এনিগমা কোড পাঠোদ্ধারের নেপথ্যের কয়েকজন

হিটলারের নািস বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে এনিগমা নামের একধরনের সাংকেতিক কোডের আশ্রয় নিয়েছিল। রেডিও বার্তা ও মোর্স কোডের মাধ্যমে তাদের এ বার্তাগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো হতো। স্বভাবতই সেসবে থাকত নানা স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এনিগমা মেশিনে তৈরি এই বার্তাগুলো এতই দুর্বোধ্য ছিল যে নািসরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল, তাদের গুপ্তবার্তা প্রতিপক্ষ কোনোভাবেই পড়তে পারবে না।

কিন্তু সে সময়ে মিত্রপক্ষের ব্রিটিশ ও ফরাসি ক্রিপ্টোলজিস্টদের একটি দল এসব বার্তার পাঠোদ্ধার করতে পেরেছিল। ধারণা করা হয়, এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অন্তত দুই থেকে চার বছরের মতো সংক্ষিপ্ত হয়েছে। জীবনরক্ষা হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের।

কিন্তু এই এনিগমা কোড পাঠোদ্ধারের কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। খুব গোপনে বড় একটি প্রজেক্ট নেওয়া হয় এ অসাধ্য সাধন করতে। সেখানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ তাদের মেধা ও শ্রম দিয়েছিল। এই ১০ হাজার মানুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ছিল অল্পবয়সী নারী। এই প্রজেক্টে তাঁরাই নিজেদের জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়টুকু ব্যয় করেছে। নানা স্বার্থে এই প্রজেক্টের কথা ব্রিটিশ সরকার গোপন রাখে। তাই এই নারীরা কখনো এই কাজের কোনো স্বীকৃতি পাননি। এমনকি অনেক কর্মীর পরিবারও জানত না কী কাজে তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদেরই কয়েকজন সম্পর্কে তোমাদের বলব আজ।

এনিগমা কোড নিয়ে তৈরি ইমিটেশন গেম চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
এনিগমা কোড নিয়ে তৈরি ইমিটেশন গেম চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

তার আগে এনিগমা কোড নিয়ে আরেকটু জানিয়ে নিই। ডিটেকটিভ উপন্যাসে যেসব কোড দেখা যায়, সেগুলোতে কোনো বার্তাকে দুর্বোধ্য করতে যিনি বার্তাটি লিখেছেন, তিনি নানাভাবে সেটা পাল্টে দেন। যেমন কেউ হয়তো প্রতিটা অক্ষর তার পরের নির্দিষ্টসংখ্যক ক্রমের কোনো অক্ষর দিয়ে পাল্টে দিল। কিংবা সে হয়তো পুরো লেখাটা লিখবে আয়নায় যেমন দেখা যায় তেমন মিরর ইমেজ করে—যে কাজটা করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি। আবার ইংল্যান্ডের রানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপারটাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। তারা বার্তার প্রতিটা অক্ষরের জন্য নিজের মতো করে একটা প্রতীক ব্যবহার করেছিল। যেমন ক-এর জন্য তারা ব্যবহার করেছিল ম, কিন্তু খ-এর জন্য গ কিংবা একটা হ্যাশ চিহ্ন।

এ রকম বার্তা কোনো ডিটেকটিভের হাতে এলে তাকে বের করতে হবে ঠিক কোন অক্ষরের বদলে কোন অক্ষর লেখা হয়েছে। তাহলেই পুরো বার্তাটার অর্থ উদ্ধার করা যায়।

কিন্তু এনিগমা কোডের জন্য এটি সত্য ছিল না। ধরো, কোনো দিন তুমি নািস বাহিনীর রেডিও বার্তা থেকে একটা এনিগমা কোডেড বার্তা পেলে। অনেক মাথা খাটিয়ে তুমি সেটার প্রথম শব্দের সম্ভাব্য একটি অর্থ উদ্ধার করলে। অর্থাত্, ঠিক কোন অক্ষরের জন্য কোন প্রতীক বা অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বুঝে গেলে। ধরা যাক, এই প্রথম শব্দের রোমান হরফ ডি-এর জন্য ব্যবহূত হয়েছে জেড। তুমি খুশি মনে পরের কোনো শব্দে ডি পেলেই সেখানে জেড বসিয়ে গেলে। কিন্তু বসানো শেষে দেখলে, কোনো অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে, পরের শব্দগুলোয় ডি-এর জন্য অন্য কোনো অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে!

ব্লেচলি পার্কের এই ভবনেই চলত কোড ব্রেকিংয়ের মহাযজ্ঞ
ব্লেচলি পার্কের এই ভবনেই চলত কোড ব্রেকিংয়ের মহাযজ্ঞ

তার মানে, মাথা খাটিয়ে পুরো বার্তাটার অর্থ বের করা মানুষের পক্ষে একদমই অসম্ভব। তার ওপর প্রতিদিন নতুন উপায়ে বার্তা প্রেরণ করত নািসরা। তার মানে হয়তো সারা দিন ব্যয় করে পূর্ণাঙ্গ কোড-ব্রেকার ফর্মুলা পেয়ে গেল মিত্রপক্ষ। এই খুশিতে ধেই ধেই করে নাচতে গেলেই কিন্তু বিপত্তি। কারণ তার পরদিনই ওই ফর্মুলা আর কাজ করবে না।

মূলত বিখ্যাত গণিতবিদ অ্যালান টিউরিং এ অসাধ্য সাধনের জন্য একটি ডিসাইফারার মডেল তৈরি করেন। তাঁর নেতৃত্বেই এই প্রজেক্টের হাজার হাজার কর্মী প্রতিদিনই অসংখ্য বার্তার অর্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। কীভাবে এ পুরো কাজটা হতো, তা আমাদের আজকের আলোচ্য এ গুরুত্বপূর্ণ তিনজন নারী কর্মীর অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে।

প্যাট্রিসিয়া ডেভিস

এনিগমা কোড পাঠোদ্ধারের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল কোডগুলো সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে নািসরা সেগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করত। সেসব সিগন্যাল থেকে কোডগুলো শুনতে মিত্রপক্ষকে সংকেত ধরার স্টেশন স্থাপন করতে হতো যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি, যাতে সিগন্যালগুলো ভালোভাবে পাওয়া যায়।

এমন কয়েকটি স্টেশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল ১৯ বছর বয়সী প্যাট্রিসিয়া ডেভিসের। তাঁর সঙ্গে আরও শত শত নারী শ্রোতা হিসেবে এসব স্টেশনে পার করেছেন যুদ্ধের পুরো সময়টা।

নািস-অধ্যুষিত ফ্রান্সের এক পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত স্টেশনে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছেন প্যাট্রিসিয়া। ইংলিশ চ্যানেলের কাছে ডোভার বন্দরের উপকূলের সে স্টেশনে তারা পালা করে জার্মান যুদ্ধজাহাজ থেকে পাঠানো কোড শুনে লিপিবদ্ধ করতেন। তারপর সেগুলো পাঠাতেন ইংল্যান্ডের ব্লেচলি পার্কের ডিসাইফার স্টেশনে প্রেরণ করত।

প্যাট্রিসিয়ার বয়স এখন ৯১ বছর। তিনি কয়েক দিন আগে বলেছেন, সে সময়টা ছিল তাঁর জীবনের এক অসাধারণ অধ্যায়।

রুথ বর্ন

ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বের ব্লেচলি পার্কে গণিতবিদ টুরিং এনিগমা কোড উদ্ধারের জন্য একটি কোড ব্রেকিং কেন্দ্র পরিচালনা করেছিলেন। দুই থেকে ছয় হাজার গুপ্ত সংকেতের অর্থ উদ্ধারের জন্য তখন সময় পাওয়া যেত মাত্র এক দিন। বৃহত্ এ কর্মযজ্ঞে সে জন্য যুক্ত করা হয়েছিল আট হাজার কোড ব্রেকার। কর্মী ছিল আরও চার হাজার মানুষ।

স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় সংকেত উদ্ধারের জন্য অ্যালান টুরিং ব্যবহার করেন তাঁর ডিজাইনকৃত বোম্ব নামে একধরনের ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ডিভাইস। এই ডিভাইসগুলো পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন ছিল হাজার হাজার কর্মী। অষ্টাদশী রুথ বর্ন তাদেরই একজন। তাঁর কাজ ছিল এই ডিভাইসগুলো চালু রাখা, প্রয়োজনমাফিক নানা সেটিংস পরিবর্তন করা।

কলেজ থেকে সদ্য বের হওয়া রুথ ছিলেন উইমেনস রয়্যাল নেভাল সার্ভিসের একজন সদস্য।  প্রতিদিন আট ঘণ্টার শিফটে সে মেশিনগুলোর রোটর পরিবর্তন, শর্টসার্কিট প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া, প্ল্যাগগুলো সঠিকভাবে লাগানো ইত্যাকার কাজ বিরামহীনভাবে করে যেতেন। এখানকার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল গোপনীয়তা। একটি ইউনিট কখনো অন্য ইউনিটের ব্যাপারে জানতে পারত না, এবং তারা কী কাজ করছে, তা বাইরে কোথাও প্রকাশ করতো না। একটা মহাযজ্ঞের অংশ হয়ে সেটা কাউকে না জানানোর যে অতিপরিমিতি, সেটা তাঁদের গ্রহণ করতে হয়েছে। এমনকি রুথের মা-বাবা মৃত্যুর আগেও জেনে যেতে পারেননি তাঁদের মেয়ে লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর মতো মহতী কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল।

আইরিন ডিক্সন

জার্মানরা এনিগমা কোড দিনকে দিন আরও জটিল করে তোলে। সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোড ব্রেকিং এই অপারেশনকেও উন্নত করতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ব্লেচলি পার্কে অ্যালান টুরিংয়ের সহকর্মী প্রকৌশলী টমি ফ্লাওয়ার নির্মাণ করেন প্রথম প্রোগামেবল কম্পিউটার ‘কলোসাস’।

১৯৪৪ সাল ছিল পূর্ব লন্ডনের তরুণী আইরিন ডিক্সনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। কেননা, সে সময়ই তিনি কলোসাসের একজন অপারেটর হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। কলোসাস জার্মানিদের যেকোনো কোড ভাঙার জন্য অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারত। প্রাথমিক অবস্থায় এটি সেকেন্ডে পাঁচ হাজার ক্যারেক্টার পড়তে পারত, যা তাদের আগের এক সপ্তাহের কাজকে এক ঘণ্টার নামিয়ে আনে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কলোসাসকে গোপন রাখতে এটার ডিজাইনসহ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তাই প্রথম কম্পিউটার হলেও কম্পিউটারের বিবর্তনে এর তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

ডিক্সন অপারেটর হওয়ার সুবাদে সে সময়কার বিখ্যাত কয়েকজন গণিতবিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান, তাঁদের নির্দেশমতো তথ্য ইনপুট করেন, যা সফলভাবে অসংখ্য সিক্রেট কোডের অর্থ উদ্ধার করে।

অদ্ভুত হলেও সত্য, পৃথিবীর প্রথম আধুনিক কম্পিউটারের অপারেটর হওয়া সত্ত্বেও ডিক্সন পরবর্তী জীবনে কম্পিউটার কখনো তেমন একটা ব্যবহার করেননি।

সূত্র: টেকক্রাঞ্চ ডটকম