যত্নে রাখি বইগুলো

সে  হলো কাগজে বন্দী একরাশ বিচিত্র নকশা। দেখে মনে হয় নিতান্তই গোবেচারা ধরনের কিছু। অথচ এই আপাতপ্রাণহীন বস্তুটিই আমাদের পৃথিবীকে বদলে দেয়, বদলে দেয় দৃষ্টিভঙ্গি। নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শেখায়। সুন্দর সব কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। আর সত্যিকারের মানুষ হওয়ার মন্ত্র ফিসফিস করে বলে দেয় আমাদেরই কানে।

হ্যাঁ, বইয়ের কথাই বলছিলাম এতক্ষণ। গল্প, কবিতা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ভূগোল, বিনোদন, রোমাঞ্চ, প্রেম-ভালোবাসা, কী নেই এর মাঝে? এই বইয়ের মাধ্যমেই অসীম মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র একটা গ্রহে বাস করা মানুষ কিন্তু ঘুরে এসেছে সেই অসীম মহাবিশ্বেরই সীমা ছাড়িয়ে। এই অনন্য শক্তি কি তারা বই না পড়ে পেত?

তুমিও নিশ্চয়ই বই পড়ো। কেউ হয়তো লাইব্রেরি কিংবা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়ে। তবে যারা বই পড়তে ভালোবাসে, তাদের নিজের সংগ্রহেও আছে এই বিস্ময়ের খানিকটা। তা সে টিফিনের বাঁচানো পয়সা দিয়েই কেনা হোক কিংবা জন্মদিনে প্রিয়জনের কাছ থেকে উপহার পেয়েই হোক!

আজকাল কিন্ডেল, ট্যাব, ল্যাপটপ, স্মার্টফোনে বই পড়ে অনেকেই। তবু কাগুজে বইয়ের আবেদন কিন্তু একটুও কমে যায়নি। কারণ বর্ষার ঝুমবৃষ্টিতে কাঁথা গায়ে জানালার কাছে আধশোয়া হয়ে রগরগে থ্রিলার পড়ার মজাই আলাদা। কিংবা বইমেলায় কেনা বইয়ের ঘ্রাণ কি তুমি ই-বুকে পাবে? কক্ষনো না। যা-ই হোক, যে কয়খানা বই তুমি সংগ্রহে রেখেছ, তাদের যত্ন করতে হবে না?

প্রথমেই নজর দিই বই পড়ার সময়ে যত্নের প্রতি। অনেকেই বইয়ের ওপরে মার্ক করে বা দাগ দিয়ে দিয়ে পড়ে। তবে নিজের বই হলে দাগ দেওয়াই যায়। কিন্তু লাইব্রেরির বা অন্য কারও বই দাগ দিয়ে পড়াটা বোধ হয় ঠিক না। এতে কিন্তু বইয়ের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। এরপর যে ওই বই পড়ে, তার কাছে বেশ বিরক্তিকর মনে হয় ব্যাপারটা। তবে দরকারি, সুন্দর বাক্যগুলো ডায়েরিতে লিখে, স্মার্টফোনে স্ক্যান করে রাখলে কিংবা ফটোকপি করে নিলে এই সমস্যা আর থাকে না। আর যদি দাগ দিতেই হয়, তবে পেনসিল ব্যবহার করাই শ্রেয়।

আলমারি থেকে বই বের করার সময় ওপর থেকে না টানাই ভালো
আলমারি থেকে বই বের করার সময় ওপর থেকে না টানাই ভালো

তুমি হয়তো বইটির পুরোটা একবারে পড়ে শেষ করতে পারোনি। সে ক্ষেত্রে বইয়ের পৃষ্ঠা ভাঁজ করে কোনোভাবেই মার্ক করা উচিত নয়। প্রয়োজনে কাগজ দিয়ে বুকমার্ক দিতে পারো। নিজেও সুন্দর সুন্দর বুকমার্ক তৈরি করে নিতে পারো। গুগলে একটু ঘাঁটলেই অনেক টিউটোরিয়াল পাবে বুকমার্ক বানানোর ওপর।

অনেকে আবার জিব দিয়ে আলতো করে আঙুল ভিজিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা পাল্টায়। এতে বইয়ে দাগ লেগে যায়। আর ব্যাপারটা কিন্তু ভারি অস্বাস্থ্যকরও বটে।

