কেমন হতে পারত আমাদের পর্যায় সারণি

বিজ্ঞানজগতের মৌলগুলোর পথচলা যেন শুরু হয় পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি থেকে। গবেষণাগার থেকে শুরু করে একজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর পড়ার টেবিল—সব স্থানেই দেখা মিলবে এই সারণির। ১৮৬৯ সালের দিকে ৬৩টি মৌল নিয়ে প্রথম পর্যায় সারণি তৈরি করেন দিমিত্রি ম্যান্ডেলিভ। মৌলগুলোর রাসায়নিক ও বাহ্যিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে এই সারণিতে সেগুলোর অবস্থান ঠিক করেন তিনি। একটা সাধারণ কার্ড পেপারে কতগুলো সারি ও কলাম মিলিয়ে এই সারণি তৈরি করেন তিনি। যার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে আধুনিক সময়ের পর্যায় সারণি। ম্যান্ডেলিভের বানানো পর্যায় সারণির দেড় শ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৯ সালকে ‘ইন্ট্যারন্যাশনাল ইয়ার অব পিরিয়ডিক টেবিল’ ঘোষণা করে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিউর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ক্যামিস্ট্রি।

তবে ইতিহাসের সেই কালজয়ী পর্যায় সারণি কিন্তু এত সহজে এই আধুনিক সময়ে এসে পৌঁছায়নি। আবার ম্যান্ডেলিভের আগেও যে কেউ পর্যায় সারণি নিয়ে কাজ করেননি, তেমনটা কিন্তু নয়। তার এই সাজানো পর্যায় সারণি মানুষের হাতে উঠে আসার কয়েক দশক আগেই রসায়নবিদ জন ডাল্টন এ চেষ্টা করেন। ডাল্টন অবশ্য মৌলগুলোর নামের পরিবর্তে আলাদা আলাদা চিহ্ন ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। এমনকি এরপরও জন নিউল্যান্ডস নামের আরেক রসায়নবিদ এই পর্যায় সারণি বানানোর চেষ্টা করেন।

তাঁদের সবার পর্যায় সারণি তৈরির ধারণা একই রকম থাকলেও দিমিত্রি ম্যান্ডেলিভ তাঁর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন অন্য এক পথে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আরও মৌল আবিষ্কার করা বাকি। তাই তিনি ডাল্টন বা নিউল্যান্ডসের মতো মাত্র ৬৩টি মৌল নিয়েই চিন্তা করেননি। বরং ওইগুলো বাদে আর কোনো মৌল আবিষ্কৃত হতে পারে, সেটা আন্দাজ করে সেগুলোর জন্য জায়গা ফাঁকা রেখেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তী সময়ে নতুন মৌল আবিষ্কার হলে সেগুলো ম্যান্ডেলিভের নিয়ম মেনেই পর্যায় সারণিতে জায়গা করে নেয়।

এ জন্য ম্যান্ডেলিভের কার্ডবোর্ডে বানানো পর্যায় সারণির বিভিন্ন ঘরে ‘?’ চিহ্ন দেখা যায়। যেমন তাঁর পর্যায় সারণিতে  অ্যালুমিনিয়ামের (১৩) পরের ঘর ফাঁকা ছিল। ম্যান্ডেলিভ বলেছিলেন, এখানে এমন একটি মৌল থাকবে, যার পারমাণবিক ভর হবে ৬৮, ঘনত্ব হবে প্রতি গ্রামে ৬ ঘন সেন্টিমিটার। যার গলনাঙ্কও হবে বেশ কম। এর ৬ বছর পরেই রসায়নবিদ পল এমেল লেকক ড্যা বইসবাউদ্রান গ্যালিয়াম আবিষ্কার করেন। এর পারমাণবিক ভর হচ্ছে ৬৯.৭, ঘনত্ব ৫.৯ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার এবং এর গলনাঙ্ক এতই কম যে এটা আপনার হাতেই তরল অবস্থায় থাকে। ম্যান্ডেলিভের এই পন্থা স্ক্যান্ডিয়াম (২১), জার্মেনিয়াম (৩২) ও টেকনেশিয়ামের (৪৩) ক্ষেত্রেও সফলভাবে ঘটে। এই মৌলগুলো ম্যান্ডেলিভের মৃত্যুর ৩০ বছর পর আবিষ্কার হলেও ঠিকই তার নিয়ম মেনে পর্যায় সারণিতে জায়গা করে নেয়।

