খুদে বীর

পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে শীত ঢুকে পড়েছে ডাকাতের মতো। ঘরের ভেতরটা যেন বরফের কারখানা হয়ে গেছে। ঘরের ডোয়া-মাটিও বরফখণ্ড এই মধ্যরাতে। কুঁড়ের পাশের জামরুল ও মেঘশিরীষের পাতায় জমা শিশির ঝরছে ঘরের টিনের চালের ওপরে বৃষ্টির মতো। প্রতি মধ্যরাতেই এ রকম হিমবৃষ্টি ঝরে। শব্দ বাজে দারুণ মিষ্টি।

ছোট ভাইটি তো সন্ধেবেলায় কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমও এসে যায়। মধ্যরাতে দুলির ঘুম টুটে যায়। আবারও ঘুমায় সে ভোররাতের দিকে। ছোট ভাইটি এক ঘুমে রাত পার করে দেয় মায়ের বুকে নাক গুঁজে।

রোজ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে দুলির মনে পড়ে বাজানের কথা। গভীর সমুদ্রের জেলে। বহরদারদের বড় বড় ট্রলারে চেপে গভীর সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে। সুন্দরবনের দুবলার চরের অস্থায়ী পল্লিতে থাকে। মাসে-দুমাসে একবার বাড়ি ফেরে। দু-চার দিন থেকে আবারও ফিরে যায়। কিন্তু এবার প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে, বাজান বাড়ি আসেনি। মায়ের তো দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সুন্দরবনের বাঘ। গভীর সমুদ্রের জলদস্যু। সুন্দরবন আর সমুদ্রের বিপদের কোনো হাত-পা নেই। তবু আশ্বিন থেকে মাঘ পর্যন্ত বাজান দুবলার চরেই কাটায়। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত সুন্দরবনে ঢুকে মৌচাক কাটে। গোলপাতার সিজনে গোলপাতা কাটে। বেশ চলে যায়। এবার সে ক্লাস ফাইভে উঠেছে। এবারও বাজানের সঙ্গে সুন্দরবনে যাওয়ার কথা। পরীক্ষা শেষ তো! তা বাজানই তো ফিরছে না।

অবশ্য বাজানের সঙ্গে পাঁচবার সে সুন্দরবনে গেছে। থেকেছে পাঁচ-দশ দিন করে। সমুদ্র দেখেছে। রাতের বেলায় টর্চের আলোয় হরিণদের হীরকখণ্ডের মতো জ্বলন্ত চোখ দেখেছে।

ভোরের পাখিরা জেগেছে। এ সময়ে উঠোন থেকে ভেসে এল নজু চাচার গলা—‘দুলি রে, ও দুলি! ভাবি—ওঠেন।’

নজু চাচার গলা শুনে একসঙ্গে ছিটকে উঠে বসল দুলি ও তার মা। নজু চাচা! সেও তো বাজানের সঙ্গে সুন্দরবনে যায়! কোনো দুঃসংবাদ!

মা-মেয়ে উঠোনে নামল লাফ দিয়ে। কুয়াশা নেই আজ। আকাশে চাঁদ। নজু চাচা বলল, ‘না না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একসঙ্গেই আইছি। বোঝাবিড়ে ম্যালা! দুলির বাপের হাতে আর গায়ে বড় হাঙর কামড় দিছে। হাঁটতে তাই কষ্ট হয়। দুলিরে গাঙের ঘাটে যাতি কইছে।’

দুলির মা চিত্কার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। দুলি দৌড় লাগাল—নেমে পড়ল মাঠে। মাঠটা রূপকথার সেই তেপান্তরের মাঠের মতোই বড়। এই মাঠ পাড়ি দিলে নদী।

ভোরের আলো তো ফোটেনি ভালোভাবে, চারপাশে আঁধার আঁধার ভাব।

ছুটছে দুলি ঘোড়ার বেগে। পায়ের তলায় শিশিরভেজা মাটি। ধানের ভেজা নাড়া। না, শীত এখন আর লাগছে না তার। তার বাজান রে বড় হাঙরে কামড়াইছে। এবার যাওয়ার সময় বাজান কথা দিয়ে গিয়েছিল, দুবলার চরের রাসপূর্ণিমার মেলা থেকে দুলির জন্য অনেক-অনেক কিছু কিনবে। কিনবে মায়ের জন্য। ছোট ভাইটির জন্য।