যারা খুব পড়ুয়া, তাদের অনেকে খেতে খেতেও বই পড়ে! কিন্তু জানো তো, খাবারের কণা বইয়ের দাগ ফেলে দিতে পারে। ব্যাকটেরিয়া জন্মে পাতাগুলো নষ্ট করে দেয়। ১৮০ ডিগ্রি করে খুলে বই পড়লে বইয়ের সেলাই ছিঁড়ে যায় কিংবা আলগাও হয়ে যায়। তাই এগুলো করা মোটেও উচিত নয়।

এবার আসি বই পড়ার পরে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। বই রাখার জন্য সেলফ বা আলমারিতে হলো সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। সেলফটি এমনভাবে রাখতে হবে, যেন তার ভেতরের বাতাস শুষ্ক থাকে। ছত্রাক বা অন্য কোনো পরজীবী যেন আক্রমণ করতে না পারে। একটার ওপরে আরেকটা বই না রেখে বইগুলো পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রাখবে। তাহলে কোনো বই বের করতে বা রাখতে ঝামেলা পোহাতে হবে না।

তোমার বইয়ের সংখ্যা যদি একটু বেশি হয়, তবে ধরন অনুযায়ী সাজিয়ে রাখতে পারো। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ আলাদা আলাদা গুচ্ছ করে রাখা যেতে পারে।

আলমারি থেকে বই বের করার ক্ষেত্রে সতর্কতা দরকার। বইয়ের ওপর দিক থেকে বই টেনে বের করা উচিত নয়। বরং পুরো বইটি একসঙ্গে ধরে বের করবে। মাসে কমপক্ষে একবার সুতি কাপড় দিয়ে বইগুলো মুছে ফেলবে। কোনোভাবেই বেশি ধুলো জমতে দেওয়া যাবে না।

বইয়ের সংখ্যা একটু বেশি হলে ধরন অনুযায়ী সাজিয়ে রাখা যেতে পারে
বইয়ের সংখ্যা একটু বেশি হলে ধরন অনুযায়ী সাজিয়ে রাখা যেতে পারে

আলমারিতে রাখা বইকে পোকার হাত থেকে রক্ষার জন্য নিমপাতা ব্যবহার করতে পারো। প্রয়োজনমতো নিমের আট-দশটি ডাল নিয়ে সেগুলোর পাতা বেশ ভালোভাবে শুকিয়ে নাও। তারপর বইয়ের তাকের ফাঁকা জায়গাগুলোয় সেগুলো রেখে দাও। নিম খুব ভালো জীবাণুনাশক। এটি ছত্রাকও প্রতিরোধ করে। আর অন্যান্য কৃত্রিম প্রিজারভেটিভসের তুলনায় এটি সাশ্রয়ী, কার্যকরী ও পরিবেশবান্ধব।

যাদের বাসায় সেলফ নেই কিংবা বই বদ্ধ জায়গায় রাখতেই হয়, তারা বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে রেখে দিতে পারো ন্যাপথলিন। এটিও ছত্রাক ও অন্যান্য কীটপতঙ্গকে দূরে রাখে। মাঝেমধ্যে রোদে দিলে স্যাঁতসেঁতে ভাবটা দূর হয় অনেকখানি। তবে কখনোই প্রখর সূর্যের আলোয় রাখা যাবে না। এতে পাতা কুঁচকে যেতে পারে।

অনেক কথাই বললাম বইয়ের যত্ন নিয়ে। তবে জানো তো, বইয়ের সবচেয়ে বড় যত্ন হলো নিয়মিত বই পড়া। বই না পড়া বই পুড়িয়ে ফেলার চেয়েও বড় অপরাধ। তাই যত্নে শুধু বই সাজিয়ে রাখলেই হবে না; মনটাকে বড় করতে, আগামী জীবনটা সুন্দর করতে, অন্তত আনন্দে সময়গুলো কাটাতে পড়তে হবে অনেক অনেক বই।

তোমার বই পড়া শুভ হোক।

দরকারি লিংক: ১. তোমরা যারা বুকমার্ক তৈরি করতে চাও তারা উইকিহাউ সাইটের এই লিংকটা দেখতে পারো: wikihow.com/Make-a-Bookmark

২. বইয়ের পাতা স্ক্যান করতে ডাউনলোড করে নিতে পার একটি স্মার্টফোন অ্যাপ। সেটি পাবে camscanner.com ঠিকানায়।

মডেল: ইশা

ছবি: সুমন ইউসুফ