ইশ্! পুকুরে ইলিশ!

কথায় বলে, মাছের রাজা ইলিশ। বিশাল সাগরেই তার বসবাস। লোনা পানির এই প্রাণীর ভাবই আলাদা। স্বাধীনভাবে জলাশয়ে সাঁতরে বেড়ায় এরা। কখনো পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যায় দূরে কোথাও। মাছের রাজা বলেই রুই বা পুঁটির মতো পুকুরের আবদ্ধ পরিবেশ তাদের একদমই পছন্দ না। চারকোনা একটা পুকুরের এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিতে কদিন আর ভালো লাগে? অবশ্য ডিম ছাড়ার জন্য মাঝেমধ্যে মিঠা বা স্বাদু পানিতে আসতে হয় ইলিশকে। তখন সাগর মোহনার নদ-নদীর মিঠা পানি বেছে নেয় তারা। ডিম ছাড়া শেষ হলে ঐক্যবদ্ধভাবে সাগরের ইলিশ সাগরে ফিরে যায়। ডিম ফোটার কয়েক মাসের মধ্যে ইলিশের পোনারাও ফিরে যায় ওদের চিরচেনা লোনা পানির রাজ্যে। কিন্তু পুকুর? ইলিশ বোধ হয় দুঃস্বপ্নেও পুকুরে থাকার কথা ভাবে না! তবে এখন না ভাবলেও ভবিষ্যতে হয়তো পুকুরই হবে তাদের অনেকের ভাবনার জগত্।

ইলিশ তো আর জানে না, বাংলাদেশের মত্স্যবিজ্ঞানীরা তাদের নিয়ে দিনের পর দিন গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানীদের একটাই চিন্তা—পাঙাশ, গুলিশা, শিং, মাগুর, পাবদাও তো মুক্ত জলাশয়েরই মাছ। সেগুলো খুব সহজেই পুকুরে চাষ হচ্ছে এখন। মত্স্যবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন গবেষণা করে প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মানো এসব মাছকে চাষের আওতায় নিয়ে এসেছেন। এসব মাছ এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। তাহলে ইলিশ মাছের সমস্যাটা কোথায়? সবাই পারলে ইলিশ কেন পুকুরের আবদ্ধ পরিবেশে বাঁচবে না? তাই লোনা পানির ইলিশকেও আবদ্ধ পরিবেশে চাষ করা যায় কি না, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই ব্যাপক গবেষণা চালাচ্ছেন বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। এতে সহায়তা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনহান্সড কোস্টাল ফিশারিজের (ইকো ফিশ)। সোনালি আঁশ পাট থেকে একসময় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত বাংলাদেশ। তেমনি রুপালি ইলিশ আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেয়। তাই পুকুরে চাষ হলে এই মাছ অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।

পটুয়াখালীর এই পুকুরেই চলছে ইলিশ নিয়ে গবেষণা।
পটুয়াখালীর এই পুকুরেই চলছে ইলিশ নিয়ে গবেষণা।

এই গবেষণা চলছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। বিএফআরআইয়ের খেপুপাড়া নদী উপকেন্দ্রের একটা পুকুরে ‘ইলিশ চাষ’-এর গবেষণা শুরু হয়। ‘পুকুরের বিভিন্ন ঘনত্বে ইলিশ মাছের বেঁচে থাকার হার ও বৃদ্ধির পরীক্ষণের’ কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে। পরে অক্টোবরে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা কার্যক্রম।

পটুয়াখালীতে এ গবেষণা চালানোর কারণ হলো, উপকূলীয় অঞ্চলের সাগর-নদীতেই ইলিশ বেশি পাওয়া যায়। জাটকা পোনাও পাওয়া যায় প্রচুর। 

খেপুপাড়া নদী উপকেন্দ্রের ভেতরে ৪৫ শতাংশ জমির ওপর সাত ফুট গভীরতার বিশাল এক পুকুর খনন করা হয়েছে। তারপর সেখানে মশারির জাল দিয়ে নয়টি ভাগ করে ছাড়া হয়েছে ইলিশের জাটকা পোনা। পুকুরের পূর্ব দিকের প্রথম তিনটি ভাগে ২০০ করে ৬০০, মাঝের তিনটি ভাগে ৪০০ করে ১ হাজার ২০০ এবং পশ্চিম দিকের তিনটি ভাগে ৬০০ করে ১ হাজার ৮০০ জাটকা পোনা ছাড়া হয়েছে। এই পোনাগুলো আনা হয়েছে আন্ধারমানিক ও রাবনাবাদ নদ থেকে। আকারে খুবই ছোট এরা। নয় ইঞ্চি ও তিন থেকে চার ইঞ্চি—এই তিন আকারের পোনাই  ছাড়া হয়েছে পুকুরে। পোনা ইলিশের আবার অন্য মাছেদের মতো খাবার দিলে চলবে না। তাদের জন্য দরকার সাগরে জন্মানো একধরনের খুদে উদ্ভিদকণা, যার নাম ফাইটো প্লাংকটন। হাজার হলেও মাছের রাজা বলে কথা, যা-তা মুখেই তুলবে কেন! তাই পোনা ইলিশ মাছগুলোর খাবারের চাহিদা পূরণ করতে পুকুরের ভেতরেই খুদে খুদে উদ্ভিদকণা তৈরির চেষ্টা চলছে। এ কয়েক দিনের মধ্যে বিএফআরআইয়ের ল্যাবরেটরিতে খুদে প্রাণীকণা (জু প্ল্যাংকটন) তৈরি করে তা খাবার হিসেবে দেওয়া হবে পোনাদের। এককথায় ডুবন্ত খাদ্য, ভাসমান খাদ্য আর নার্সারি পাউডার—সবকিছু দিয়েই ছোট ছোট ইলিশের পোনার খাবারের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

এই পোনাগুলোকে খুব আদরযত্নে বড় করছেন বিজ্ঞানীরা। পুকুরটিতে যাতে অন্য কোনো ধরনের প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য পুকুরটির চারপাশে মশারির জাল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। সাগরে থেকে অভ্যস্ত ইলিশ মাছের জন্য সাগরের পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টার অন্ত নেই গবেষকদের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুকুরে কৃত্রিম ঢেউ সৃষ্টি করার জন্য কক্সবাজার থেকে প্যাডেল হুইল অ্যারেটর (ঢেউ সৃষ্টিকারী যন্ত্র) কিনে আনা হয়েছে। এ ছাড়া এয়ার ব্লোয়ার (বাতাস সরবরাহকারী যন্ত্র) বসানো হয়েছে। এটা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে মশারি জালের প্রত্যেক ভাগে বাতাস দেওয়া যায়।

পোনাগুলো ভালো আছে কি না, কিংবা তাদের কোনো অসুখ হলো কি না, তা-ও দেখেন বিজ্ঞানীরা। বিএফআরআইয়ের খেপুপাড়া নদী উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে জাল টেনে মাছগুলোর অবস্থা যাচাই করি। এই গবেষণার কাজ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ সফল হতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে। গবেষণায় সফলতা পাওয়া গেলে জাতীয় মাছ ইলিশ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে।’

একদিন হয়তো পুকুরভরা ইলিশ মাছের স্বপ্ন সত্যি হবে
একদিন হয়তো পুকুরভরা ইলিশ মাছের স্বপ্ন সত্যি হবে

এর আগে চাঁদপুরের পুকুরেও ইলিশ চাষের গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেবার সফল না হলেও বিজ্ঞানীদের আশা, পটুয়াখালীর এই পুকুরের গবেষণাটি সফল হবে। তখন পুকুরভরা ইলিশ মাছের স্বপ্ন সত্যি হবে। যদিও স্বাধীনচেতা ইলিশ বন্দী হয়ে যাবে পুকুরে। তোমরা যারা সাগরের ইলিশ মাছ খাচ্ছ, তারা বড় হয়ে ছোট ভাইবোনদের বলবে, ‘তোরা তো খাস পুকুরের ইলিশ, স্বাদ নেই। ইলিশ খেয়েছিলাম আমরা...সাগরের ইলিশ!’

তবে এখনকার বিজ্ঞানীরা তো পুকুরে ইলিশ চাষের চেষ্টা করছেন। কে জানে, তোমরা হয়তো ঘরের অ্যাকুয়ারিয়ামেই ইলিশ চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করে বসবে! 

ছবি: লেখক