কন-টিকি ভেলায় সাগর জয়

ইতিহাস গড়া সেই ভেলার সামনে রোয়াল্ড হেয়ারডাল
ইতিহাস গড়া সেই ভেলার সামনে রোয়াল্ড হেয়ারডাল

মাথার মাথার ওপর গনগন করছে ভয়ংকর সূর্য। যতদূর চোখ যায় শুধু উত্তাল জলরাশি। দূর-দূরান্তে কোনো ভূখণ্ডের লেশমাত্র চোখে পড়ে না। বিশাল মহাসাগরের মধ্যে একেবারেই সমুদ্রের হাতের খেলনা হয়ে ভাসছে একটা ভেলা!

নৃশংস রোদের হাত থেকে বাঁচার অবলম্বন এক চিলতে পালের ছায়া। দুপুরের খাওয়া শেষ করে বাকি সবাই সেই ছায়াতে গুটি মেরে বসেছেন। ন্যুট হগল্যান্ডের খাওয়া শেষ হতে একটু দেরি হয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি সমুদ্রের জলে হাত ধুয়ে বাঁশের কেবিন বা পালের ছায়ায় গিয়ে বসবেন। অবশিষ্ট খাবারটা সমুদ্রে ছুড়ে দিয়ে ভারসাম্য সামলে ভেলার কিনারে এলেন। হাত ধোবেন বলে নিচু হয়েছেন। অমনি চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল হিমালয় পর্বত!

হগল্যান্ডের চিত্কারে বাকি পাঁচজন ফিরে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখলেন ভেলার পাশেই ভেসে উঠেছে দুনিয়ার বৃহত্তম প্রাণী—তিমি।

একবার কল্পনা করে দেখো দৃশ্যটা—প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক মাঝে একটা কাঠের তৈরি ভেলায় ভাসছেন ছয়জন মানুষ; খাবার-সংকট, রোদের জ্বালা এবং তার মাঝেই ভেসে উঠেছে ভয়ংকর-দর্শন এক তিমি মাছ। এ যেন রুদ্ধশ্বাস, অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকেও হার মানানো দৃশ্য।

না, মোটেও এটা ‘লাইফ অব পাই’-এর মতো কোনো সিনেমার গল্প নয়। কিংবা রোজ দেখা ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ ধারাবাহিকের জন্য নিরাপদে তৈরি করা কোনো অভিযানের গল্প নয়। এ ছিল সত্যিকারের এক ভুবনজয়ী অভিযান ‘কন-টিকি ভয়েজ’-এর গল্প।

হ্যাঁ, কন-টিকি অভিযাত্রা।

শুধু নামটা বললে কিছু বোঝা যায় না। ১৯৪৭ সালে এই অভিযাত্রা দিয়ে বিজ্ঞানের দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলেছিলেন থর হেয়ারডাল নামের এক খ্যাপাটে জীববিজ্ঞানী। এই অভিযান দিয়ে মানুষের স্বপ্ন ও সামর্থ্যকে নতুন করে প্রমাণ করেছিলেন থর হেয়ারডাল। বিজ্ঞানের তত্ত্ব প্রমাণের জন্য আয়োজিত হলেও ১০১ দিনে সামান্য কাঠের ভেলায় করে প্রশান্ত মহাসাগরে ৪ হাজার ৩০০ নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিয়ে থর হেয়ারডাল হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নায়ক, বিজ্ঞানের নায়ক।

আজ এসো, হেয়ারডাল নামের এই মহান বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী ও লেখকের অভিযানটা একবার ফিরে দেখা যাক।

হেয়ারডাল মানুষটা ছোটবেলা থেকেই একটু খ্যাপাটে ছিলেন। নইলে নিজের বাড়িতে এই তোমাদের বয়সে কেউ সাপ-ব্যাঙ নিয়ে চিড়িয়াখানা বানায়!

এই ভেলাতেই প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন রোয়াল্ড হেয়ারডাল আর তাঁর দলবল
এই ভেলাতেই প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন রোয়াল্ড হেয়ারডাল আর তাঁর দলবল

১৯১৪ সালের ৬ অক্টোবর নরওয়ের লারভিক শহরে জন্ম হেয়ারডালের। ছোটবেলাটা সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে কাটিয়ে বড় হয়ে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যা বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন; দ্বিতীয় বিষয় ছিল তাঁর ভূগোল। এই পড়াশোনারই অংশ হিসেবে ১৯৩৬ সালে হেয়ারডাল নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে রওনা দেন ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের এক অংশ মার্কুইস দ্বীপপুঞ্জের শেষতম দ্বীপ ফাতু হিভাতে। উদ্দেশ্য নানা দুর্লভ জীব-নমুনা সংগ্রহ করা।

এই ‘ফাতু হিভা’ দ্বীপই হয়ে ওঠে থর হেয়ারডালের জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’।

আগে থেকেই পলিনেশীয় সভ্যতা নিয়ে দারুণ আগ্রহী হেয়ারডাল এখানে এসে একটার পর একটা চমক লাগানো ব্যাপার খেয়াল করেন। বলে দেওয়া ভালো, মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা হাজার খানেক বিভিন্ন নামের ছোট-বড় দ্বীপকে বলা হয় পলিনেশিয়া এলাকা। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, সামোয়া দ্বীপপুঞ্জ, মার্কুইস দ্বীপপুঞ্জ, টোঙ্গা, ইস্টার আইল্যান্ড—এই এলাকার নামকরা সব দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ। পলিনেশীয় সভ্যতা নিয়ে তোমাদের আগ্রহ থাকলে এখনই একটু বইয়ে চোখ বুলিয়ে নাও। দেখতে পাবে, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে কেমন বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে আছে এই আদিম সভ্যতা। এই সভ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্নের একটা হলো, পলিনেশিয়ানরা এল কোত্থেকে?

লোকে বিশ্বাস করত, এখনো অনেকে বিশ্বাস করে, পুব দিক থেকে, মানে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া থেকে আদিমকালে মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু হেয়ারডাল দেখলেন পলিনেশিয়ান মিষ্টি আলু থেকে নানা রকম গাছপালার সঙ্গে দারুণ মিল আছে পশ্চিমের লাতিন আমেরিকার সঙ্গে। তিনি তাঁর এই যুক্তির পক্ষে নানা রকম উপকরণ পেতে থাকলেন—মানুষের কঙ্কালের গঠন, উপকথার মিল, গাছপালার মিল, সংস্কৃতির মিল।

আর এসব নমুনা নিয়ে তিনি প্রবল উত্তেজনায় ফিরে এলেন নরওয়েতে। প্রকাশ করলেন ‘ফাতু হিভা’ নামে প্রায় চার দশক পরে সাড়া জাগানো একটি বই ও একটি জার্নালে নিবন্ধ, যে নিবন্ধে হেয়ারডাল দাবি করলেন, পলিনেশীয়রা পুব নয়, পশ্চিম থেকে এসেছে।

কন-টিকি অভিযান নিয়ে নরওয়ে থেকে প্রকাশিত চারটি ডাকটিকিট
কন-টিকি অভিযান নিয়ে নরওয়ে থেকে প্রকাশিত চারটি ডাকটিকিট

হেয়ারডালের এই তত্ত্বের দারুণ বিরোধিতা করলেন সমকালীন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা চূড়ান্ত অস্ত্র হিসেবে বললেন খ্রিষ্টের জন্মের শ পাঁচেক বছর আগে লাতিন আদিবাসীদের পক্ষে আর যা-ই হোক, উত্তাল প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না। আর এই কথাতেই হেয়ারডাল হয়ে উঠলেন বিশ্ব কাঁপানো অভিযাত্রী।

ঠিক করলেন, আদিম প্রযুক্তিতে বানানো সেকালের মতো এক ভেলায় তিনি পাড়ি দেবেন প্রশান্ত মহাসাগর। বাড়ির পুকুরেও কখনো সাঁতার না কাটা থর হেয়ারডাল আক্ষরিক অর্থেই জীবন হাতে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিলেন। 

১৯৪৭ সালের গোড়া থেকে শুরু হলো তোড়জোড়। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী ও পেরুর নৌবাহিনীর সহায়তায় প্রস্তুতি শুরু করল হেয়ারডালের অভিযান। একে একে তাঁর এই অবিস্মরণীয় অভিযানে যোগ দিলেন আরও পাঁচ দুঃসাহসী গবেষক ও প্রযুক্তিবিদ। প্রথমেই এলেন পরিমাপবিশারদ প্রকৌশলী হারমান ওয়াটজিনগার। এরপর একে একে চিত্রশিল্পী ও গবেষক এরিক হেসেলবার্গ, বহুভাষাবিদ ও সমাজকর্মী বেনগট ড্যানিয়েলসন, রেডিও বিশেষজ্ঞ ও নৌবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ন্যুট হগল্যান্ড এবং আরেক রেডিও বিশেষজ্ঞ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারদর্শী প্রকৌশলী টরস্টেইন র্যাবি যোগ দিলেন দলে।

শুরু হলো ভেলা বানানো।

বালসা কাঠ নামে পেরুর বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা মোটা একধরনের গাছের গুঁড়িকে করা হলো মূল কাঠামোর উপাদান। প্রাচীন পলিনেশীয় চিত্র অনুসরণ করে তৈরি করা হলো ভেলার কাঠামো। নয়টি ৪৫ ফুট লম্বা বালসা কাঠের গুঁড়ি পাশাপাশি রেখে বাঁধা হলো বাঁশ প্রজাতির একধরনের গাছ থেকে তৈরি দড়ি দিয়ে। এর ওপর আবার আড়াআড়ি করে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্যের গুঁড়ি দিয়ে শক্ত করা হলো মূল কাঠামোকে। বাঁশ দিয়ে ভেলার এক পাশে তৈরি করা হলো একটা কেবিন। কেবিনের ছাউনি বানানো হলো কলাপাতা দিয়ে। আর ভেতরে প্রাচীন লণ্ঠন, বাঁশের চাটাই রইল।

সব মিলিয়ে ১ হাজার ৪০ লিটার খাবার পানি নেওয়া হয়েছিল ভেলায়। এর মধ্যে ৫৬টি ছিল পানির ক্যান, বাকিটা বাঁশের তৈরি প্রাচীন আমলের পাত্রে। দুই শ নারকেল এবং প্রচুর মিষ্টি আলু-জাতীয় খাবার ছিল ভেলায়। ক্যানজাত পানি এবং কৌটার খাবার ছিল প্রাচীন উপায়ে চলতে না পারলে অগত্যা খাওয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনী রেডিও যোগাযোগের ব্যবস্থা রেখেছিল। তবে বাস্তবতা হলো, তখনকার প্রযুক্তিতে বিপত্সংকেত পেলেও প্রশান্ত মহাসাগরের ওই অঞ্চল থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর ছিল না।

এ অবস্থায়ই ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল বিকেলে পেরুর ক্যালাও থেকে সমুদ্রে ভেসে পড়ল থর হেয়ারডালের ভেলা; আদি পলিনেশীয় দেবতার নামে তৈরি হওয়া ঠুনকো সমুদ্রযান; কন-টিকি।

সেই অভিযানের গল্প নিয়ে বই লেখা হয়েছে, উপন্যাস হয়েছে, অস্কারজয়ী ডকুমেন্টারিও বানানো হয়েছে। সেই গল্প এই অল্প জায়গায় বলে ফেলাটা নিশ্চয়ই আমার-তোমার পক্ষে সম্ভব না!

কন-টিকি অভিযানে ভেলার অভিযাত্রীরা
কন-টিকি অভিযানে ভেলার অভিযাত্রীরা

শুধু একটু বলতে পারি, সে এক দারুণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার, বিপজ্জনক ব্যাপার। মাছ ধরার কৌশলটা কিন্তু ছিল চমত্কার। আসলে এই অভিযাত্রীরা মাছ ধরতেন না; কুড়াতেন। রোজ রাতে লণ্ঠনের আলো দেখে টুনা প্রভৃতি মাছ লাফিয়ে উঠত ভেলায়। সকালবেলায় তাদের দিব্যি কুড়িয়ে নিয়ে রেঁধে ফেলা হতো। নিত্যবেলা সমুদ্র থেকে টুনা মাছ ধরে রান্না করে খাওয়া কিংবা হাঙরের মুখোমুখি হওয়ার গল্প শুনতে দুরন্ত, বাস্তবে ভয়ানক।

এই ভয়ানক অভিযান আদৌ শেষ হবে কি না, কেউ জানত না। অবশেষে অভিযান শুরুর ৯৭ দিন বাদে যুক্তরাষ্ট্রে নরওয়ের দূতাবাস কন-টিকি থেকে রেডিও বার্তা পেল, তাঁরা ডাঙা দেখতে পাচ্ছেন। পুকু-পুকা নামে দ্বীপ দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার জন্য সেখানে ভিড়তে পারলেন না। আরও চার দিন বাদে, ৭ আগস্ট সকালে, ঠিক ১০১ দিনে ৬ হাজার ৯৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তুয়ামুতু দ্বীপপুঞ্জের রারোইয়া দ্বীপের প্রবালের ওপর আছড়ে পড়ল কন-টিকি। চিত্কার করে সৈকতে নেমে এলেন ছয় অভিযাত্রী।

মানচিত্রে হেয়ারডালের যাত্রাপথ
মানচিত্রে হেয়ারডালের যাত্রাপথ

অক্ষত দেহে ছয় অভিযাত্রী মাটিতে নেমে প্রথমেই পেরু থেকে আনা একটা নারকেলের চারা পুঁতে দিলেন দ্বীপে, যেন ইতিহাস ফেরাতে চাইলেন তাঁরা।

এরপরও একটার পর একটা অভিযান করেছেন সমুদ্রে। রা-ওয়ান, রা-টু, ইউফ্রেতিস, রাপা নুই, সার্চ অব ওডিন নামে বিভিন্ন অভিযান করে প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর চষে বেড়িয়েছেন। স্রেফ নলখাগড়া দিয়ে বানানো নৌকায় করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মিসরীয় ও মায়ান সভ্যতার যোগাযোগ দেখাতে চেয়েছেন।

মানুষে মানুষে সেই আদি যুগের সম্পর্ক খুঁজে বেড়াতে সমুদ্রজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে থর হেয়ারডালের ভেলা। ফেসবুকের বাটন নয়, বাস্তব জীবনের ভেলা দিয়ে পলিনেশিয়া থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কায় হেয়ারডাল মানুষের সম্পর্ক খুঁজেছেন।

আমি-তুমি কি একটা ভেলা বানাতে পারি না?