চোর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আফজাল সাহেব ঠিক করেছেন, এবার ঈদে বাড়ি যাবেন না, শহরেই থাকবেন। প্রতিবারই তিনি বাড়িতে গিয়ে ঈদ করেন, মাঝেমধ্যে ঈদ করেন বিদেশেও। তাঁর এক ছেলে বিদেশে আছে। সেখানে ঈদ করতে যান। তবে এবার তিনি ঢাকায় থাকবেন এবং একাই থাকবেন। ঈদে স্ত্রী, মেয়ে আর ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দেবেন গ্রামের বাড়ি। গ্রাম তো শুধু গ্রাম না, গ্রাম হচ্ছে শিকড়—সেখানে বছরে এই একটা ঈদেই যাওয়া হয়। আফজাল সাহেবের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা অবশ্য সানন্দেই রাজি হয়। তারাও ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছে। তবে এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। এবার তিনি একা ঢাকায় থাকবেন।
: কেন, তুমি একা থাকবে মানে?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন স্ত্রী।
: একটা বিষয় ধরতে হবে।
: কী বিষয়?
: প্রতিবার ঈদের ছুটিতে আমরা যখন সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই, তখন বাসায় চুরি হয়। একটা না একটা কিছু চুরি হবেই, অথচ দারোয়ান-কেয়ারটেকার—সবই আছে বাড়িতে।
: তা হয়।
: দু-তিনবার দারোয়ান-কেয়ারটেকার বদলানো হয়েছে, তাতেও কাজ হয়নি। তাই আমি ঠিক করেছি, ওই চোরকে নিজেই ধরব। আমার ধারণা, একই চোর সব সময় আসে, চুরির ধরনেই বোঝা যায়। আমি তাকে এবার হাতেনাতে ধরব।
: আরে বাবা, এবার চুরি হবে না। বাসার সব দরজার লক পাল্টেছি। অরিজিনাল সুইডিশ লক লাগিয়েছি।
: না হবে, দেখো।
: উফ্। তোমার কি টাকার অভাব পড়েছে? কী আর এমন চুরি হয়েছে যে তোমাকে নিজে থেকে চোর ধরতে হবে?
: দ্যাখো, ব্যাপারটা টাকাপয়সা বা সম্পদের নয়। আমি চোরটাকে ধরতে চাই...জানতে চাই কেন সে বারবার আমার বাসায় আসে, রহস্যটা কী?
: থাকো তুমি তোমার রহস্য নিয়ে।
বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যান স্ত্রী।
শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আফজাল সাহেব। তাঁর স্ত্রীর বাপের বাড়িও ওই একই জায়গায় হওয়ায় বাড়িতে যেতে কখনো আপত্তি করেন না তিনি। তা ছাড়া ওখানেও বিশাল বাড়িঘর করেছেন আফজাল সাহেব। কারেন্ট, এসি, গ্যাস—সবই আছে। আর গাড়ি তো ঢাকা থেকেই যায়। ফলে কোনো ঝঞ্ঝাট নেই।

২.
শুরু হলো আফজাল সাহেবের অ্যাডভেঞ্চার। ঈদের পরদিন থেকেই তিনি ঘাপটি মেরে রইলেন বাসায়। কেউ জানল না তিনি বাড়িতে আছেন—দারোয়ান-কেয়ারটেকারও না। তারপর সত্যি সত্যি এক রাতে খুট করে একটা শব্দ হলো। আফজাল সাহেব তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তল নিয়ে প্রস্তুত। গুলি করবেন না, তবে হাতে পিস্তল থাকলে ভয় থাকে না। আফজাল সাহেব টের পেলেন কেউ একজন অন্ধকারে টর্চ নিয়ে ঘরে ঢুকল। তিনি আশ্চর্য হলেন, চোর ব্যাটা নতুন লক খুলে ঢুকল কীভাবে! খুব এক্সপার্ট চোর সন্দেহ নেই। অন্ধকার ঘরে লম্বা একটা লোক এসে দাঁড়াল। আর তখনই খুব আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা ঘটল। কথা বলে উঠল চোর—
: আফজাল, আছিস?
আঁতকে উঠলেন আফজাল সাহেব। গলাটা একটু পরিচিত মনে হচ্ছে।
: কে?
