বিজ্ঞানীদের করুণ মৃত্যু

আর্কিমিডিস

নিজের বাড়ির উঠোনে গণিতের সূত্র আঁকিবুঁকি করছেন গ্রিক পণ্ডিত আর্কিমিডিস। তিনি যখন গণিতে ডুবে থাকেন, চারপাশের জগতের কোনো খোঁজ রাখেন না। ঠিক সে সময় রোমানরা আক্রমণ করেছে তাঁর দেশে। যুদ্ধে তাঁর দেশের সম্রাট হেরেও গেছেন। কিন্তু আর্কিমিডিসের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি তাঁর কাজ নিয়েই ব্যস্ত। ঠিক তখনই কোনো এক মাথামোটা সৈনিক এসে আর্কিমিডিসকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। হাতে তাঁর ধারালো খোলা তরবারি। আর্কিমিডিসের বয়েই গেল তাকে কেয়ার করতে। বরং তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহ্, বিরক্ত কোরো না, দেখছ না ব্যস্ত আছি!’

মাথামোটা সৈনিক জ্যামিতি বা গণিতের কী বোঝে! আর্কিমিডিসকে সে চেনে না, জানে শুধু যুদ্ধ করতে। আর্কিমিডিসের কথায় তার আঁতে ঘা লাগল। ‘কী, পরাজিত দেশের নাগরিকের এত বড় স্পর্ধা!’ তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিল সে আর্কিমিডিসের ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল আর্কিমিডিস। পরে আর্কিমিডিসের কাটা মুণ্ডু দেখে বিজয়ী রোমান সম্রাট দুঃখ পেয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে সম্রাট তাঁর সৈন্যদের বলে দিয়েছিলেন যেন আর্কিমিডিসকে হত্যা করা না হয়। তিনি গুণের কদর করতেন। যদিও আর্কিমিডিসের কারণে বারবার হেরেছেন তিনি। তাঁর তৈরি আয়না পুড়িয়ে মেরেছে রোমান সৈন্যদের, তাঁর অদ্ভুত যন্ত্র ডুবিয়ে দিয়েছে বহু জাহাজ। তবু আর্কিমিডিসের প্রতি ক্ষিপ্ত হননি সম্রাট। বরং এই

গুণী মানুষটিকে একবার স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।

জিওর্দানো ব্রুনো

১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর একটি দিন। রোমের রাজপথ কানায় কানায় পূর্ণ। প্রতিটা বাড়ির ছাদে, প্রাচীরে, গাছে—যে যেখান থেকে পারছে উঁকি দিচ্ছে মঞ্চের দিকে। রঙ্গমঞ্চ নয়। ফাঁসির মঞ্চ। আসামি জিওর্দানো ব্রুনো। তাঁর অপরাধ তিনি ধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এ জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নয়, গর্দান কেটে নয়, আগুনে পুড়িয়ে! বিচারকের তেমনই হুকুম—তাঁর রক্তের এক ফোঁটাও যেন পৃথিবীর সঙ্গে না মেশে। পুড়িয়ে মারলে তো আর রক্ত পৃথিবীতে মিশতে পারবে না।

ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চে। ভারী লোহার শিকলে তাঁর হাত-পা বাঁধা। জিবও বেঁধে রাখা হয়েছে। বিচারকদের বড্ড ভয়, কী জানি মৃত্যুর আগে ব্রুনো কোন সত্যি কথা বলে যান! দণ্ড কার্যকরের ঠিক আগ মুহূর্তে ব্রুনোকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বেঁচে থাকার। এ জন্য তাঁকে দোষ স্বীকার করতে হবে। বলতে হবে, তিনি যা বলেছেন ভুল। ব্রুনো মাথা নত করে বাঁচতে চাননি। এরপর তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হাত-পা, নাক-মুখে আগুন লেগে যায়, চুল-দাড়িও জ্বলে ওঠে। তবু মরার আগে একবারও আর্তচিত্কার বেরোয়নি ব্রুনোর মুখ দিয়ে।

কী এমন অপরাধ করেছিলেন ব্রুনো! তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী সৌরজগতের তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া এর আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। পৃথিবী ও বিশ্বজগত্ চিরস্থায়ী নয়, একদিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে।

তোমরা হয়তো হাসছ। ভাবছ, এ তো সত্যি কথা। এর জন্য ব্রুনোকে মরতে হলো কেন? হ্যাঁ, একালের ছেলেমেয়েরা যে সত্যিটা জানে, তখনকার বাঘা বাঘা পণ্ডিত আর ধর্মযাজকদেরও এই জ্ঞানটুকু ছিল না। ওরা মনে করত পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সব গ্রহ-নক্ষত্র। বাইবেলে নাকি এমন কথাই লেখা ছিল। তাই ব্রুনো যা বলছেন সবই ধর্মবিরোধী। তাদের আশঙ্কা, ব্রুনোর মতবাদ ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবী ধর্মহীন হয়ে পড়বে, সব মানুষ পরিণত হবে শয়তানে। তাই ব্রুনোকে হত্যার এই বিশাল আয়োজন। অথচ ব্রুনোর সেই সত্যির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী।

গ্যালিলিও

গ্যালিলিও অন্ধ। যে চোখ দুটো দিয়ে তিনি দুরবিনে মহাকাশ আর নতুন নতুন গ্রহ-উপগ্রহ দেখেছেন, সেই চোখ দুটিই এখন অন্ধকার। আট বছর ধরে বন্দী। বয়স আশির কোঠায়। শরীর ভেঙে পড়েছে। জীবনের এই শেষ মুহূর্তে যদি আপনজনদের পাশে পেতেন। তা হওয়ার জো নেই। যাজকেরা তাঁর কাছে কাউকে ভিড়তে দেবে না। এভাবে আর কদ্দিন? ধীরে ধীরে অবহেলায়, বিনা চিকিত্সায় মারা গেলেন তিনি। একদিকে অবশ্য ভালোই হয়েছে, পেয়েছেন দীর্ঘ আট বছরের দুর্বিষহ বন্দিজীবন থেকে মুক্তি।

কী এমন দোষ করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী? তিনি কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রচার করেছিলেন। বলেছিলেন, ব্রুনোকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে মূর্খ যাজকেরা। এ জন্য তাঁকে একবার মাফ চাইতে হয়েছিল। ওয়াদা করতে হয়েছিল, চার্চ ও বাইবেলবিরোধী কিছু বলবেন না। কিন্তু সে কথা রাখতে পারেননি গ্যালিলিও। জ্বলজ্বলে তারার মতো সত্যকে তিনি কীভাবে মিথ্যা বলবেন? কীভাবে অসত্যের অন্ধকারকে আলো বলে চালিয়ে দেবেন। গ্যালিলিও সত্যের জয়গান গেয়েছিলেন আজীবন। বলেছিলেন সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে ধুঁকে অবশেষে মারা যান গ্যালিলিও।

লুইস স্লটিন

১৯৪৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করেন বিজ্ঞানী লুইস স্লটিন। ম্যানহাটন প্রজেক্ট হলো যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা গবেষণাকেন্দ্র। এখান থেকে তৈরি বোমা দিয়েই আঘাত করা হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। স্লটিন খ্যাপাটে টাইপের লোক। তিনি তেজস্ক্রিয় পরমাণু নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। পারমাণবিক বোমার অন্যতম উপাদান তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম। কিন্তু প্লুটোনিয়াম যেখানে-সেখানে রাখলেই তা বিস্ফোরিত হবে না। এর জন্য নির্দিষ্ট ভরের প্লুটোনিয়াম একসঙ্গে রাখতে হয়। এ ভরকে বলে ক্রিটিক্যাল মাস।

ম্যানহাটনে কোনো জারেই ক্রিটিক্যাল ভরের সমান প্লুটোনিয়াম রাখা হয় না। ওই পরিমাণ প্লুটোনিয়ামকে দুটি ভাগে ভাগ করে আলাদা জারে রাখা হতো। যাতে ওগুলো বিক্রিয়া করে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে না পারে। কিন্তু স্লটিনের ছিল বদখেয়াল। তিনি প্রতিদিন একবার করে প্লুটোনিয়াম নিয়ে খেলতেন। এক জারে রাখা প্লুটোনিয়াম আরেক জারের প্লুটোনিয়ামের ভেতরে ঢালতেন। এতে দুই জারের প্লুটোনিয়াম একসঙ্গে হয়ে ক্রিটিক্যাল ভরে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্লটিন ছিলেন খুব সতর্ক। একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি জারের ভেতর একটা স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে খানিকটা প্লুটোনিয়াম আলাদা করে ফেলতেন। তাতে প্লুটোনিয়াম আর ক্রিটিক্যাল ভরে পৌঁছাতে পারত না। তাই নিরাপদেই খেলাটা দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন স্লটিন।

কিন্তু একদিন এ খেলার করুণ সমাপ্তি ঘটল। সেদিন স্লটিন সময়মতো জারের ভেতর স্ক্রু ড্রাইভার ঢোকাতে পারলেন না। তাতেই ক্রিটিক্যাল ভরে পৌঁছে শুরু হলো ভয়াবহ পারমাণবিক বিক্রিয়া। জারের ভেতর থেকে ঝলসে উঠল নীল আলোর বিকিরণ। খুবই ভয়ংকর সেই বিকিরণের শক্তি। মুহূর্তেই আগুনের হলকায় ঝলসে গেলেন স্লটিন। ঝলসে গেলেন সেখানে উপস্থিত বেশ কজন বিজ্ঞানীও। অন্যদের অবস্থা অত মারাত্মক নয়। এ দুর্ঘটনার পর স্লটিন দুদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সেই দুদিন না বাঁচলেই বরং কষ্ট কম হতো তাঁর। তাঁর শরীর ভেতর থেকে ঝলসে গিয়েছিল। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান।

ম্যাক্স ভন লু

ম্যাক্স ভন লু। ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। জন্ম ১৮৭৯ সালে। ১৯৬০ সালে বয়স ৮১ বছর তাঁর। এ বয়সে মানুষ মরতেই পারে। কিন্তু লুর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। জার্মানির গটিনজেন শহরে থাকতেন তিনি। একদিন গাড়ি চালিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। হঠাত্ এক আনাড়ি বাইকচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারেন লুর গাড়িতে। বাইকের আরোহী ঘটনাস্থলেই মারা যান। লুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। দুদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শেষ পর্যন্ত হার মানেন তিনি। সদ্য লাইসেন্স পাওয়া এক মোটরবাইকচালকের ভুলে প্রাণ যায় মেধাবী এই বিজ্ঞানীর।

তথ্যসূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট