মঙ্গলেই হবে জঙ্গল

মঙ্গল গ্রহ নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। মঙ্গলে বসতি স্থাপনের ঘোষণায় সে আগ্রহে পেয়েছে নতুন মাত্রা। সম্ভাব্য বসতি আর সেখানকার জীবনযাত্রা নিয়ে কল্পনার ডানায় চেপে তৈরি হতে শুরু করেছে দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার আর রোমহর্ষক সব ছবি। আলোচিত মার্সিয়ান ছবির কথা নতুন করে আর কী বলব! এখন বড় বড় দেশ সেখানে বসতি স্থাপন করতে চাইছে। সে জন্য আবেদনও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বসবাসের অযোগ্য মঙ্গলে মানুষ কীভাবে থাকবে? আর তাকে বাসযোগ্য করা হবে কীভাবে?

অনেকেই জানো, চাঁদের মতো মঙ্গল নিয়েও রুশ-মার্কিন প্রতিযোগিতা অনেক পুরোনো। সেই ইতিহাসের কাসুন্দি বাদ দিয়ে বরং এবার ভবিষ্যতের দিকে তাকানো যাক। ২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষের পদচিহ্ন আঁকার পরিকল্পনা নাসার। নাসার মঙ্গল গ্রহ-বিষয়ক গবেষণাগারের সহকারী প্রকল্প বিজ্ঞানী অশ্বিন ভাসাভাদা বলেন, মঙ্গলে বসতি গড়ে তুলতে হলে এর উত্তরাঞ্চলে স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু চাইলেই কি সেটি সম্ভব? এসো বিষয়টি চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যাক।

এই উষর লাল গ্রহকে একটি সবুজ গ্রহে রূপান্তরের জন্য নানান পরিকল্পনা এঁটেছেন গবেষকেরা
এই উষর লাল গ্রহকে একটি সবুজ গ্রহে রূপান্তরের জন্য নানান পরিকল্পনা এঁটেছেন গবেষকেরা

লাল গ্রহ নামধারী মঙ্গলে বসতি স্থাপনের কথা ভাবলেও এখনো একগাদা সমস্যা আর চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন বিজ্ঞানীরা। প্রথমেই আসি গ্রহটির ঋতুর কথায়। অক্ষরেখার কারণে পৃথিবীর মতো মঙ্গলেও ঋতু বদলায়। পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্য থেকে দূরে হওয়ায় সেখানটায় সব সময় ঠান্ডা থাকে উত্তরের তুলনায়। তেমনি মঙ্গলের বিভিন্ন অংশেও তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। আবার সূর্য থেকে দূরে হওয়ার কারণেও গ্রহটিতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। তাই মানুষের জন্য মঙ্গল খুব একটা মঙ্গলজনক নয়। সেখানে কোনো বাতাস বা অক্সিজেনও নেই। তাই মঙ্গলে নেমেই অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করতে হবে মানুষকে। (অবশ্য সে জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার তো থাকবে।) এ ছাড়া মঙ্গলে আছে অবিরাম বিকিরণ প্রবাহ। আছে শক্তিশালী ধূলিঝড়। এ ঝড় এতই শক্তিশালী যে মাঝেমধ্যে তা পুরো পৃথিবীকে কয়েক দিন ধুলোর আস্তরণে ঢেকে দিতে পারবে! তাই মানুষের জন্য টিকে থাকাটা বেশ মুশকিল সেখানে।

এ গ্রহের মাটি বিষাক্ত আর চাষাবাদের অনুপযোগী। তাই মানুষ পৌঁছে গেলেও আপাতত খাদ্য নিয়ে সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। তাই মঙ্গলে থাকতে গেলে পৃথিবী থেকে পর্যাপ্ত খাবার, অক্সিজেন আর ওষুধ সরবরাহের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। নইলে সেখানে গিয়ে থাকার ইচ্ছা আর স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া একই কথা হবে।

বিশেষ গ্রিনহাউসে মঙ্গল গ্রহে প্রাথমিকভাবে চাষবাসের কথা ভাবা হচ্ছে। এভাবেই মিটবে মঙ্গলবাসীর খাবারের চাহিদা
বিশেষ গ্রিনহাউসে মঙ্গল গ্রহে প্রাথমিকভাবে চাষবাসের কথা ভাবা হচ্ছে। এভাবেই মিটবে মঙ্গলবাসীর খাবারের চাহিদা

সমস্যা আরও রয়েছে। মঙ্গলের মধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর চেয়ে কম। ফলে বছরের পর বছর যাঁরা সেখানে থাকবেন, তাঁরা পৃথিবীর মানুষের চেয়ে কম আয়ু পাবেন। আবার সেখানে বায়ুচাপ একেবারেই নেই। এর সমাধান করতে না পারলে মঙ্গলে বাস করার চিন্তা দূরে সরিয়ে রাখাই ভালো। এসব সমস্যা মাথায় রেখেই কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা গ্রহটিকে বাসযোগ্য করতে প্রযুক্তি ও ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন। ২০৩০ সালে মঙ্গলে মনুষ্যবসতি গড়ে তুলতে নাসা তাদের পরিকল্পনা ৩৬ পাতার এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে গত বছর। যেখানে বলা হয়েছে, নভোচারীরা মঙ্গলে অবস্থান করে গ্রহটিকে বাসযোগ্য করতে কাজ করবেন। কিন্তু কীভাবে সমাধান হবে এসব?

মঙ্গলে শুধু সমস্যাই নয়, কিছু সুবিধাও রয়েছে। যেমন মঙ্গলের মাটির নিচেই আছে বিপুল পরিমাণ জমাট বাঁধা পানি (বিশেষত দক্ষিণ মেরুতে)। এর সঙ্গে মিশে আছে ড্রাই আইস আর জমাট কার্বন ডাই-অক্সাইড। কোনোভাবে এ জমাট বাঁধা পানি গলানো সম্ভব হলে পুরো মঙ্গলগ্রহ ১১ মিটার পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পরিমাণমতো পানি আর কার্বন ডাই-অক্সাইড গলানো হলে মঙ্গলের আবহমণ্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন হবে। তাতে মঙ্গলের বুকে প্রথমবারের মতো বয়ে যাবে বাতাস, যার গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৪০০ কিলোমিটার। এভাবে একসময় (মানে প্রায় ১০০ বছরে) মঙ্গলের ধূলি আর পানির কণা মিলেমিশে অনেকটা পৃথিবীর মতোই মেঘের সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ ধীরে ধীরে বাড়বে। এদিকে মঙ্গলের জমাট কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মাটিতে (ধাতুর অক্সাইড হিসেবে) মিশে আছে বিপুল অক্সিজেন। গ্রহটিতে অক্সিজেন জোগাতে ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতিতে পানি থেকে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন আলাদা করার কথা ভাবছেন গবেষকেরা। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইডে বেঁচে থাকতে সক্ষম ফাইটোপ্ল্যাংকটন নামের বিশেষ এক খুদে উদ্ভিদ ব্যবহার করেও মাটি থেকে অক্সিজেন অবমুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

মঙ্গলের ধূসর বুকে একদিন এভাবেই সবুজ জঙ্গলে ভরে যাবে। তবে সে জন্য সময় লাগবে অন্তত এক হাজার বছর
মঙ্গলের ধূসর বুকে একদিন এভাবেই সবুজ জঙ্গলে ভরে যাবে। তবে সে জন্য সময় লাগবে অন্তত এক হাজার বছর

বুঝতেই পারছ, মঙ্গলের তাপমাত্রা বাড়ানোর ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। হয়তো ভাবছ, মঙ্গলের তাপমাত্রা বাড়ানো হবে কীভাবে? তাপমাত্রা বাড়াতে বেশ কিছু পরিকল্পনা এঁটেছেন গবেষকেরা। এর মধ্যে প্রধানটি হচ্ছে অ্যামোনিয়া, মিথেন, ফ্লোরিনসহ গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যবহার। জানোই তো, এসব গ্যাসের কারণেই পৃথিবী দিনকে দিনে উষ্ণ হয়ে আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ঠিক এ পদ্ধতিই শাপে বর হবে মঙ্গলে। বিজ্ঞানীরা কোনোভাবে মঙ্গলের বুকে এসব গ্যাস ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি গ্রহটির কক্ষপথে বিশাল আয়না লাগানোর কথাও ভাবা হচ্ছে। এতে সূর্যের আলো মঙ্গলে প্রতিফলিত করে তাপমাত্রা সরাসরি বাড়ানো সম্ভব। তাহলেই একসময় সেখানকার মাটির নিচে চাপা পড়া জমাট বরফ আর কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে। তাতে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বদলে যাবে মঙ্গল। এভাবেই শেষ হবে গ্রহটিতে বসতি স্থাপনের প্রথম পর্যায়।

এরপর শুরু হবে আরও ১০০ বছরের কর্মসূচি। এ পর্যায়ে প্রথমবারের মতো মঙ্গলে ঝরে পড়বে সামান্য বৃষ্টি। তবে তখনো রবিঠাকুরের ‘বাদলা দিনের মাতাল হাওয়ায়’...গানটি গাওয়ার মতো অবস্থা হবে না। কিন্তু এই বৃষ্টির কারণেই ধীরে ধীরে মঙ্গলে বিভিন্ন অণুজীব, শৈবাল বা খুদে উদ্ভিদ জন্মানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে। প্রথম একটু সবুজের ছোঁয়া পাবে মঙ্গল। সেখানকার মাটিও আস্তে আস্তে জৈবযৌগে সমৃদ্ধ হতে থাকবে। এভাবেই কেটে যাবে আরও ৪০০ বছর। তারপরই প্রথমবারের মতো ফুলধারী গাছ জন্ম নেবে। ফুটবে ফুলও। ধীরে ধীরে অন্য গাছপালাও মাথা তুলতে শুরু করবে মঙ্গলের বুকে। সবুজ জঙ্গলে পরিণত হতে থাকবে মঙ্গল। এ সময়েই গ্রহটিতে চাষবাস করে কিছুটা খাদ্য উত্পাদনের আশা করছেন গবেষকেরা।

এরও ৩০০ বছরে মঙ্গলে শহর গড়ার মতো শক্তি উত্পাদিত হবে। সে জন্য স্থাপিত হবে পারমাণবিক চুল্লি আর বাতাসচালিত টারবাইন। এর ১০০ বছরে সেখানে কিছু অক্সিজেন তৈরি হয়ে যাবে। বায়ুচাপও থাকবে মানুষের উপযোগী। তাই স্কুবা ডাইভিংয়ে ব্যবহূত ছোট অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে দিব্যি দাপিয়ে বেড়াতে পারবে মানুষ। এভাবেই মোটামুটি এক হাজার বছরের মধ্যে একটি আপাদমস্তক লাল গ্রহ পরিণত হবে পৃথিবীর মতোই সবুজ গ্রহে। তখন মঙ্গলের জন্যও আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারব, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গ্রহ।

তথ্যসূত্র: স্পেস ডটকম, ইউনিভার্স টুডে ডটকম, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক