জিকা ভাইরাস! আবার জিকায়!

: বাবা ভাইরাস কী?

: ভাইরাস হচ্ছে একধরনের দুষ্টু পোকা, যা কম্পিউটারকে নষ্ট করে দেয়।

দুদিন পর কম্পিউটারের আশপাশে একটি ভোমরাকে উড়তে দেখে মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, বাবা দেখে যাও, একটা ভাইরাস। তোমার কম্পিউটার নষ্ট করে দেবে...

ও হ্যাঁ, কম্পিউটার-মোবাইল নয় শুধু, ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে মানুষের দেহেও। আবার ভাইরাস শুনলেই যে আঁতকে উঠতে হবে, তাও নয়। এমন কিছু ভাইরাস আছে, যা দেহে না থাকলে বা কম থাকলে আমাদের বেঁচে থাকাই কষ্টকর। এরা খাবার হজমসহ নানা কাজে আমাদের সহায়তা করে। এদের বলে নরমা ফ্লোরা। প্রতিদিন তাদের এক-দুবার ধন্যবাদ জানাতে ভুলবে না। ভাবছ, এ ধন্যবাদ তারা শুনবে কী করে? এটা তোমার মস্তিষ্কের ওপর ছেড়ে দাও। সে-ই তোমার কৃতজ্ঞতাটুকু পৌঁছে দেবে। আর তারা আরও ভালোভাবে তোমার শারীরিক কাজ করবে।

জিকা ভাইরাস নিয়ে চারদিকে এত লেখালেখি হচ্ছে বলে একে ভয় পেতে হবে, ব্যাপারটা যেন এমন না হয়। এই ভাইরাস যেন তোমাকে আক্রান্ত না করতে পারে, এ থেকে সতর্ক থাকার উপায় কী আর এতে আক্রান্ত হলে কী করণীয় সেটা জানা বরং জরুরি। 

শুনেছ নিশ্চয়ই, সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জিকা ভাইরাস নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে। ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ লোক আক্রান্ত হতে পারে।

জিকা ভাইরাসের আসল বাড়ি পশ্চিম গোলার্ধের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায়। কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে সে আর একটা অঞ্চলে বসে থাকবে কেন? সে জন্যই দ্রুত ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটা ডেঙ্গুর মতো হলেও তার চেয়ে হালকা প্রভাব ফেলে দেহে।

চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা একে চিনেছেন ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশ ছেড়ে যায়, মানে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। উগান্ডার বনাঞ্চলে প্রথম এটি দেখা গিয়েছিল। বনটির নাম জিকা। সেখান থেকেই এর নামও জিকা। আর প্রথম পাওয়া গিয়েছিল বানরের দেহে। তবে আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্রায়ই এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। কিন্তু তখনো এটি তারকা হয়ে ওঠার মতো মিডিয়া কাভারেজ পায়নি। এখন পাচ্ছে, কেননা আগের চেয়ে দ্রুত ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে। তার তো পাসপোর্ট-ভিসা বা বিমান টিকিট নেই। তাই বলে কম্পিউটারের মাধ্যমে যে এই ভাইরাস মানবদেহে ছড়ায় না, সেটাও নিশ্চিত। বাহন হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে এডিস মশাকে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ানোর পরে ওই মশা অন্য ব্যক্তিদের কামড় দিলে তা ছড়াতে থাকে।

সন্তানসম্ভবা নারীরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে। শিশু বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এ কারণেই জিকা ভাইরাস বিশ্বের মনোযোগ টেনেছে। এটির মূল কারণ মাইক্রোসেফালি নামে একটি নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার ও ভাইরাসটির মধ্যে যোগসূত্র। এর কারণে সদ্যোজাত শিশুদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিক আকারের চেয়ে ছোট হয়। আবার শিশুদের বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি কখনো কখনো মৃত্যুও হতে পারে।

বিশ্বের প্রায় দুই ডজন দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। এদের মধ্যে ক্যারিবিয়ান, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলো উল্লেখযোগ্য। এল সালভাদর, কলম্বিয়া, হন্ডুরাস, ইকুয়েডরের মতো দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারীদের সন্তান ধারণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বলেছে ডব্লিউএইচও। তারা জানিয়েছে, জিকা ভাইরাস ‘বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে’। ভাগ্যিস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেনি যে এটি তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তাহলে বিস্ফোরক ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী করে সেসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরেক দফা যুদ্ধ বাধিয়ে দিত যুক্তরাষ্ট্র!

