে থাকে, তাহলে বলতে পারি, আমরা ভয়াল কোনো প্রাণী নই। তা ছাড়া তোমরা নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে কথা বলতেই এই গ্রহে ল্যান্ড করতে চাচ্ছিলে?’

এলিয়েনের কথা শুনে রাফির ভয় কেটে গেল। ভীত মানুষ যখন ভয় পায় না, তখন সে সাহসী মানুষের চেয়েও বেশি সাহসী হয়ে ওঠে। রাফি এখন মেগা সাহসী! সে সত্যি কথা না বলে বানিয়ে বানিয়ে বলল, ‘আমার এক আত্মীয়ের ক্যানসার হয়েছে। এ যুগেও ক্যানসারের কোনো অ্যানসার নেই; মানুষ মারা যাবেই। তাই এসেছিলাম, তোমাদের কাছে এই রোগের কোনো ওষুধ আছে কি না জানতে।’

কিলবিলিয়ে এক এলিয়েন বলল, ‘তোমার ওই আত্মীয়কে ফ্যাক্টরি রিসেট দিয়ে দিলেই তো হয়!’

‘ফ্যাক্টরি রিসেট মানে?’

‘কোনো যন্ত্রকে ফ্যাক্টরি রিসেট দিলে সেটি যেমন আগের কন্ডিশনে ফিরে যায়, তেমনি মানুষকে রিসেট দিলে নিশ্চয়ই তার কোষগুলো আগের স্বাভাবিক কন্ডিশনে ফিরে যায়; ক্যানসার নামের অসুখটাও ভালো হয়ে যায়!’

রাফি মনে মনে বলল, ‘গর্দভ এলিয়েন কোথাকার!’

এলিয়েন বলল, ‘তোমাদের কাছে একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে আমরা খুব ইচ্ছুক। যদি জানাতে, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকতাম!’

শাফি জিজ্ঞেস করল, ‘কী বিষয়?’

‘আমরা যখন তোমাদের ঘিরে ফেললাম, তখন তোমরা স্পেসশিপ নিয়ে কী ক্যারিশমা করেই না এগিয়ে যাচ্ছিলে! এত ট্রান্সপোর্টের ভিড়ের মধ্যে এভাবে পাশ কাটিয়ে টেনেটুনে আগানোর পদ্ধতি কি আমাদের শেখাবে? অন্য গ্রহের এলিয়েনরা আক্রমণ করলে এই জ্ঞান আমাদের কাজে লাগবে।’

রাফি হাসিমুখে বলল, ‘ব্যাপারটা বুঝতে হবে, আমরা কোথা থেকে এসেছি! অ্যাডভেঞ্চারাস শহর ঢাকাতে তো তোমরা যাওনি। সেখানে ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে অযুত-লক্ষ গাড়ি যেভাবে এগিয়ে চলে, তা দেখলে বুঝতে আমরা এই বিশেষ জ্ঞান কোথা থেকে পেয়েছি!’

এলিয়েনগুলো নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে লাগল; যেন আকাশের চাঁদমার্কা তথ্য তারা হাতে পেয়ে গেছে! একটু পর অবাক করে দিয়ে দুই বন্ধুকে বলল, ‘তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমরা আমাদের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদলকে ঢাকা শহরের রাস্তায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে চাই।’

শাফি-রাফি হাসিমুখে বলল, ‘আপত্তি থাকবে কেন? শুভ কাজে দেরি করতে নেই!’

চোখ-কান খোলা রাখলে অ্যাডভেঞ্চারাস শহর ঢাকার রাস্তায় প্রশিক্ষণার্থী এলিয়েনগুলোর সঙ্গে আমাদেরও দেখা হয়ে যেতে পারে!

অলংকরণ: আবু হাসান