সামনে হঠাত্ মধ্যমাঠের সেই শ্মশানখোলা। সর্বনাশ! পাঁচ বিঘাজোড়া বটগাছটির তলায় নাকি চাঁদনি রাতে পরিরা নাচগানের আসর বসায়। ওই গাছের ডালে ডালে নাকি এক জোড়া করে ভূত থাকে। ভূতের রাজা প্রতি অমাবস্যা রাতে এসে এই বটতলায় ভূত-পরিদের সঙ্গে সভা করে। সেই বটতলায় পথ ভুলে চলে এল সে! সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে এসেছে সে। বটতলাটা অন্ধকার।

একটু এগিয়ে তাকাতেই চার চোখ আটকে যায় এক জোড়া নয়, তিন জোড়া হীরকখণ্ড আলোর দিকে—পরিদের চোখ! ঘাবড়ে যায় দুলি।

পেছনে হটছে দুলি। কাঁপছে থরথর করে—না, শীতে নয়, পরির ভয়ে। এ সময়ে তিন জোড়া চোখই যেন নড়ল একটু, পরমুহূর্তে ভেসে এল করুণ কণ্ঠের ডাক—হরিণের বাচ্চা! তাই তো! জ্বলন্ত চোখ দেখেই তার বুঝে ফেলা উচিত ছিল! এবার ভয় পেল আবার দুলি। হরিণচোর! হরিণ চোরাকারবারি! সঙ্গে সঙ্গে মাথায় তার হাজারটা চিন্তার ঢেউ আছাড় খেতে শুরু করল। সুন্দরবন থেকে হরিণ, হরিণছানা ও বাঘের বাচ্চা ধরে চোরা শিকারিরা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করে অভিনব কৌশলে। বাঘের বাচ্চার শরীরে কালো রং মেখে দেয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ভুটানের কালো কুকুর। হরিণছানার শরীরে মাখে বাদামি বা কালো রং। বোঝার উপায় নেই যে এগুলো ছাগলছানা নয়। আবার, কোরবানির সময় ছাগলের শরীরে ফুটিয়ে তোলে হরিণের রং-ফোঁটাও আঁকে নিখুঁতভাবে। গোপনে বেচে। যে কেনে, টের পাওয়ার পরে সে আইনের ভয়ে কাউকে বলে না কিছু।

দুলির চৌদ্দপুরুষ সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালি আর মৌয়ালি। সুন্দরবনটা ওদের জীবন। তাই তার রক্তে এই শীতের সকালে তুফান জাগে, সাহস করে পায়ে পায়ে এগোয়। হ্যাঁ, বটের ঝুরির সঙ্গে বাঁধা তিনটি হরিণছানা। শরীরে কালো রং। তিনজন মানুষ একটু ওপাশেই ঝরাপাতার বিছানার ওপরে শুয়ে আছে টানটান হয়ে। কালো কম্বলে তিনজনেরই আপাদমস্তক ঢাকা।

পিছিয়ে আসছে সে। ভাবছে কী করা এখন! একদিকে বাবা, একদিকে হরিণছানা তিনটি। এ সময়ে একটি ছানা জোরসে ডেকে উঠল। তড়াক করে উঠে বসল তিনজন মানুষই। ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দেওয়ার সময়েই দুলি বুঝল দুজন আসছে তেড়ে।

ঝেড়ে দৌড় দিল সে। পেছনে গালাগাল ঝাড়তে ঝাড়তে আসছে ওরা। পেছনে তাকিয়ে দেখে—দুজনের হাতেই রামদা। মাঠে নেমে দৌড়াচ্ছে দুলি। দৌড়ে সে তার স্কুলের চ্যাম্পিয়ন মেয়ে। কিন্তু আজ তাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টা দিতে হবে। দূরত্ব কমিয়ে এনেছে ওরা।

