সময়তরিতে সময়ে ঘোরাফেরা

আজ থেকে ছয়-সাত লাখ বছর আগের পৃথিবীটা দেখতে কিন্তু আজকের মতো ছিল না। বর্তমানে আমরা যে প্রাণীদের দেখি, এগুলোর অনেক কিছুই ছিল না তখন। তার বদলে সারা দুনিয়ায় রাজত্ব ছিল বিশাল বিশাল ডাইনোসরের। এদের দৈত্য বললেও মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না। ভাবো তো, কোনোভাবে যদি সেই প্রাচীন পৃথিবীকে ফিরে যাওয়া যেত! কিংবা ধরো, শায়েস্তা খানের আমলে চলে গেলে। তারপর এক টাকায় আট মণ হিসেবে রাশি রাশি চাল কিনে ফিরে এলে। তারপর তো পায়ের ওপর পা তুলে বাকি জীবন বসে খাওয়া! তাহলে এর চেয়ে মজার আর কীই-বা হতে পারে! কিন্তু আসলেই কি সেই সময়ে চলে যাওয়া যাবে?

একসময় এভাবে অতীত বা ভবিষ্যতে ভ্রমণ করার বিষয়গুলোকে অসম্ভব মনে করা হতো। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিতে এ ধরনের গল্প শোনা গেলেও এগুলোকে গল্প ছাড়া বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেওয়া হতো না। বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, সময় হলো একদম পরম জিনিস। অর্থাত্, যার কোনো পরিবর্তন নেই। সময় সম্পর্কে এমন ধারণা তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বিজ্ঞানী নিউটন। নিউটনের মতে, পৃথিবীতে এক সেকেন্ড অতিবাহিত হলে সমগ্র মহাবিশ্বেই ঠিক এক সেকেন্ড অতিবাহিত হবে। কিন্তু জার্মান পদার্থবিদ আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে সময় সম্পর্কে পুরো ধারণাই পাল্টে দিলেন। তাঁর তত্ত্বের গণনা থেকে দেখা গেল, কেউ যদি আলোর গতির কাছাকাছি বেগে ছুটতে শুরু করে, তবে বিস্ময়করভাবে তার সময় ধীর হয়ে যাবে!

জনপ্রিয় ছবি ব্যাক টু দ্য ফিউচারে আছে টাইম মেশিনের গল্প
জনপ্রিয় ছবি ব্যাক টু দ্য ফিউচারে আছে টাইম মেশিনের গল্প

তুমি যদি সাইকেল নিয়ে ছুটতে শুরু করো, তবু তোমার সময় ধীর হবে। কিন্তু সেই প্রভাব এতই ক্ষুদ্র যে তা বোঝা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি আলোর গতির কাছাকাছি বেগের কোনো রকেটে চেপে ঘুরে আসে, তবে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটবে। ধরো, তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। তোমার ইচ্ছা হলো কোনো দ্রুতগামী রকেটে চড়ে কিছুদিন ঘুরে আসবে। তুমি আলোর গতির ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেগে ছুটতে পারে, এমন এক রকেটে বছর খানেক ঘুরে এলে। ফিরে এসে যা দেখবে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য! রকেটে থাকার কারণে তোমার বয়স মাত্র এক বছর বাড়বে। কিন্তু ফিরে এসে তোমার সহপাঠীদের কাউকেই আর জীবিত দেখবে না। আর যারা বেঁচে আছে, তারা এতটাই বৃদ্ধ হবে যে তুমি কাউকেই চিনতে পারবে না। কারণ, এই এক বছরের মধ্যে পৃথিবীতে কেটে গেছে ৭০টি বছর। এগুলো শুনতে আশ্চর্য শোনালেও বিজ্ঞান এমনই বিস্ময়কর।

আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আইনস্টাইন
আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আইনস্টাইন

কীভাবে ভবিষ্যতে পাড়ি দেওয়া যাবে সে তো জানা হলো। কিন্তু তাহলে কি অতীতেও যাওয়া যাবে? ভবিষ্যতে যাওয়াটা বৈজ্ঞানিক সত্য হলেও অতীত ভ্রমণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কেউ বলেন, অতীতে ভ্রমণ করা যাবে। আর কেউ বলেন সম্ভব নয়। তবে আশার কথা—আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণে এমন কিছু অনুসিদ্ধান্ত আছে, যেগুলো থেকে দেখা যায় ভ্রমণ সম্ভব। এ নিয়ে এখনো কিছু বিতর্ক থাকলেও কিপ থর্ন, রিচার্ড গট, সার্জেই ক্রাসনিকভ, মিচিও কাকুর মতো পদার্থবিদেরা অতীত ভ্রমণের জোরালো সমর্থক। সম্প্র্রতি প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত হয়েছে। টাইম ট্রাভেলের সমর্থকেরা অনেকেই বলছেন, এ তরঙ্গ শনাক্ত করার ফলে সময় পরিভ্রমণের ব্যাপারে তাঁরা অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু লাইগোর (মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার প্রোজেক্ট) সহপ্রতিষ্ঠাতা কিপ থর্ন বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এ আবিষ্কার আমাদের সময় পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজে আসবে না।’ তবে ঠিক যে এ আবিষ্কার সরাসরি সময় পরিভ্রমণে কাজে না এলেও অতীত ভ্রমণ যে সম্ভব, সে সম্ভাবনা আরেকটু বৃদ্ধি করেছে। সময় পরিভ্রমণ বাস্তবে সম্ভব কি না, সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা আপাতত তর্ক-বির্তক করতে থাকুক। আমরা বরং এ বিষয়ে মজার কিছু বিষয় জেনে নিই।

