গোপন কথাটি রবে কি গোপনে?

অন্যবারের মতো এবারও একুশের গ্রন্থমেলা থেকে যাকে বলে নিজেকে রীতিমতো দেউলিয়া ঘোষণা করে বই কিনেছি। বাড়িভর্তি বই। রাখাই মুশকিল। আবার যেখানে সেখানে রাখাও যায় না—হয় তেলাপোকায় ঘাঁটবে, ইঁদুরে কাটবে, কিংবা আগ্রহী বইচোরের কবলে পড়বে। তাই বইয়ের আলমারিতে কোনোরকমে ঠেসে ঠুসে রাখছিলাম বইগুলো। সেই সময়ই, একদম প্রথম দিককার একটা অনেক পুরোনো তিন গোয়েন্দা চোখে পড়ল। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে! স্মৃতি রোমন্থন করতেই হাতে নিলাম বইখানা। আর হাতে নিতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল বেশ পুরোনো রুল টানা খাতার একটা কাগজ। তাতে লেখা—টউছউ, ঋজচঐ ঞঢখঋঘ!

দুর্বোধ্য মনে হয়, তাই না? মনে পড়ল স্কুলে থাকতে এমন ‘কোড ল্যাঙ্গুয়েজ’-এ লেখা ছিল আমাদের জন্য ভারি মজার এক খেলা। যেসব কথা বড়দের না জানাই ভালো, সেসব কথা সাংকেতিক ভাষায় লিখতাম আমরা। কড়া বড় বোনের হাতে পড়ে পরীক্ষার আগে বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আমাদের বন্ধু রানার জন্য। তখন বিজ্ঞান বইয়ের ভাঁজে ওকে এই চিঠিটা দিয়েছিলাম আমি। বেচারা রানা বইয়ের ওই অধ্যায়টা পড়েনি বলে খেয়ালও করেনি কাগজটা—যথাসময়ে ফেরত চলে এলো আমার কাছে। কী করে আমিও কাগজটা ফেলে না দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। কী লেখা ছিল ওখানে? আসলে ব্যাপারটা কঠিন কিছু নয়। ইংরেজি বর্ণকে তিন ধাপ এগিয়ে লিখেছিলাম আমি। অর্থাত্ অ হয়েছিল উ, ই হয়েছিল ঊ, ঈ হয়েছিল ঋ। তাহলে পুরো লেখাটা কী দাঁড়াল? জঅঘঅ, ঈঙগঊ ছটওঈক! রানা, তাড়াতাড়ি আসো।

প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের কারণে জটিলতর হয়ে উঠেছে গোপন ভাষা
প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের কারণে জটিলতর হয়ে উঠেছে গোপন ভাষা

কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে অক্ষর এগিয়ে গোপন সংকেত লেখার ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। এমনকি, আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে স্বয়ং রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এমন কায়দা ব্যবহার করতেন! পরে জেনেছি, এমন সাংকেতিক লেখা নিয়ে রীতিমতো চর্চা হয়। আর সেই চর্চার নাম ক্রিপটোলজি। গ্রিক শব্দ ‘ক্রিপ্টোজ’ আর ‘গ্রাফেইন’ থেকে এর উদ্ভব। ক্রিপ্টোজ অর্থ গোপনীয়, আর গ্রাফেইন মানে লেখা। এই দুয়ে মিলে ‘ক্রিপ্টোগ্রাফি, অর্থাত্ ‘গোপন লেখা’। আর এ-বিষয়ক চর্চার নাম ‘ক্রিপ্টোলজি’। অর্থাত্ গোপনীয় সংকেতভিত্তিক লেখা-বিষয়ক চর্চা।

আদিতে এ ধরনের লেখার উদ্ভব ঘটে মূলত গোপনীয় কোনো সংবাদ এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাঠানোর উদ্দেশ্যে। তবে বর্তমান যুগেও গণিতশাস্ত্র, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং—এসব চর্চায় ব্যবহূত হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি। আধুনিক এই সময়ের আগ পর্যন্ত ক্রিপ্টোগ্রাফি বলতে প্রধানত কোনো একটা কথাকে আপাতদৃষ্টিতে ‘অপাঠযোগ্য’ করে তোলাকেই বোঝানো হতো। যেন যার বা যাদের উদ্দেশে ওই বার্তা, তারা ছাড়া অন্য কেউ এ লেখার পাঠোদ্ধার করতে না পারে।

ক্রিপ্টোলজি চর্চায় তিনটে শব্দ খুব প্রচলিত—অ্যালিস (এ), অর্থাত্ যে ক্রিপ্টোগ্রাফি পাঠাচ্ছে; বব (বি) হচ্ছে যার উদ্দেশে লেখা হয়েছে ওই বার্তা; আর ‘ইভ’ হচ্ছে তারা, যাদের কাছে ওই বার্তাকে দুর্বোধ্য রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাহলে আমার ওই বিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে পাঠানো ক্রিপ্টোগ্রাফির ক্ষেত্রে আমি ছিলাম ‘অ্যালিস’, রানা ছিল ‘বব’ আর রানার বড় বোন ছিল ‘ইভ’!

যুদ্ধবিগ্রহের সময় এই ক্রিপ্টোগ্রাফির বহুল ব্যবহার ঘটে, ‘রটর মেশিন’ নামে রীতিমতো একটি ডিভাইসও তৈরি হয়ে যায় এই কাজে ব্যবহার করার জন্য। ১৯২০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিল ক্রিপ্টোগ্রাফির ক্ষেত্রে এক স্বর্ণালি সময়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর ব্যাপক ব্যবহার হয়। তবে শুধু যুদ্ধ নয়, গোয়েন্দাগিরি, টাকার হিসাব, ব্যবসার গোপন কৌশল—এসব ক্ষেত্রেও ক্রিপ্টোগ্রাফির চর্চা নতুন কোনো ঘটনা নয়।

যে বার্তাটা পাঠানো হবে, সাধারণ অবস্থায় তাকে বলে ‘প্লেইন  টেক্সট’। আর রূপান্তর ঘটার পর তার নাম হয় ‘সাইফার টেক্সট’। আর ‘ডিক্রিপশন’ হচ্ছে সাংকেতিক বার্তাটিকে উদ্ধার করে পাঠযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসা। আর ‘কি’ হচ্ছে সেই পদ্ধতি, যা জানা থাকে শুধু বার্তাপ্রেরক আর গ্রহীতার, যার মাধ্যমে পাঠ করা যায় ওই গোপন লেখা।

গোপন লেখার একদম আদি যুগে শুধু লেখার মাধ্যমে গোপন বার্তা পাঠানো যেত না—কেননা, তখন পর্যন্ত পড়তে পারা লোকের সংখ্যাই ছিল কম। তখন প্রাপকের কাছে যে জিনিসটি পাঠানো হতো, তার মধ্যেই কোনো চিহ্ন যুক্ত করা হতো, যেন পাঠ করা হয়ে যায় গোপন বার্তা। ভারতবর্ষে দুই হাজার বছরেরও আগে দুধরনের গোপন বার্তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে—একটি কৌটিলাম, অন্যটি মূল্যবোধিয়া। কৌটিলামে বর্ণ বদল করা হয়, যেমন স্বরবর্ণকে    রূপান্তরিত করা হয় ব্যঞ্জনবর্ণে। মূল্যবোধিয়ার গোপন বার্তার অক্ষর তৈরি হয় জোড়া অক্ষর দিয়ে। নবম শতাব্দীতে আরব গণিতবিদ আল-কিন্দি রীতিমতো একটি বই-ই লিখে ফেলেছিলেন কেমন করে গোপন বার্তা উদ্ধার করতে হয়, সে বিষয়ে।

কম্পিউটার-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের কারণে জটিলতর হয়ে উঠেছে গোপন ভাষা। ফলে এর আগ পর্যন্ত যেসব কায়দা খাটিয়ে পাঠোদ্ধার করা হতো গোপন বার্তার, সেই পাঠোদ্ধার করার প্রক্রিয়াতেও ঘটছে পরিবর্তন।

১৯২০ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জার্মান বাহিনীর কোড উদ্ধারের জন্য এনিগমা নামে একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। এর মাধ্যমে পাঠোদ্ধার করা হতো গোপন সব বার্তা। তবে ওই ধরনের যন্ত্র আজকাল আর ব্যবহার করা হয় না।

গোপন বার্তা পাঠের নানান মৌলিক কায়দা রয়েছে। জটিল পদ্ধতি রয়েছে বটে, কিন্তু ওই জটিল পদ্ধতির জায়গায় কিন্তু থাকে সহজ মৌলিক কোনো চিন্তাই। ধরা যাক, ঠিক হলো, অ্যালিস (বার্তা প্রেরক) গোপন এক বার্তা পাঠাবে ববকে (বার্তাগ্রাহক)। অ্যালিস ঠিক করল, অক্ষর বদল করে সে পাঠাবে গোপন বার্তা—কোন অক্ষরের বদলে কোন অক্ষর ব্যবহার করা হবে, তা জানা থাকবে শুধু অ্যালিস ও ববের। লেখা হলো সেই বার্তা। এদিকে একজন ইভ ভাবল, সে গোপন বার্তার পাঠোদ্ধার করবে। ইভের জানা ছিল যে ইংরেজিতে যত লেখা হয়, তার মাঝে শতকরা ১৩ বার ব্যবহার করা হয় ‘ই’ (ঊ), শতকরা ৯ ভাগ সময়ে আছে ‘টি’ (ঞ), এমন একটা তালিকা ছিল তার হাতে। এই তালিকা ব্যবহার করে সে দেখল, তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহূত ‘ডব্লিউ’ (ড) অক্ষরটি ব্যবহার করা হয়েছে শতকরা ১৩ হারে। অর্থাত্, সমূহ সম্ভাবনা যে অ্যালিস আসলে ‘ই’ (ঊ) এর পরিবর্তে ‘ডব্লিউ’ (ড) ব্যবহার করছে। এই কায়দায় একটু খাটুনি গেল ঠিকই, কিন্তু বার্তাটির ঠিকই পাঠোদ্ধার করা গেল।

কোড যত কঠিন হব ততই বাড়বে তথ্যের নিরাপত্তা
কোড যত কঠিন হব ততই বাড়বে তথ্যের নিরাপত্তা

বইপত্র, সিনেমায় কতভাবেই না এসেছে এই ক্রিপ্টোলজি কিংবা ক্রিপ্টোগ্রাফির কথা। তবে হাল আমলের বিখ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউন ২০০৩ সালে তাঁর বেস্টসেলার বই দ্য ডা ভিঞ্চি কোড-এ যেভাবে ক্রিপ্টোলজির ব্যবহার করেছেন, তা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। আর এই জমজমাট উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি সিনেমাও বেশ ব্যবসা করেছে বিশ্বজুড়ে। এই উপন্যাসটি না পড়লে এর মজা বোঝা দায়। তাই কাহিনি আগেভাগে বলে তোমাদের রসাস্বাদনে বাধা দিতে চাই না। তবে এ কথা জানিয়ে রাখা ভালো যে ড্যান ব্রাউন তাঁর বইতে ক্রিপ্টোলজি চর্চায় রীতিমতো নতুন একটি শব্দ যুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর উদ্ভাবিত শব্দটি হলো ক্রিপ্টেস (ঈজণচঞঊঝ)। ক্রিপ্টোলজির সঙ্গে কোডেক্স শব্দটিকে মিলিয়ে এই শব্দটি তৈরি করেছেন তিনি। ‘ক্রিপ্টোলজি’ কী তা তো আমরা জেনেই গেছি, আর ‘কোডেক্স’ অর্থ হলো বেশ কটা গ্রুপ কিংবা উপকরণে হাতে লেখা পুরোনো পুঁথি। এই ক্রিপটেক্স হলো পাথরের তৈরি সিলিন্ডার আকৃতির এক যন্ত্র, যেখানে মার্বেলের তৈরি পাঁচটি চাকতি রয়েছে—শব্দের বিভিন্ন রকম পরিবর্তন ঘটানোর জন্য ব্যবহার করা হয় এই ক্রিপটেক্স যন্ত্রটি।

ক্রিপ্টোগ্রাফির কত্ত যে ধরন রয়েছে, ইয়ত্তা নেই তার। যেমন সাধারণ ইংরেজি বর্ণমালা হচ্ছে—অইঈউঊঋঐেওঔকখগঘঙচছজঝঞটঠডঢণত। যদি অ্যালিস শুধু প্রথম বর্ণটি শেষে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে তার তৈরি বর্ণমালা দাঁড়ায় এমন ইঈউঊঋঐেওঔকখগঘঙচছজঝঞটঠডঢণতঅ। এখন যদি অচচখঊ শব্দটি লেখা হয় এই নতুন বর্ণমালা অনুযায়ী, তাহলে তা দাঁড়াবে ইছছগঋ। অর্থাত্, এখানে অ=ই, চ=ছ, খ=গ, ঊ=ঋ! সহজ কিছু কায়দা আছে। যেমন ইংরেজি ভাষায় তৈরি গোপন কোনো বার্তায় যে চিহ্নই ব্যবহার করা হোক না কেন, তাতে যদি একক বর্ণের কোনো শব্দ দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে ওই চিহ্নটি হলো (এ) (অ) অথবা আই (ও)। সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত ইংরেজি বর্ণ হচ্ছে ‘ই’ (ঊ); তারপর ‘টি’ (ঞ), ‘এ’ (অ), এবং ‘ও’ (ঙ)। অর্থাত্, বেশি বেশি যে চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, সমূহ সম্ভাবনা যে ওই চিহ্নটি হয় ‘ই’, ‘টি’, ‘এ’ অথবা ‘ও’। ইংরেজিতে তৈরি কোনো শব্দ দেখা গেলে প্রায় সব ক্ষেত্রে একটি বর্ণ ভাওয়েল বা স্বরবর্ণ, অন্যটি কনসোন্যান্ট বা ব্যাঞ্জনবর্ণ। আর দুই অক্ষরের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা শব্দ হচ্ছে ‘অব’ (ঙঋ), ‘টু’ (ঞঙ), ‘ইন’ (ওঘ), ‘ইজ’ (ওঝ) ও ‘ইট’ (ওঞ)—এগুলো উল্টেপাল্টে বসালে মিলে যেতে পারে সংকেতের অর্থ। তারপর ধরা যাক বাংলা স্বরবর্ণ অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ। একে যদি ধরি, অ=১, আ=৩, ই=৫ এমন করে, তাহলে অ আ ই-কে লেখা যাবে ১৩৫ হিসেবে। কিংবা ধরা যাক ‘পবাংপলা’ শব্দটির অর্থ কি কিছু বোঝা যাচ্ছে! যাচ্ছে না। আসলে খুব সহজ—অপ্রয়োজনীয় দুটি ‘প’ বসানো হয়েছে ‘বাংলা’ শব্দটির মধ্যে। মজার না?

    আপাতত, এটুকুই!

    কভাকলো কথেককো!

    বুঝতে পারছ?

তথ্যসূত্র: জার্নাল অব ক্রিপ্টোলজি

ছবি: কবির হোসেন ও সংগ্রহ

মডেল: সুজানা