বাড়ির সামনে বইবদল

সান ফ্রান্সিসকো থেকে বার্কলি শহরে ফিরব। মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা করছি ট্রেনের জন্য। হঠাত্ স্টেশনের কোনার দিকে হ্যাবিটট নামের শিশুদের মিউজিয়ামের একটা বিজ্ঞাপন দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম—একদল শিশু বালুর মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। সে কী আনন্দ তাদের মুখে। আর পাশে লেখা ‘কাম প্লে অ্যাট হ্যাবিটটস স্যান্ড জোন’। মনে হলো আমাকেই যেন গিয়ে বালুর মধ্যে খেলতে বলছে। ট্রেনে এক স্টপেজ আগেই নেমে ঠিকানা খুঁজে পেতে কাছে গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। বিশাল এক এলাকা টনের পর টন বালু দিয়ে প্রায় মরুভূমির মতো বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আর সেখানে শত শত গুঁড়া বাচ্চা জামাকাপড় ও হাত-মাথা মাখিয়ে বালুর ওপর শুয়ে-বসে বালুর ঘর, রাজপ্রাসাদ, হাতি, ভালুক ইত্যাদি বানাচ্ছে। মা-বাবারাও কম যান না। তাঁরাও সমানতালে নিজেদের বাচ্চাদের উত্সাহ দিয়ে নেমে পড়েছেন বালু নিয়ে খেলতে। কিছুক্ষণ দেখে টেখে আমিও নেমে পড়লাম বিশাল এক বেলচা দিয়ে বালু খুঁড়তে। দেখতে দেখতে ১৫-২০ জন বাচ্চা জুটে গেল আমার পাশে। সবাই মিলে বিশাল এক সুড়ঙ্গ বানিয়ে সেটার ভেতর আসা-যাওয়ার খেলা খেললাম।

চলছে বালু বালু খেলা
চলছে বালু বালু খেলা

এক-দেড় ঘণ্টা বালুতে মাখামাখি হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছি। রাস্তার আশপাশের একতলা-দোতলা বাসাগুলো রংবেরঙের ফুল-ফলের গাছ দিয়ে সাজানো। ফুটপাতের পাশেই বোতলব্রাশ ফুলের গাছে নড়াচড়া দেখে তাকিয়ে দেখি, বিকেলের সোনালি আলোয় একাকী এক হামিংবার্ড উড়ে উড়ে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে। বইপত্রে অনেক পড়েছি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট এই পাখিটির কথা। আগে কখনো দেখিনি। তাই হামিংবার্ড দেখে আমি ব্যাপক উত্তেজিত! লম্বা ঠোঁটের পাখিটি এত দ্রুত পাখা নাড়াচ্ছে যে ডানা দুটো দেখাই যাচ্ছে না। ভালো করে খেয়াল না করলে তার উপস্থিতিও ঠাহর করা যায় না। ছবি তোলার জন্য মুঠোফোন বের করে একটা ছবি তুলতে না তুলতেই চোখের পলকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে। গুগলে সার্চ দিয়ে আমার তোলা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম, না এটা সত্যি সত্যিই হামিংবার্ড। মোটমাট ১৪ প্রজাতির হামিংবার্ডের দেখা মেলে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের সমুদ্র নিকটবর্তী প্রদেশ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এদের গায়ের রং ভিন্ন হলেও আকার ও ওজন মোটামুটি একই। বাসায় যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে আমি সম্ভাব্য কয়েকটা ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া গাছের দিকে রওনা দিলাম আরও দু-একটা হামিংবার্ড দেখার আশায়। অনেক খুঁজেও আর পেলাম না। তবে পেলাম আরেক আশ্চর্য জিনিস। ফুটপাতের পাশে সামনে কাচ দেওয়া কাঠের তৈরি একটা বাক্স, যার মধ্যে ঠাসা করে রাখা বই। আর সামনে লেখা ‘বুক এক্সচেঞ্জ’।

হঠাত্ই বাড়ির সামনে চোখে পড়ে এমন ছোট ছোট বইয়ের বাক্স
হঠাত্ই বাড়ির সামনে চোখে পড়ে এমন ছোট ছোট বইয়ের বাক্স

একটু উবু হয়ে স্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে দেখলাম ভেতরে বেশ মজার মজার বই। বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না। রাস্তার ওপর এমন বইয়ের বাক্স কেন বানিয়ে রাখা হয়েছে? একটু ইতস্তত করে হাতল ধরে টান দিতেই সামনের পাল্লাটা খুলে গেল। সামনের বইটা তুলে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই পড়তে শুরু করলাম। সংবিত্ ফিরল হঠাত্ দরজা খোলার আওয়াজে। পাশের বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা। বলেন, এখানে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে না। চাইলে আমি বাসাতেই নিয়ে যেতে পারি। আমার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তিনি আমাকে পুরো ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললেন।

ক্ষুদ্রতম পাখি হামিংবার্ড সেকেন্ডে ৫০ থেকে ২০০ বার ডানা ঝাপটায়
ক্ষুদ্রতম পাখি হামিংবার্ড সেকেন্ডে ৫০ থেকে ২০০ বার ডানা ঝাপটায়

তাঁর ‘নেইবারহুড বুক এক্সচেঞ্জ’ নামের এই বই আদান-প্রদানের ছোট্ট লাইব্রেরিটি আসলে ‘লিটল ফ্রি লাইব্রেরি’ নামের একটি আন্দোলনের অংশ, যার মূল উদ্দেশ্যই হলো গ্রন্থাগার তৈরি করা। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের হাডসন শহরে শুরু হয় এই আন্দোলন। বাড়ির বাইরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বই আদান-প্রদানের এই চল শুরু করেন টড বোল নামের এক ব্যক্তি। কাঠের তৈরি চার বর্গফুটের ছোট্ট এই লাইব্রেরিটি তিনি বানিয়েছিলেন তাঁর বইপ্রেমী ও স্কুলশিক্ষক মাকে স্মরণ করে। এরপর এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন টেড বোলের বন্ধু রিক ব্রুকস। প্রাথমিকভাবে তাঁদের লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ১০৫টি লাইব্রেরি তৈরি করা। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই বই আদান-প্রদানের এ আন্দোলনটি এত জনপ্রিয় হয়ে যায় যে ২০১৬ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশ ও পৃথিবীর ৭০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই লাইব্রেরির কার্যক্রম। তৈরি হয়েছে ৩৬ হাজার লাইব্রেরি। প্রতিবছর আদান-প্রদান হচ্ছে প্রায় ৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন বই। এর মূল বিষয়টি হলো তোমার যে বইটি আছে, সেটি পড়া শেষে ঘরের মধ্যে ফেলে না রেখে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আদান-প্রদান করে নাও। এ জন্যই এই লাইব্রেরি আন্দোলনের স্লোগান হচ্ছে ‘একটি বই দাও, একটি নাও’।

রিক ব্রুকস ও টড বোলের হাত ধরেই এগিয়ে চলেছে লিটল লাইব্রেরি
রিক ব্রুকস ও টড বোলের হাত ধরেই এগিয়ে চলেছে লিটল লাইব্রেরি

লিটল ফ্রি লাইব্রেরি চায় ২০১৭ সালের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে এক লাখ লাইব্রেরি তৈরি করতে। এর মাধ্যমে নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে বইকে ছড়িয়ে দিতে। তাই তুমিও চাইলে তোমার এলাকায় বানিয়ে ফেলতে পারো এমন চমত্কার ছোট্ট একটা লাইব্রেরি। যুক্ত হতে পারো বিশ্বব্যাপী এই বই পড়ার আন্দোলনের সঙ্গে। কীভাবে সেটা বানাবে তার বিস্তারিত দেওয়া আছে তাদের ওয়েবসাইটে। জানতে এক্ষুনি ঢুঁ মারতে পারো littlefreelibrary.org ঠিকানায়। এরপর কাঠ-টিনের তৈরি  লাইব্রেরি বানিয়ে আমাদের জানিয়ো এবং ছবি তুলে পাঠিয়ো। কিশোর আলোয় আমরা সেটা ছেপে দেব। আর আমরাও নাহয় একসময় সবাই মিলে গিয়ে ঘুরে দেখে আসব তোমার ছোট্ট লাইব্রেরিটি।