নিরাপদ পৃথিবী চাই!

স্লোগান আর প্ল্যাকার্ড! সঙ্গে হাজার হাজার শিশু-কিশোর। ব্রাসেলসের রাস্তা মুখরিত হয়ে উঠেছে এদের মিছিল আর দৃপ্ত স্লোগানে। একসঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে উঠছে, ‘আমরা সবাই একসঙ্গে’ বলে। আগে কখনোই এমন পরিস্থিতি দেখেনি শান্তিপূর্ণ বেলজিয়াম। শুধু যে শিশু-কিশোরেরা, তা নয়! সঙ্গে আছেন তাদের অভিভাবকেরাও। কেননা আন্দোলনরতদের প্রায় সবাই প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। এবার একটু অবাক লাগছে কি? আমাদের দেশে হয়ে যাওয়া ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের কথা মনে পড়ে গেল? মনে পড়লে দোষ নেই। কেননা এই বয়সীদের আন্দোলন সারা বিশ্বে খুব একটা দেখা যায় না। তবে বেলজিয়ামের এই শিক্ষার্থীরা চায় নিরাপদ আগামীর বিশ্ব।

জলবায়ু পরিবর্তনের খবর তো আমরা সবাই জানি। পত্রপত্রিকা আর বইয়ে প্রায়ই এ–সম্পর্কে ভারী ভারী খবর আর প্রবন্ধ দেখা যায়। সাধারণত তেমন কাউকেই এগুলোকে গুরুত্বসহকারে নিতে দেখা যায় না।তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নেন না সরকার-প্রধানেরাও। আগামীর পৃথিবীতে নাগরিক হিসেবে আজকের স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারাই থাকবে। ফলে তাদের জলবায়ু বিপর্যয়ের যাবতীয় পরিণতিও ভোগ করতে হবে। পূর্বসূরিদের অসচেতনতার ফল কেন তারা বয়ে বেড়াবে! প্রায় সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষার্থী ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে এ জন্যই নেমেছে আন্দোলনে। আর এতে পূর্ণ সমর্থন আছে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদেরও।

২০১৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের জলবায়ু রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, যার কারণ হিসেবে থাকবে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার ফলে ভূমিহীন এবং খাদ্যহীন হওয়া। এটা ঠেকাতে চাইলে আগামী ১২ বছরের মধ্যে ধোঁয়াসহ অন্যান্য নির্গমনকে অর্ধেকে কমিয়ে আনতে হবে। কলকারখানাসহ যাবতীয় জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমগুলোতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, পৃথিবীতে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের ৭০ শতাংশই নির্গমন করে মাত্র ১০০টি কোম্পানি।

শুধু যে রাজধানী ব্রাসেলসেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, এমনটি নয়। আন্দোলন হচ্ছে লুইক শহরেও। সেখানে রাজপথে নেমেছে আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী। প্রায় ১৫ হাজার ছাত্রছাত্রী সিটি হলের দিকে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায়। লিউভেন শহরের রাস্তায় নেমেছিল আরও সাড়ে তিন হাজার ছেলেমেয়ে। বেলজিয়ামের কোনো জলবায়ু নীতি নেই। এটির দাবিসহ বাসযোগ্য আগামী পৃথিবীই সবার মূল দাবি। ৩ হাজার ৪৫০ জন বিজ্ঞানী খোলা চিঠির মাধ্যমে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।

ইংল্যান্ডেও হচ্ছে জলবায়ু নিয়ে জোরদার আন্দোলন। সেখানের শিক্ষার্থীরা বলছে, তারাই প্রথম প্রজন্ম হিসেবে এই সংকটে পড়বে, আবার তারাই শেষ প্রজন্ম, যারা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। তারা কোনো আশা চায় না। আগামীর পৃথিবী নিয়ে যে ভয় তাদের গ্রাস করছে, এটা যেন সরকার টের পায়। সেই অনুযায়ী যেন প্রতিদিন এটা নিয়ে কাজ করে। ঘরে আগুন লেগে গেলে যেমন জরুরি পদক্ষেপ নিতে হয়, সেভাবেই যেন পদক্ষেপ নেয়।

প্রতিদিন প্রায় ১০০টি প্রজাতির জীব পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রেও চলছে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য দ্বারা দূষণ। প্রতি মিনিটে অন্তত এক ট্রাক প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সমুদ্রে। চলছে মাত্রাতিরিক্ত মাছ নিধনও। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪৮ সালের মধ্যে সাগরে কোনো মাছ থাকবে না। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এটি পৃথিবীর জন্য চরম সংকটময় পরিস্থিতি। এ রকম অবস্থায় পৃথিবীর সব দেশে সরকারপ্রধানদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে শেষ পর্যন্ত হয়তো মানবজাতির টিকে থাকাও হুমকির সম্মুখীন হবে।

সূত্র: বিবিসি, ইন্টারনেট