আমাদের হয়তো সেসব নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলত। কিন্তু ভারতেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে ডব্লিউএইচও। সে জন্য ভারত থেকে বাংলাদেশেও আক্রমণ হতে পারে জিকা ভাইরাসের। সুতরাং, এখন এ নিয়ে আমাদের ভাবতেই হচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই জানতে চাইছ, কীভাবে বুঝবে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছ কি না?

বলছি, বলছি, সংক্রমিত ব্যক্তিদের শরীরে ভাইরাসটির যেসব উপসর্গ দেখা দেয় সেগুলো হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, র্যাশ, চোখ ওঠা, অস্থিসংযোগে ব্যথা আর চোখ গোলাপি রং ধারণ করা। প্রকৃতপক্ষে, শতকরা ৮০ শতাংশ সংক্রমিত ব্যক্তিই আঁচ করতে পারে না যে তাদের শরীরে ভাইরাসটি রয়েছে। এসব কারণে ভাইরাসটি নির্ণয় করা কঠিন। আর এ সুযোগে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কারও এই সময়ে এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়াই উচিত।

চিকিত্সকেরা জানিয়েছেন, গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে যদি জিকা ভাইরাস আক্রমণ করে, তাহলে তা বেশি বিপজ্জনক। এ সময় ভাইরাসটি গর্ভস্থ শিশুর দেহে আক্রমণ করে এবং শিশু বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

জিকা ভাইরাস দমনের জন্য এখনো কোনো টিকা বা নির্দিষ্ট ওষুধ উদ্ভাবিত হয়নি। এটা শুনেই ভয় পেয়ে যেয়ো না। ইতিমধ্যেই টিভি চ্যানেল, পত্রিকা মিলে তোমাকে যথেষ্ট ভয় দেখিয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ যুগে যে তোমরা হরর গল্প পড়া কমিয়ে দিয়েছে, তার একটা কারণও এটি। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় একবার ঘুরে এলে হরর অনুভূতি এমনিতেই পাওয়া যায়। কষ্ট করে আর হরর গল্প পড়ার দরকার কী। বাংলাদেশে প্রায়ই কোনো রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে ভয় জাগিয়ে দেওয়া হয়। অযথা ভয় না পেয়ে যে কোনো তথ্যকে সঠিকভাবে জানো। নিজে সচেতন হয়ে অন্যকে সচেতন কর।

আর হ্যাঁ, খুশিও হয়ে যেয়ো না যে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত হলে এই সুযোগে অনেক দিন স্কুল ফাঁকি দিতে পারবে। কেননা, এর চিকিত্সা জটিল কিছু না। আক্রান্ত রোগীকে কয়েক দিন বিশ্রাম নিতে হবে। প্রচুর পানীয় খাবার খাওয়া আর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ সেবন করলেই ব্যাপারটা সেরে যাবে। তবে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো রোগকে কাছেই ভিড়তে না দেওয়া। জিকার ক্ষেত্রে যা খুবই সম্ভব। মশা থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা। ঘরবাড়ি মশামুক্ত রাখা। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা। মশার বিস্তার রোধ করা। মশানাশক ও মশারি ব্যবহার করা।

কেউ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদে থাকাটাই জরুরি। নকিয়া ফোন অন করে দেখো দুটি হাত কাছাকাছি এসেও দেখবে একে অপরের হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে না। কারণ মনে হচ্ছে ওই জিকা ভাইরাসভীতিই। ব্যস, জিকা তো বটেই এসব মানলে আরও অনেক রোগের হাত থেকেই তুমি বেঁচে যেতে পারবে।

জিকা ভাইরাসকে অসম্মান করার কিছু নেই। মানবসভ্যতায় এসব রোগ না হলে চিকিত্সাবিজ্ঞানও এত দূর এগোতে পারত না। সে জন্য সমস্ত রোগকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। প্রিয় রোগবৃন্দ, তোমাদের ধন্যবাদ, তোমরা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছ, এবার দয়া করে বিদায় হও। সুস্থতার কাছেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।