: আমি মফিজ। তোর স্কুলমেট।
আফজাল সাহেবের গলার স্বর যেন আটকে গেল। মফিজ তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধু। বন্ধু ঠিক বলা যায় না। ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র ছিল, প্রতি পরীক্ষায় ফেল করত, গরিব ঘরের ছেলে। সেই মফিজ তাঁর বাসায় চুরি করতে ঢুকেছে!
: লাইট জ্বালাস না। আমিই তোর বাসায় চুরি করতে ঢুকতাম।
মফিজ বলে।
: কিন্তু কেন?
: তোর মনে আছে, তুই ছিলি আমাদের ক্লাসের সেরা ছাত্র, ভালো বংশের ছেলে। সবাই তোর প্রশংসা করত। স্যাররা তোকে ভালোবাসত। বলত, তুই বিরাট কিছু হবি, দেশ-দশের উন্নতি করবি। আর আমি ছিলাম একটা ফালতু, পাস করতে পারতাম না, বইপত্র কিনতে পারতাম না। এত গরিব ছিলাম যে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো চুরিও করতাম পেটের দায়ে। স্যার-ছাত্র—কেউই আমাকে পছন্দ করত না। পণ্ডিত স্যার তো বলতেনই, বড় হলে আমি চোর হব। শেষ পর্যন্ত চোরই হলাম। স্যারের কথা রাখলাম। তবে তুই কিন্তু রাখলি না স্যারের কথা।
: মানে?
: মানে তুই অনেক বড় হয়েছিস, বাড়ি-গাড়ি অনেক কিছু করেছিস, ঢাকা শহরে তোর পাঁচটা বাড়ি, তিনটা গাড়ি, গ্রামেও বাড়ি করেছিস, এমনকি বিদেশেও নাকি বাড়ি কিনেছিস। কিন্তু তোর সবই তো চুরির টাকা। তুই এত কিছু কীভাবে করলি, সবই আমি জানি, অনেকেই জানে। স্যাররা যেমন বলত, তুই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবি; তা কিন্তু তুই করিসনি, নিজের পরিবারের বাইরে যেতে পারিসনি। অথচ তোকে নিয়ে স্যাররা এত স্বপ্ন দেখত, এত কিছু বলত, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমিও।
: কিন্তু কিন্তু...
কথা আটকে যায় আফজাল সাহেবের গলায়।
: কিন্তু তোর বাসায় কেন চুরি করি?
: আসলে আমি চোরের ওপর বাটপারি করেছি। সেটাও করেছি তোকে ধরার জন্য। তোকে এই কথাগুলো বলার জন্য। আমার প্ল্যানটা কাজে লেগেছে। আমি তো তোকে চিনি। জানতাম এমনটাই হবে। তবে আজ কিন্তু চুরি করতে ঢুকিনি, গত কয়েক বছরে যা যা চুরি করেছিলাম, সেগুলো ফেরত দিতে এসেছি।
: কী বলছিস...।
আবার গলায় কথা আটকে যায় আফজাল সাহেবের। তিনি গলা পরিষ্কার করে ডাকেন, ‘মফিজ? মফিজ...?’
কেউ উত্তর দেয় না। অন্ধকারে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মফিজকে হঠাৎ করেই আর দেখা যায় না।

৩.
ঈদের দুদিন পরেই বাসায় ফিরে এল সবাই। আফজাল সাহেবকে প্রথমেই বললেন তাঁর স্ত্রী, ‘কি, চোর ধরতে পেরেছ?’
: পেরেছি।
বিষণ্ন গলায় বলেন আফজাল সাহেব।
: সত্যি?
: হ্যাঁ। এই যে চুরি হওয়া সব জিনিস, চোর নিজেই দিয়ে গেছে।
হতভম্ব হয়ে স্ত্রী দেখলেন একটা বস্তার ভেতর চুরি হওয়া জিনিসপত্র, ‘কী আশ্চর্য!’
স্ত্রীর কণ্ঠে বিস্ময়।
: চোরটা তাহলে ভালো।
পাশ থেকে কথা বলল আফজাল সাহেবের মেয়ে।
‘হ্যাঁ ও ভালো চোর, আর আমি খারাপ চোর...খুব খুব খারাপ চোর।’—মনে মনে ভাবেন আফজাল সাহেব।