ম্যান্ডেলিভের এই পর্যায় সারণি কিন্তু আধুনিক পর্যায় সারণির মতো ছিল না। তাঁর সারণিকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিলেই এখনকার পর্যায় সারণির মতো দেখায়। যেমন হ্যালোজেন গ্রুপের মৌলগুলো ম্যান্ডেলিভের টেবিলে পাশাপাশি থাকলেও, সেটাকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে ডিগ্রি গোটা গ্রুপটাই আধুনিক পর্যায় সারণির মতো লম্বালম্বিভাবে বসে।

ম্যান্ডেলিভের পর্যায় সারণি উদ্ভাবনের পরও কিন্তু থেমে থাকেনি বিজ্ঞানীদের খোঁজ। আরও ভালোভাবে কীভাবে মৌলগুলোর ধর্ম সহজে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করে গেছেন তাঁরা। এ জন্য আলাদা আলাদা নকশায় পর্যায় সারণি বানানোর চেষ্টা করেছেন অনেকে। সেগুলোর কিছু তো একেবারেই অন্য রকম। আবার কোনোটা ত্রিমাত্রিক নকশায় বানানো হয়েছে।

এগুলোর ভেতরে চমৎকার একটি নকশা উপস্থাপন করেন হেনরিকা বামহায়ের সর্পিলাকার পর্যায় সারণি। ১৮৭০–এর দশকে তিনি এটি প্রকাশ করেন। তার এই বিশেষ আকৃতির পর্যায় সারণিতে কেন্দ্রে বসানো হয়েছে হাইড্রোজেন। প্রতি বৃত্তাকার চক্র অতিক্রম করলেই সেটাতে পারমাণবিক ভর অনুসারে মৌলের গ্রুপ বদলে যায়। ১৮৯২ সালে তিনি ‘ডাম্ব–বেল’ আকৃতির পর্যায় সারণিও প্রকাশ করেন।

তবে এত আজব পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই পর্যায় সারণিকে আধুনিক সময়ের মতো সাজিয়ে আনা হয়। এ ধাপে এসে নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোকে একটি আলাদা গ্রুপে পর্যায় সারণিতে দেখানো হয়। এই মডেলের শুরু থেকেই কাজ করে আসছিলেন হেনরিক ওয়েরনার নামের এক রসায়নবিদ। তবে এরপরও আবার কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পর্যায় সারণি তৈরি করার চেষ্টা করেন রসায়নবিদ চার্লেস জ্যানেট। তিনি বাঁ পাশ থেকে মৌলগুলোকে সাজানো শুরু করেন। এ উপায়ে সাজানোর ফলে জ্যানেটের সারণিতে ১২০টি মৌলের জায়গা ফাঁকা থাকে। এ পর্যন্ত ১১৮টি মৌল আবিষ্কার করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।

চার্লেস জ্যানেটের এই নকশা অনুকরণেই তৈরি হয় আধুনিক পর্যায় সারণি। ক্ষারীয় গ্রুপ ও ক্ষারীয় মৃত্তিকা গ্রুপের মৌলগুলোকে একেবারে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে পর্যায় সারণিকে আরও বড় দেখাচ্ছিল। এ কারণে এটাকে কোনো পোস্টার, কাগজে সহজে প্রিন্ট করা যেত না। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে এফ–ব্লক মৌলগুলোকে আলাদাভাবে নিচে সাজিয়ে দেওয়া হয়। এত সব পরিবর্তন শেষেই উঠে আসে আজকের আধুনিক পর্যায় সারণি। এরপর নানা রকম ত্রিমাত্রিক মডেলে এসব পর্যায় সারণিকে সাজানো হলেও বিজ্ঞান গবেষণায় আজও মানুষের চিরসঙ্গী দিমিত্রি ম্যান্ডেলিভের বানানো সেই পর্যায় সারণি।

সূত্র: পপ সায়েন্স