অতীত ভ্রমণ করতে গেলে মজার কিছু প্যারাডক্স সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে কিছু আছে মাথা খারাপ করার মতো। সময় ভ্রমণ নিয়ে পরিচিত একটি প্যারাডক্সের কথাই প্রথমে বলি। ধরো, কেউ টাইম মেশিনে চড়ে তার পিতামহ যখন যুবক ছিলেন সেই সময়ে চলে গেল। এবার কোনো কারণে পিতামহ বিয়ে করার আগেই তাঁকে মেরে ফেলল। এখন মজার বিষয় হলো, তার বাবার বাবাই যদি বিয়ে না করেন, তাহলে তার বাবার জন্ম হবে কীভাবে? আর তার বাবার জন্মই যদি না হয়, তবে তার নিজের জন্ম হবে কীভাবে? আর তার নিজের জন্মই যদি না হয়, তাহলে সে টাইম মেশিনে চড়ে এই অতীত সময়ে এলই-বা কী করে? এ সমস্যাটি গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স নামে পরিচিত। অতীত ভ্রমণ করতে গেলে এ রকম আরও প্যারাডক্স সৃষ্টি হয়।

শিল্পীর কল্পনায় টাইম মেশিন
শিল্পীর কল্পনায় টাইম মেশিন

স্টিভেন জি স্ক্রুইল নামের এক সায়েন্স ফিকশন লেখক তাঁর জানুস ইকুয়েশন বইতে অতীত ভ্রমণ নিয়ে অদ্ভুত এক প্যারাডক্স তুলে ধরেছেন। তাঁর গল্পের মূল চরিত্র এক গণিতবিদ। টাইম মেশিন তৈরির জন্য তিনি গবেষণা করছিলেন। তিনি একদিন সুন্দরী এক মেয়ের প্রেমে পড়লেন। কিন্তু মেয়েটি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি মেয়েটি সম্পর্কে একটু একটু করে খোঁজ নিতে থাকেন। একসময় জানা যায়, মেয়েটি আগে একবার কসমেটিক সার্জারি করে তার চেহারা পরিবর্তন করেছে। এসব শুনে তো গণিতবিদের আগ্রহ আরও বাড়ে। সে ওই মেয়ে সম্পর্কে আরও তথ্য জোগাড় করতে থাকে। পরে জানা যায়, মেয়েটি শুধু চেহারাই নয়, পাশাপাশি লিঙ্গও পরিবর্তন করেছে। অর্থাত্ সে আগে ছেলে ছিল। আরও জানা গেল, সে আসলে ভবিষ্যত্ থেকে আগত এক টাইম ট্রাভেলার। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয়—মেয়েটি অন্য কেউ না, সে নিজেই (ভবিষ্যত্ থেকে আগত)। তার মানে সে নিজেই তার প্রেমে পড়েছে। আরও মজার বিষয় হলো—এ দুজন যদি বিয়ে করে, আর তাদের সন্তান হয়, তাহলে কী হবে? আবার সন্তানটিও যদি টাইম ট্রাভেল করে সেই অতীতে চলে যায়, যখন এই গণিতবিদের গল্প শুরু হয়েছিল? এভাবে কেউ ইচ্ছা করলে নিজেই নিজের বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রী হতে পারবে!

প্রায় একই প্যারাডক্স নিয়ে রবার্ট এ হেইনলেইন লিখেছিলেন অল ইউ জম্বিস। এ কাহিনি নিয়ে পরবর্তী সময়ে (২০১৪) প্রিডেস্টিনেশন নামের একটি সায়েন্স ফিকশন সিনেমা তৈরি হয়েছে। চাইলে সেটি একবার দেখে নিতে পারো। এ বিষয়ে বাংলাতেও বইপত্রের অভাব নেই। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ফিহা সমীকরণ-এ একটি রোবটের টাইম ট্রাভেলের কথা বলেছেন। রোবটটি ভবিষ্যত্ সময় থেকে প্রযুক্তির জ্ঞান নিয়ে অতীতে চলে আসে। এ ছাড়া মুহম্মদ জাফর ইকবালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ত্রিনিত্রি রাশিমালাসহ বেশ কয়েকটি বইতে সময় পরিভ্রমণের উল্লেখ রয়েছে। তবে কল্পনার পৃথিবী ছেড়ে বাস্তবে সেটি সম্ভব কি না, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।