অপেক্ষা

প্রায় প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়ার পথে বায়োলজি ল্যাবে চোখ বুলিয়ে যাই। মাঝারি সাইজের ল্যাব, তার ভেতরে ছোট্ট একটি রুম, যেখানে তিনি বসেন, সেই ১০৯ নম্বর রুমের দরজায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ দুটি আটকে থাকে। মাঝেমধ্যে ল্যাবের ইয়াসিন ভাইকে জিজ্ঞেস করি, তিনি কি আজকেও আসবেন না? ইয়াসিন ভাই যথারীতি মাথা দুদিকে দুলিয়ে ‘না’ উত্তর দেন। আমি প্র্যাকটিক্যাল খাতাটির দিকে একপলক ফেলে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটতে থাকি।
খাতাটি কি আদৌ সাইন করানো যাবে না! ম্যাডামের সাইন না হলে খাতাটি দিয়েই বা কী করব। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় পাস করতে ম্যাডামের সাইন খুব দরকার, এমন নয়। খাতাটির সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার কোনো সম্পর্কই নেই। খাতাটি শুধু আমার নয়, খাতাটি আমাদের কয়েকজনের। খাতাটিতে অনেকগুলো গাছের অনেক রকম পাতার ছবি। পাতাগুলো জীবন্ত না হলেও সজীব হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এই সজীব আর প্রাণবন্ত করে তুলতেই ম্যাডামের সাইন নেওয়া খুব দরকার। খুবই দরকার। হ্যাঁ, ম্যাডামের কাছে গিয়ে সাইন নিতে পারি, তবে না, ম্যাডামের কাছে গিয়ে সাইন নেব না। ম্যাডামকে এখানেই আসতে হবে। সুস্থ হয়ে ১০৯ নম্বর রুমে সোমা ম্যাডামকে এখানে বসতেই হবে। তারপর আমরা সাইন নেব। ক্যানসারের কাছে কেন তিনি হেরে যাবেন? আমাদের ছবি আঁকার কোনো মূল্য নেই! পরীক্ষার জন্যও তো এত সুন্দর করে ছবি আঁকতে পারিনি কখনো। এরটা দেখেছি, ওরটা দেখেছি, ছাপ মেরেছি। কত শত ছবি আঁকতে হয়েছে! কত রকম গাছের যে ফুলের, ফলের, বীজের, পাতার ছবি আঁকতে দিয়েছেন তিনি। মনে মনে বলতাম, এত কষ্ট দেওয়া ঠিক নয়, ম্যাডাম। তখন তো বুঝতাম না, এভাবে ছবি আঁকতে আঁকতেই আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গাছগুলোকে চেনা হবে। তখন বরং ম্যাডামের ওপর রাগই হতো। কিন্তু এবার, নিজে নিজে খুব যত্ন করে ছবিগুলো এঁকেছি। এগুলো শুধু ছবি নয়; এ যে আমাদের আবেগ, আমাদের ভালোবাসা।
এই আবেগ আর ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে ম্যাডাম না এসে পারেন না। কেন দূরে থাকবেন, খুব অসুস্থ বলে! না, না, এমনটি হবে না। সুস্থ হয়ে আমাদের কাছে ম্যাডামকে আসতেই হবে, হ্যাঁ, সুস্থ হয়েই। আমরা বড় আশা করে বসে আছি, ম্যাডামের হাতের স্পর্শে আমাদের আঁকা গাছের পাতার ছবিগুলো একদিন না একদিন সজীব হয়ে উঠবেই। তিনি আবার আসবেন, প্রতিদিন আসবেন, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই আসবেন—সেই অপেক্ষাই করছি।
তুষার রায়
ফরেস্ট্রি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]