ট্রেনে বিপদ!

অলংকরণ: ষুভ

সকাল আটটা

আমার নাম আবীর। ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। আজ জীবনের প্রথম একা একা ট্রেনে উঠেছি। যাচ্ছি ছোট মামার বাসায়। সে এক অপূর্ব জায়গা! ছোট মামা চাকরি করেন বন বিভাগে। বনের একদম ঢোকার মুখে তাঁর অফিস, পাশেই বাংলো। ছবির মতোই সুন্দর! চারপাশে নাম না-জানা সব গাছপালা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায়, বারান্দায় কোনো না কোনো প্রাণী পায়চারি করছে! মামা সেই অদ্ভুত জায়গাটায় থাকেন মামি আর তাঁদের চার বছর বয়সী ছেলে নাফিসকে নিয়ে।

সকাল নয়টা

ট্রেন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। ঠিক একই গতিতে উল্টো দিকে ছুটছে জানালার ওপাশের লোকালয়, গাছপালা আর মানুষজন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে! আমার পাশের সিটে কেউ নেই। ঠিক সামনে বসে আছে অদ্ভুত চেহারার এক লোক। লোকটার পোশাক-আশাকও বিচিত্র। বিবর্ণ একটা শার্টের ওপর ধূসর বেঢপ কোট। একটা ঝাড়া দিলে মনে হয় দুনিয়ার সব ধুলো-বালুতে কামরাটা ভরে যাবে! আমার চেয়ে একটু কম বয়সী একটা ছেলে বসে আছে লোকটার পাশে। ছেলেটার চোখমুখ অসম্ভব মলিন। একবার চোখে চোখ পড়তেই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল জানালার দিকে। তারপর আবার আমাকে আড়চোখে দেখে নিল। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, ছেলেটার দুই চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার রেখা। কে জানে, কেন কেঁদেছিল! ছেলেটা কি এই লোকের কিছু হয়?

সকাল ১০টা

লোকটা আমাকে চমকেই দিল! আমার মনের প্রশ্নটা বুঝেই কি না কে জানে, গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল, ‘এ হইল আমার ভাগিনা। আপন ভাগিনা। নাম বজলু। পচা বইলা ডাকলেও মাইন্ড করে না! হে হে হে!’ লোকটা সিটে পা তুলে বসে জানতে চাইল, ‘আপনে কই যাইতেছেন?’

আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘এই তো কদমছড়ায়।’

লোকটা হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আরে, আমরাও তো ওই ইশটিশনে নামব! হে হে হে!’

আমি ছোট করে বললাম, ‘ও, আচ্ছা।’

লোকটার মুখ তখনো হাসি হাসি। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম, ছেলেটা কাঁদছে! বারবার নাক মুছছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখতে চাইছে সে! লোকটাও সেটা টের পেল। টের পেয়েই ছেলেটার বাঁ হাতের বাহু ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ওই ব্যাটা, কান্দছ ক্যান? সমইস্যা কী তর, হ্যাঁ? চোপ, ফ্যাচফ্যাচ করবি না।’ ছেলেটাকে ধমকেই আবার আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘ভাগিনা আমার কথা বলতে পারে না, জন্ম বোবা! পেটের বিষ উঠছে মনে হয়, কানতাছে। হে হে হে!’

কথাটা শুনে আমি আবার ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, লোকটা পুরোপুরি মিথ্যা বলছে! কারণ, ছেলেটা আমার দিকে কান্নাভরা চোখে তাকিয়ে মাথাটা বেশ কয়েকবার ডানে-বাঁয়ে নাড়াল!

বেলা ১১টা

লোকটা কেন মিথ্যা বলছে? ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক শব্দে। বিরামহীন শব্দটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনের ভেতরের প্রশ্নটাও বেজে চলেছে—কেন কেন কেন কেন? হঠাৎ করে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। লোকটাকে সিট থেকে ওঠাতে পারলেই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা যাবে। কথা বললে নিশ্চয়ই একটা উত্তর পাব। কিন্তু লোকটাকে সিট থেকে ওঠাব কী করে? আবারও ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথায় একটা প্রশ্ন খেলতে লাগল—কীভাবে কীভাবে কীভাবে? হঠাৎ কী মনে করে আমি আমার ব্যাকপ্যাকটায় হাত ঢোকালাম। একটা চিপসের প্যাকেট। খুলে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। একবার তাকিয়ে আগ্রহই দেখাল না! তবে লোকটা তাকিয়ে রইল জুলজুল করে। বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। হাসিমুখে এক মুঠো চিপস নিয়ে মুখে পুরল।

ব্যাকপ্যাকের ভেতরে একটা পানির বোতল আরেকটা কোল্ড ড্রিংকস ছিল। কোল্ড ড্রিংকসের অর্ধেক গিলে ফেলেছি ট্রেনে ওঠার পরপরই। ব্যাকপ্যাকে আরেকটা জিনিস আছে। মামাতো ভাই নাফিসের জন্য তিনটি সোপ বাবলের কৌটা কিনে রেখেছিলাম। গতবার ও যখন আমাদের বাসায় এল, তখন একটা সোপ বাবল ওড়াতে দেখে ওর সে কি খুশি! মুখের সামনে প্যাঁচানো বৃত্তকার তারটায় ডিটারজেন্ট গোলানো পানি ধরে ফুঁ দিলেই রাশি রাশি বাবল উড়ে যায়। ধরলেই নিঃশব্দে ফেটে ফুটুস! নাফিসের আনন্দ আর ধরে না। সেই সোপ বাবলের কৌটা দেখেই মাথায় বুদ্ধির বাবল উড়তে লাগল ব্লুপ ব্লুপ শব্দে!

ব্যাকপ্যাকের ভেতরেই একটা বাবলের কৌটা খুলে ডিটারজেন্ট গোলানো পানিটুকু ঢেলে দিলাম কোল্ড ড্রিংকসের মধ্যে। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বাইরে বের করে আনতেই লোকটা আবার জুলজুল করে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম, তেষ্টা পেয়েছে। এগিয়ে দিলাম বোতলটা। আবার হাসিমুখে নিয়ে ঢকঢক করে প্রায় শেষ করে ফেলল। এবার ট্রেনের শব্দের তালে তালে আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ করছে! মুখ মুছতে মুছতে বোতলটা ফিরিয়ে দিল লোকটা। বিকট শব্দে একটা ঢেকুর তুলে বলল, ‘পিপাসা পাইছিল। খুব আরাম হইল! হে হে হে!’ বলে আরেকটা ঢেকুর তুলল লোকটা। সে তো জানে না, কাপড় পরিষ্কার করার ডিটারজেন্ট পেটে গেলে কী হতে পারে!

বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট

প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর লোকটা পেটে হাত বোলাতে লাগল। মুখটা ভীষণ বিকৃত। আমি ঘুমের ভান করে সব দেখছি। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর লোকটা একসময় পেট চেপে ধরে ট্রেনের টয়লেটের দিকে ছুটে গেল। টয়লেটে ঢোকার পরপরই আমি ছেলেটার দিকে ঝুঁকে পড়লাম। ছেলেটাও দারুণ উত্তেজিত। কথা বলতে পারে না, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বিশেষ একটা কিছু বোঝাতে চায়। আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘লোকটা কে?’ ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে আকারে ইঙ্গিতে যা বোঝাল, তা হলো দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়েছে সে! মহা সর্বনাশ!

দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট

লোকটা টয়লেট থেকে ফিরে এল ভীষণ বিকৃত মুখ নিয়ে। পেটে নিশ্চয়ই মারাত্মক সমস্যা হয়েছে। পেট চেপে ধরে সিটে বসতে বসতে বলল, ‘কী যে হাবিজাবি খাইছি! ওহ্...।’ আমি শুনেও না শোনার ভান করে আছি। ছেলেটা যে বিপদে পড়েছে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু ওকে বাঁচাব কী করে? আবারও প্রশ্নটা ট্রেনের শব্দের তালে তালে মাথায় খেলতে লাগল—কীভাবে কীভাবে কীভাবে কীভাবে?

মিনিট দশেক পর আবার সিট ছেড়ে উঠল লোকটা। আবার টয়লেটের দিকে দৌড় দিল। আমি এবার সাবধানে তার ঝোলাটায় উঁকি দিলাম। অনেক হাবিজাবি জিনিসপত্রের মধ্যে একটা মানিব্যাগ, ভেতরে বেশ কিছু টাকা। কিছু না ভেবে মানিব্যাগটা আমার ব্যাকপ্যাকে চালান করে বসে রইলাম দাঁত কামড়ে! ছেলেটাও সব দেখছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না আসলে কী হচ্ছে। আমি নিজেও কি ঠিক জানি?

বেলা একটা

কদমছড়া রেলস্টেশনে ট্রেন থামল ঠিক একটায়। চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহই নেই। আমি শুধু খেয়াল করছি লোকটার গতিবিধি। এখন ঝোলার ভেতর হাত না ঢোকালেই হয়। মনে মনে খোদাকে ডাকছি আর মিছেমিছি ব্যাকপ্যাক গোছাচ্ছি। লোকটা ট্রেন থেকে নামার সময় জানতে চাইল, ‘আপনে নামবেন না?’ আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম, ‘এই তো নামছি।’ লোকটা ‘আইচ্ছা’ বলে নেমে গেল। ছেলেটার মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। একসময় ওরা প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় চলে গেল। আমি ট্রেন থেকে নেমে ওদের দিকে দৌড়ে গেলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে লোকটাকে বললাম, ‘আপনার কি মানিব্যাগ হারিয়েছে?’ লোকটা চোখমুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বললাম, ‘ট্রেনের ভেতরে এক চোর ধরা পড়েছে। ওর কাছে পাওয়া গেছে।’ কথাটা শুনে লোকটা ঝোলা খুলে দেখেই ট্রেনের দিকে দৌড় দিল। যেতে যেতে ছেলেটাকে বলল, ‘তুই এইখান থেইকা নড়বি না কইলাম!’

লোকটা ট্রেনে উঠতেই আমি ছেলেটার হাত ধরে ছুটতে লাগলাম রেলস্টেশনের অফিসের দিকে!

বেলা ১টা ৪৫ মিনিট

রেলস্টেশনে পুলিশ এসেছে। মামা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। ছেলেটা বসে আছে পুলিশের পাশে। বদমাশ লোকটা বসে আছে মেঝেতে। মোটাসোটা আর হাসিখুশি চেহারার এক পুলিশ আমাকে বললেন, ‘তুমি তো বড় গোয়েন্দা হে! সে কি বুদ্ধি! ডিটারজেন্ট খাইয়ে এর পেট খারাপ করে দিলে! হা হা হা!’

মামার মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল, ‘বুদ্ধি মানে! এসব বলবেন না। আশকারা পেয়ে যাবে।’

পুলিশ ভদ্রলোক মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘শোনো বাবা, সেল্ফ হেল্প ইজ দ্য বেস্ট হেল্প! তবে শেষমেশ বুদ্ধি করে যে স্টেশনমাস্টার সাহেবের কাছে চলে এসেছিলে, সেটাও খুব ভালো ডিসিশন ছিল। এই কালাচান বড় বদমাশ। পাচারকারীদের চ্যালা। বড় বাঁচা বেঁচে গেলি রে ব্যাটা!’ শেষ কথাটা বললেন ছেলেটা মানে বজলুর দিকে তাকিয়ে। বজলু এতক্ষণে দাঁত বের করে হাসল!