ঝোলায় তাঁর একাত্তরের গল্প

গেল জানুয়ারি মাসের এক ভরদুপুরের ঘটনা। শীতের মিষ্টি রোদে স্কুলের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা। আগের দিন ছিল বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। তাই সেদিন ক্লাসের চাপ একটু কম। তখনই হঠাত্ খদ্দরের পাঞ্জাবির ওপর শাল জড়ানো প্রবীণ একটা লোক ঢোকেন স্কুলে। তাঁর কাঁধে ঝোলা, বগলে একটা সাদা বোর্ড আর বোর্ডের স্ট্যান্ড। কিছু সময়ের মধ্যে দাপাদাপি করা স্কুলের মেয়েরা কৌতূহল নিয়ে ওই লোককে ঘিরে ধরে।

মেয়েরা কেউ আঙ্কেল, কেউ দাদু সম্বোধন করে জানতে চায়, ঝোলাব্যাগের মধ্যে কী? লোকটা কিছুটা রহস্যভরে বলতে শুরু করেন, ব্যাগের ভেতর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। উত্তর শুনে অনেকটা স্তব্ধ চারদিকে ঘিরে থাকা মেয়েরা। লোকটা স্তব্ধতা ভেঙে বলেন, ‘আমার নাম বিমল পাল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সামান্য যোদ্ধা আমি।  আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে। তোমরা শুনবে?’ চারদিকে ঘিরে থাকা মেয়েরা একবাক্যে রাজি।

বিমল পাল বলতে শুরু করেন, তখন ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। চারদিকে গোলাবারুদের গন্ধ, মানুষের উত্কণ্ঠা আর আর্তনাদ। পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে হত্যার বর্বরতম ‘উত্সবে’ মেতে ওঠে। তাদের বর্বরতা দেখে বাঙালি সব বয়সী মানুষের রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে। স্কুলের মেয়েরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে। তা বুঝে বিমল পাল গল্প বলার আসল মজাটা অনুভব করেন।

বিমল পালের গল্পে মশগুল শিক্ষার্থীরা
বিমল পালের গল্পে মশগুল শিক্ষার্থীরা

তিনি বলতে থাকেন, ‘...আমাদের ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের কালাকুমার গ্রামে বাস করত ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর। নাম ইদ্রিস। একাত্তরের ২২ মে পাক সেনারা নকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে সীমান্তবর্তী ভারতের ঢালু বাজারে আক্রমণ করে। এ সময় শামছুল হক, ওজিউল্লাহ, মেহবাজসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনীকে প্রতিহত করতে চাইলেও পারেনি। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ ও ভারতের ঢালু বাজারে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। প্রাণ হারায় কালাকুমার গ্রামের কিশোর ইদ্রিসের বাবা-মা। ইদ্রিস তার ছোট বোনকে নিয়ে পালিয়ে যায় ভারতের সীমান্তে। সেখানে তার আশ্রয় হয় মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হকের কাছে। শামছুল হক ইদ্রিসের সব কথা শুনে পুত্রস্নেহে বুকে জড়িয়ে নেন। ইদ্রিস জানায়, সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চায়। পরে শামছুল হক ইদ্রিসকে তার সহকারী হিসেবে সঙ্গে রেখে অস্ত্র চালানো শেখায়। শুধু পেছনে নয়, সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাক সেনাদের মেরে বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় ইদ্রিস। এরপর আসে ৩ নভেম্বর হালুয়াঘাটের বিখ্যাত তেলিখালী যুদ্ধের কথা। ২ নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা “আক্রমণ করো এবং দখল করো” নীতিতে প্রস্তুত। তেলিখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের সব বাংকার দখলের জোর চেষ্টা চালাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। তখন ভোর। সবকিছু আবছা আবছা দেখা যায়। ৩৩ পাঞ্জাবের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের পাকিস্তানিদের বাংকারটি দখলে আনতে গুলি করছে শামছুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা। সঙ্গে কিশোর ইদ্রিস। গোলাগুলির শব্দে আকাশ কাঁপছে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটাই লক্ষ্য, “আজ সব কটাকে মেরে ওদের বাংকার দখল করতে হবে।” হঠাত্ একটা গুলি শামছুল হকের ডান হাতের কনুইয়ে লাগে। গুলিটা কনুই ভেদ করে লাগে ইদ্রিসের বুকে। ইদ্রিস লুটিয়ে পড়ে। যুদ্ধাহত শামছুল ইদ্রিসকে বুকে চেপে ধরে একটু আড়াল হয়। ইদ্রিস কিছু একটা বলতে চাইলেও বলা হয়নি। তার আগেই সে মারা যায়।’

ছবি এঁকে ঘটনাস্থল সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন বিমল পাল
ছবি এঁকে ঘটনাস্থল সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন বিমল পাল

বিমল পাল বলেন, ‘ইদ্রিস কী বলতে চেয়েছিল, সেটা বলতে না পারলেও শামছুল হকসহ আমরা ধরে নিয়েছিলাম সে বলেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’

ভোর ৪টা ৫৫ মিনিট থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ শেষ হয় চার ঘণ্টা পর। যুদ্ধে ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৫৬ জন। আর দুই প্লাটুন পাকিস্তানি সেনার একজন বাদে সবাই মারা পড়ে। সঙ্গে প্রায় সমসংখ্যক রাজাকার (ইতিহাসে আছে ২৩৭ জন)। ওই দিনই বাংলাদেশের প্রথম এলাকা হিসেবে হালুয়াঘাট স্বাধীন হয়।

বিমল পাল উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমিও বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। তখন আমার বয়স মাত্র ১৮।’ তিনি অবলীলায় বলে যান, ‘তেলিখালী যুদ্ধে আমি মাত্র দুটি গুলি করতে পেরেছিলাম। দুটি গুলিই ছিল লক্ষ্যভ্রষ্ট। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার এই আক্ষেপ এখনো আছে।’

পাঁচ বছর আগে বিমল পাল শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প ফেরি করা। প্রথমে তিনি ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের পারে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার পাশের জয়নুল পার্ক আর বিপিন পার্কে গল্প বলতেন। পার্কে বেড়াতে আসা শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষকে ডেকে এনে তিনি শোনাতেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এরপর দুই বছর আগে তিনি শুরু করেন স্কুলে স্কুলে গিয়ে শ্রেণিকক্ষে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা। গল্প বলার সময় তিনি সঙ্গে রাখেন একটি সাদা বোর্ড। শিক্ষার্থীরা কখনো গল্প বুঝতে না পারলে তিনি বোর্ডে মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ এঁকে, কখনো উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিক এঁকে যুদ্ধের বর্ণনা দেন। গত দুই বছরে তিনি ময়মনসিংহ জেলা শহরের প্রায় সব স্কুলেই বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এখন শুরু করেছেন উপজেলা পর্যায়ের স্কুলে গল্প বলা। বিমল পাল কিশোর আলোর পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে আমি সবচেয়ে বেশি সুখ পাই। যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন বলে যেতে চাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প।’ কেউ আমন্ত্রণ জানালে দেশের যেকোনো জেলা গিয়ে গল্প বলতেও তিনি রাজি।

স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিক্ষার্থীদের বাঙালির বীরত্বের গল্প শোনাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল
স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিক্ষার্থীদের বাঙালির বীরত্বের গল্প শোনাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল

গল্প বলা ছাড়াও বিমল পাল লিখেছেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের তেলিখালী যুদ্ধের ওপর ছোট একটা বই। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চের মতো জাতীয় দিবসগুলোয় তিনি যখন ঘর থেকে বের হন, তখন ওই ঝোলায় থাকে সেই বই। বইয়ের নির্দিষ্ট কোনো দাম নেই। সু্কলপড়ুয়া কেউ যদি টিফিনের টাকা থেকে মাত্র দুই টাকা দিয়ে বইটি কিনতে চায়, তিনি তাতেই খুশি। দুই টাকা নেওয়ার বিষয়ে বিমল পাল বলেন, ‘আমি চাই খুদে শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব বুঝুক। বিনা টাকায় বই পেলে সেটার গুরুত্ব কম হয়। টিফিনের টাকা থেকে কোনো শিক্ষার্থী যখন দুই টাকা দিয়ে আমার বইটি কেনে, তখন আনন্দে আমার বুক ভরে যায়। মনে হয়, যে বইটি কিনেছে, সেই নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।’

বিমল পাল থাকেন ময়মনসিংহ শহরের বলাশপুর মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত এক বাড়িতে। শহরের থানারঘাট এলাকায় তাঁর একটি দোকান আছে। দিনের বেশ কিছু সময় তিনি দোকানে বসেন। বাকি সময় তাঁর ছেলেরা দোকান দেখে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে বলতে বিমল পাল এখন মুক্তিযুদ্ধের ‘গল্পের ফেরিওয়ালা’ নামে ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহের বাইরে পরিচিতি পেয়েছেন।