ছুটে এল পরপর দুখানা রামদা। একখানা উড়ে গেল দুলির কোমরের পাশ দিয়ে। অন্যখানা আঘাত করল দুলির পিঠে। হুমড়ি খেয়ে পড়েই উঠে আবার দে দৌড়।

সকালের সূর্য উঠল দূরের গাছপালার মাথার ওপরে। বারাশের মোড়ে দাঁড়ানো কয়েকজন লোক। তিনজনের কোলে তিনটি কালো ছাগলছানা। বাগেরহাটের দিক থেকে রোজ সকালে রিকশাভ্যানে ছাগল চাপিয়ে খুলনার দিকে যায় ছাগল ব্যাপারীরা। ঘেরাও দেওয়া ভ্যান। ভেতরে ছাগল থাকে গাদাগাদি করে। খুলনায় গিয়ে পাইকারি দরে বেচে আসে ব্যাপারীরা।

ছাগলবোঝাই একখানা রিকশাভ্যান এসে দাঁড়াল ঠিক ছাগলছানা কোলে লোক তিনজনের সামনে। ছানা তিনটি ওরা বসিয়ে দিল ছাগলের ভ্যানে। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন লোক গিয়ে জাপটে ধরল লোক তিনজনকে। ছাগল ব্যাপারী ছিল বাইসাইকেলে। সাইকেল ফেলেই সে দৌড় দিল। ধরা হলো তাকেও। এ সময়ে ওদিকের কালভার্টের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুলি ও ১২ জন পুলিশ সদস্য।

দুলি প্রথমেই দৌড়ে গিয়েছিল এক গ্রাম পুলিশের বাড়িতে। তারপরে দুজনে মিলে মেম্বারের বাড়িতে। মোবাইল দিয়েছিল ফকিরহাট থানায়।

দুলি দৌড় শুরু করল আবার। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে পৌঁছে গেল ঘাটে। বাজান বসে আছে নৌকার গলুইতে চাদর মুড়ি দিয়ে। দুলি লাফ দিয়ে গলুইতে চড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বাজান ওকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘কান্দিসনে রে মা, কামড়াইয়া চামড়া-মাংস তুইলে নিছে, কয় দিন পরে ঠিক হইয়ে যাবে। মোংলা হাসপাতালে গেইছি না! আমারে ইনজেকশন দিছে না! বড়ি-কড়ি দিছে না! এই দ্যাখ, কিছুই হয়নি।’

বাজান দুলিকে হাত ও হাঁটুর ক্ষত দেখাল। তারপরে বলল, ‘মা রে! সব আনছি এবার তোইগো জন্যি! কোরাল মাছ আনছিরে মা—তিরিশ কেজি ওজন। মোংলা থেইকা মধু কিনিছি। চল, মা। তা এত দেরি করলি কেন, অ্যা?’

দুলি নামতা পড়ার মতো বলে গেল সব। ওর বাজান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল—চোখ দুটো জ্বলে উঠল বাঘের মতো। দুলির মাথায় হাত রেখে ব্যাঘ্রগর্জনে বলল, ‘ওই তিন চোরা সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ শ্যাষ করতিছে! দলে ওরা ১৩ জন। ওই ব্যাটা ছাগলের কারবারিও ওদের দলের। চল তাড়াতাড়ি তিনডেরে আমি খুন করব!’

বাড়ি ফিরে দেখে বাড়িভরা লোকজন। খুলনা থেকে বড় বনবাবু এসেছেন। তিনি দুলিকে বুকে টেনে বললেন, ‘দুলি! এই চক্রটারে আমরা পাকড়াও করতে পারছিলাম না। তুমি আজ সেই কাজ করেছ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তুমি আমাদের জাতীয় খুদে বীর। আমি ঢাকার হেড অফিসে ফোন করেছি। তুমি পুরস্কার পাবে এক লাখ টাকা, একটি সোনার মেডেল ও সার্টিফিকেট।’

খবর শুনে দুলি হাসল, বনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক লক্ষ টাকা কত টাকা গো বনবাবু?’

বনবাবু হাসলেন সুন্দর করে।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন