ভাস্কর্যেরও মানে আছে?

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ইকুয়েস্টু্রেইন স্ট্যাচু
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ইকুয়েস্টু্রেইন স্ট্যাচু

একটা সময় ছিল যখন পান থেকে চুন খসলেই মানুষ যুদ্ধে নেমে যেত। বিশ্বাস হচ্ছে না? লাইমান কাটলার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাধারণ কৃষক। ১৮৫৯ সালের ১৫ জুন, তাঁর আলুর খেতে একটা শূকর চলে এল। এমনিই চাষবাস নেই, তার ওপর শূকরটাকে আলুখেতে দেখে মেজাজটাই গরম হয়ে গেল কাটলারের। অমনি গুলি করে বসলেন পশুটাকে। ব্যস! শূকর মালিক খবর পেয়ে ছুটে এলেন। তিনি আবার আইরিশ। তখন যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মধ্যে সানজুয়ানা দ্বীপ নিয়ে বেশ ঝামেলা চলছিল। আইরিশ লোকটির নাম চার্লস গ্রিফিন। ক্ষতিপূরণ দাবি করলেন তিনি। কাটলার রাজি হলেন ১০ ডলার দিতে।

কিন্তু গ্রিফিন নাছোড়বান্দা, তাঁর দাবি ১০০ ডলার। কাটলার খেপে গেলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘শূকর সামলাতে পারো না আবার এসেছ ক্ষতিপূরণ চাইতে? দিচ্ছি না আমি।’

একটু পর স্থানীয় পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। খবর পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিলিটারি পাঠিয়ে দিল। তারা সানজুয়ানা দ্বীপ দখল করার জন্য তক্কে-তক্কে ছিল, সুযোগ পেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন। সত্যিই যুদ্ধ বেধে গেল সামান্য এক শূকর নিয়ে! ইতিহাসে এটি ‘পিগওয়ার’ নামে পরিচিত।

এটা তো তেমন প্রাচীন যুদ্ধ নয়। আধুনিক যুদ্ধের সঙ্গে রাজরাজড়াদের যুদ্ধের বেশ পার্থক্য আছে। সে সময় তলোয়ার, তির-ধনুক দিয়ে যুদ্ধ হতো। যোদ্ধারা ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করতেন। এই ঘোড়া ছিল প্রাচীন যুদ্ধের খুব গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধাদের ভাস্কর্য দেখা যায়। এগুলোকে ইংরেজিতে বলে ‘ইকুয়েস্ট্রেইন স্ট্যাচু’। ল্যাটিন শব্দ ‘ইকুয়েস’ মানে যোদ্ধা। আর ইকাস মানে হলো ঘোড়া। সেখান থেকেই এই স্ট্যাচুর নাম এসেছে। এসব ভাস্কর্য নিয়ে অদ্ভুত এক ধারণা প্রচলিত আছে।

ধারণাটি এ রকম—ভাস্কর্যে যদি ঘোড়াটির সামনের দুই পা শূন্যে থাকে তবে বুঝতে হবে অশ্বারোহী যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছিলেন। ঘোড়ার একটি পা শূন্যে থাকার অর্থ যোদ্ধা আহত হয়েছিলেন। আর দুটি পা মাটির সঙ্গে নামানো থাকলে বুঝতে হবে, যোদ্ধা অক্ষত অবস্থায় যুদ্ধ শেষ করেছিলেন।

মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাটোরে বীর চেঙ্গিস খানের ভাস্কর্য। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইকুয়েস্ট্রেইন স্ট্যাচু
মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাটোরে বীর চেঙ্গিস খানের ভাস্কর্য। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইকুয়েস্ট্রেইন স্ট্যাচু

এ রকম ধারণা কি আসলেই সত্যি? এই ধারণার সত্যতা পাওয়া যায় এমন ভাস্কর্য অনেক রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ইকুয়েস্ট্রেইন স্ট্যাচু দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে অনেক স্ট্যাচু এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে। যেমন ধরা যাক, জেনারেল সাইমন বলিভারের ভাস্কর্যটির কথা। এতে ঘোড়ার এক পা উঁচু করা। অথচ, তিনি কোনো যুদ্ধে আহত হননি। মারা গিয়েছিলেন বার্ধক্যজনিত রোগে।

সবচেয়ে বেশি আলোচিত মেজর জেনারেল অ্যানড্রিউ জ্যাকসনের ভাস্কর্যটি। ১৮৫৩ সালে ল্যাফিয়েট পার্কে এই ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। ভাস্কর ক্লার্ক মিলস ঘোড়ার দুটি পা-ই শূন্যে বানিয়েছিলেন। অথচ অ্যানড্রিউ জ্যাকসন মারা গিয়েছিলেন যক্ষ্মায়। তাতে অনেকেই উপহাস করে বলে, ‘তবে কি যক্ষ্মা যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন জেনারেল জ্যাকসন?’

ভাস্কর মূলত সৌন্দর্য আর শিল্পগুণকে মাথায় রেখেই সেটি তৈরি করেছিলেন। এসব ধারণাকে তিনি আমলে আনেননি। ঘোড়ার পায়ের তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে এমন ভাস্কর্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এমনও অনেক ভাস্কর্য খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে ঘোড়ার এক পা উঁচু করা কিন্তু অন্য দেশে সেই একই অশ্বারোহীর ঘোড়ার দুই পা শূন্যে। অনেক পর্যটক বিভ্রান্ত হন এমন ধারণার কারণে।

যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি সেন্টার এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলেছে। বর্তমানে শিল্পগুণ মাথায় রেখে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ধারণা যেমনই হোক, প্রত্যেক দেশে এসব ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে বীর যোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য। তাই এ ধারণা নিয়ে পর্যটকেরা এখন আর মাথা ঘামান না। বরং ভাস্করদের শিল্পগুণ আর সৌন্দর্যচিন্তা দেখে মুগ্ধ হতে ভালোবাসেন তাঁরা।

স্নোপস ডটকম অবলম্বনে